প্রেম চাই- আছেন কবির সুমন। ক্লান্তি মুছিয়ে দিতে কাউকে চাই- আছেন কবির সুমন। অন্যায়ের প্রতিবাদ চাই- আছে কবির সুমনের গান। তিনি এমনই; সবখানেই তাকে পাওয়া যায়। সেজন্যই সময়-কাল জয় করে অমরত্বের প্রত্যাশা না করেও তিনি অমরত্বের পথিক।আজ এই কিংবদন্তির জন্মদিন। সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনার দিন যাপনের স্রোতে জীবনের ৬৭টি পা রেখেছেন তিনি। জীবনের বিশেষ দিনটিতে ভক্তদের ভালোবাসা আর শুভেচ্ছায় ভেসে যাচ্ছেন কবির সুমন।তার অনেক পরিচয়। একজন বাঙালি গায়ক, গীতিকার, অভিনেতা, বেতার সাংবাদিক, গদ্যকার এবং সংসদ সদস্য কবির সুমন। তার আরো একটি পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। সেটি হলো তিনি যোদ্ধা। এই যুদ্ধ তার শ্রেণি বৈষম্যের বিরুদ্ধে, এই যুদ্ধ তার অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে, এই যুদ্ধ তার শুদ্ধ গানের চর্চায়, এই যুদ্ধ মানুষের মনুষত্ব নিয়ে টিকে থাকার আহ্বানে।কবির সুমন ১৯৪৯ সালের ১৬ মার্চ ভারতের উড়িষ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্ব নাম সুমন চট্টোপাধ্যায়। তার পিতা সুধিন্দ্রনাথ এবং মাতা উমা চট্রোপাধ্যায়। বাংলাদেশের কিংবদন্তি গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিনকে বিয়ে করার জন্য ২০০০ সালে ধর্মান্তরিত হয়ে নিজের নাম নিজেই রেখেছিলেন কবির সুমন।সুমন একজন বিশিষ্ট আধুনিক ও রবীন্দ্রসংগীত গায়ক। সুমন যে আলাদা, সেটি বুঝতে সংগীত-বোদ্ধা হতে হয় না। সাধারনত নিজের গান নিজেই লিখেন, নিজেই সুর করেন। শিল্পী জীবনের প্রথম পর্যায়ে সুমন ‘নাগরিক’ নামের কলকাতার একটি ব্যান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে সুমন নিজেই একটা ব্যান্ড খুলেন, নাম দিলেন ‘সুমন দ্যা ওয়ান ম্যান ব্যান্ড’। সুমনই সুমনের ব্যান্ডের একজন এবং একমাত্র সদস্য। তার কনসার্টে অন্য কোনো যন্ত্রশিল্পীর প্রয়োজন পরে না। একই সাথে গিটার, হারমোনিকা, কিবোর্ড বাজিয়ে নিজেই নিজের গান করেন।সুমন মূলত ভক্তদের কাছে পৌঁছতে পেরেছেন তার জীবনমুখী গানের জন্যই। কোনো ইন্সট্রুমেন্টের বাড়াবাড়ি বা প্রযুক্তির কারসাজি নেই তার গানে। অসম্ভব সুন্দর গানের কথা , প্রত্যেকটা গানই শ্রোতাকে তার বিস্ময়ের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সুমন নিজেই একবার বলেছিলেন, ‘গান লেখার জন্য কল্পনা করার প্রয়োজন নেই, তোমার আশে পাশের পরিবেশ নিয়েই গান ধরো। আত্ম শুদ্ধির স্বাদ পাবে।’ এই জন্যই হয়তো সুমনকে বলা হয়ে থাকে নাগরিক কবিয়াল।১৯৯২ সালে ‘তোমাকে চাই’ অ্যালবামের মাধ্যমে তিনি বাংলা গানে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন। তার স্বরচিত গানের অ্যালবামের সংখ্যা পনেরো। সংগীত রচনা, সুরারোপ, সংগীতায়োজন ও কণ্ঠদানের পাশাপাশি গদ্যরচনা ও অভিনয় ক্ষেত্রেও তিনি স্বকীয় প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন। তিনি একাধিক প্রবন্ধ, উপন্যাস ও ছোটোগল্পের রচয়িতা এবং হারবার্ট ও চতুরঙ্গ প্রভৃতি মননশীল ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের রূপদানকারী।প্রথম জীবনে রেডিও জার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন ডয়েচ ভেলে তে,কাজ করেছেন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে। কেরানী ছিলেন ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়াতে। বন্ধু অঞ্জন দত্তের অনুরোধে অভিনয় করেছেন ‘রঞ্জনা আমি আর আসবো না’ সহ কিছু ভারতীয় বাংলা সিনেমাতেও। সৃজিতের ‘জাতিস্মর’ ছবিতেও মিলেছে সুমনের উপস্থিতি।বাংলাদেশের প্রতি সুমনের প্রাণের টান ফিকে হয়ে যায়নি কখনো। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ফেলানী-হত্যার বিচার, রাজাকার বিরোধী আন্দোলনের সময় খুন হওয়া ব্লগার রাজীব হত্যার বিচার, নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে গান করাসহ বাংলাদেশের বহু প্রসঙ্গ নিয়েই সুমন গান করেছেন। যেখানে অন্যায়, সেখানেই সুমনের প্রতিবাদ। রাজনীতিতে নাকি দলই সবার ওপরে। কিন্তু নিজের দলকেও সুমন রেহাই দেননি। মানুষ হিসেবে তিনি আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক। লালন সাঁই তার আত্মার মন্দিরে থাকেন।এভাবেই কেটে যাক দিনগুলো তার গানে গানে। তার ভক্তরা সবাই জানেন, কবির সুমনের অনেক অভিমান। সমাজ নিয়ে, দেশ নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, বিশ্বনীতি নিয়ে, প্রেম নিয়ে, প্রেমের স্বাধীনতা নিয়ে, সুন্দর আর নিজস্ব গান করা নিয়ে। সবাই অভিমান করতে পারে না। কবির সুমন অভিমান নিয়েই বেঁচে থাকুন। এই অভিমানটুকুই তো কবির সুমনকে সবার থেকে মহান করেছে, নন্দিত করেছে।শুভ জন্মদিন গানওয়ালা.......এলএ
Advertisement