বিশেষ প্রতিবেদন

পানির ন্যায্য হিস্যা পেতে এখনই এগোতে হবে বাংলাদেশকে

অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশকে এখনই কাজ শুরু করতে হবে বলে মনে করেন মার্কিন আইনজীবী গিল গারসেটি। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় পানি শিক্ষা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো-আইএইচই-এর সংস্কৃতি বিষয়ক দূত। সম্প্রতি এসেছিলেন বাংলাদেশ সফরে। নেদারল্যান্ডসে অবস্থিত পানি শিক্ষা বিষয়ক এ প্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর বাংলাদেশিরা স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যান। সেখান থেকে ফেরত এসে তারা কীভাবে দেশের পানি সুরক্ষায় কাজ করছেন সেই চিত্রই দেখতে এসেছিলেন এই মার্কিন নাগরিক। বাংলাদেশের পাশাপাশি তিনি কম্বোডিয়া ও কেনিয়াও সফর করবেন। সেখানেও ইউনেস্কো-আইএইচই-এর অ্যালামনাইয়ের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করবেন তিনি। এই তিন দেশ ঘুরে তার তোলা ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনীও অনুষ্ঠিত হবে নেদারল্যান্ডসে। ছবির বিষয় পানি সুরক্ষা। বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়ানো আর ছবি তোলা ৭৬ বছর বয়স্ক গিল গারসেটির নেশা।এক সপ্তাহের ঢাকা সফরের শেষ দিনে রাজধানীর একটি হোটেলে জাগো নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি জানান সফরের খুঁটিনাটি। কথা বলেন বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে। পানি নিয়ে সরকারের নেয়া পরিকল্পনাগুলোর প্রশংসা করলেও ভবিষ্যত সংকট মোকাবেলায় এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দেন মার্কিন সরকারের সাবেক এই পাবলিক প্রসিকিউটর।তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদীগুলোতে ভারত ও চীন যদি বাঁধ তৈরির মাধ্যমে পানি সরিয়ে নেয় তাহলে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে। এ কারণে এখন থেকেই অভিন্ন নদীগুলো নিয়ে বাংলাদেশকে কর্মপরিকল্পনা তৈরির পরামর্শ তার। তিনি বলেন, উৎস ও উজানের দেশগুলো যেমন নেপাল, ভারত, ভুটান, চীনের সঙ্গে পানি চুক্তি ও প্রবাহ নিয়ে আলোচনা ও করণীয় ঠিক করতে হবে সরকারকে। গিল বলেন, বাংলাদেশে কৃষিজমি খুব কম কিন্তু জনসংখ্যা অনেক বেশি। তা সত্ত্বেও কৃষিখাতে ব্যাপক সাফল্যে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ কারণেই পানি ব্যবস্থাপনাকে সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। তিনি বলেন, পানির প্রতি এদেশের মানুষের নির্ভরশীলতা বেশি। সুতরাং পানির সঠিক ব্যবহারের বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। বাঁধ দিয়ে পানি ব্যবস্থার কথা ভাবা যেতে পারে।গিল বলেন, বাংলাদেশের কৃষকরা ভূগর্ভস্থ পানি খুব বেশি ব্যবহার করছে। কিন্তু অধিক ব্যবহারের ফলে কয়েক বছর পর যখন পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাবে, তখন বিপদ বাড়বে। কারণ, বন্যার ঝুঁকি বাড়বে। পানি প্রকৌশলীদের খেয়াল রাখতে হবে পানির স্তর কোথায় আছে। প্রয়োজনে কৃষকদের সচেতন করতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহারে জমির লবণাক্ততা বেড়ে যায় বলে সাবধান করেন তিনি। পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জগুলো কী জানতে চাইলে গিল গারসেটি বলেন, বন্যা ও নদী ভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নদীপাড়ের মানুষ, বিশেষ করে কৃষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, নিরাপত্তাই বাংলাদেশের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ। বন্যা নদীর গতিপথে পরিবর্তন এনে কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। নদী ভাঙন শহরে বস্তিবাসী বাড়ায়। সরকারের দায়িত্ব দেশকে পানির এ ধরনের ক্ষতিকর দিকগুলো থেকে রক্ষা করা। এজন্য পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে হবে। কার্যকর বাঁধ ও সেতু নির্মাণ করা যেতে পারে। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূমির উপরিভাগের পানি বেশি ব্যবহারের দিকে গুরুত্ব দিতে বলেন গিল। বৃষ্টির পানি ধরে রেখে প্রয়োজনীয় সময়ে ব্যবহারের সুযোগ তৈরির জন্য পরিকল্পনা করার পরামর্শও দেন তিনি। তার ভাষায়, প্রথমে সমস্যা কোথায় তা জেনে সমাধানের দিকে এগোতে হবে। এজন্য করণীয় ঠিক করতে হবে।গিল গারসেটি বলেন, পানি অত্যন্ত মূল্যবান ও এর যোগান সীমিত- সেটা সাধারণ মানুষকে অনুধাবন করাতে হবে। তাদের সচেতন করতে হবে যাতে অপচয় রোধ করা যায়।বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ ৭০ ভাগ পানির অপব্যবহার করেন বলে ধারণা পেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বহুদেশ আছে পানির অভাবে উন্নয়ন হচ্ছে না। এই বিষয়গুলো জনগণকে বোঝানো জরুরি।১৯৫৩ সালে ভয়াবহ এক বন্যার কবলে পড়ে ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডস। সেবার বন্যায় প্রায় দু’হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। তবে সেটাই শেষ। এরপর আর বন্যা দেখেনি ডাচরা। পানি ব্যবস্থাপনায় দক্ষতাই এর মূল কারণ বলে জানান গিল। তার মতে, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় নেদারল্যান্ডস থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে বাংলাদেশ। উভয় দেশই বদ্বীপ। ১৯৫৩ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর নেদারল্যান্ডসের পানি প্রকৌশলীরা যেভাবে পানি ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা তৈরি করেছেন তা সারা বিশ্বের কাছে একটি আদর্শ। নেদারল্যান্ডসের ইউনেস্কো-আইএইচইতে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছেন জানিয়ে গিল বলেন, এ পর্যন্ত চারশ শিক্ষার্থী সেখান থেকে ডিগ্রি নিয়েছেন। বাংলাদেশ তাদের মেধা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে। বাংলাদেশ নেদারল্যান্ডস সরকারেরও সাহায্য নিতে পারে। আমরা জানি এ বিষয়ে দু’দেশ একসঙ্গে কাজ করছে।শহরের বিপুল জনসংখ্যার পানির চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনার প্রশংসা করেন গিল। তবে তিনি পানির অপচয় ও দূষণ রোধে আরও আন্তরিক হওয়ার পরামর্শ দেন।গিলের পরামর্শ, আগামী পাঁচ বছরে পানির চাহিদা কত হবে, যোগান কোথা থেকে আসবে, এসব বিষয় মাথায় থেকে তার হিসেব কষতে হবে।জেপি/এআরএস/এনএফ/এমএস

Advertisement