বিশেষ প্রতিবেদন

আগুন ধরে আগুন নেভে, কান্না থামে না

‘আর কত! এভাবে কি টিকে থাকা যায়! রক্ত পানি করা শ্রমে তিলে তিলে সব গড়ে তুলি। আর মুহূর্তের মধ্যেই সব পুড়ে ছাই। চোখের সামনে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। শেষ সম্বলটুকুও রেহাই পায় না। দূরে গিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। কপাল চাপড়ানো ছাড়া কিছুই করার থাকে না।’বৃহস্পতিবার দুপুর; মাথার উপর তপ্ত রোদ। আগুনের ক্ষীণ শিখা তখনও মিলছে কোথাও কোথাও। চারদিকে পোড়া গন্ধ। যেন কোনো শ্মশান ঘাট। রাতভর পুড়িয়ে কড়াইলের বাতাস তখনও উত্তাপ ছড়াচ্ছে। যে উত্তাপে হাজারও স্বপ্ন পুড়ে ছাই, সে উত্তাপে বাকরুদ্ধ কড়াইলের মানুষ। রাতভর ভয়ঙ্কর আগুনের সঙ্গে বৃথা যুদ্ধ করে একেবারেই নিথর হয়ে পড়েছেন ইসমাইল হোসেন। রাত থেকে কোনো দানা পড়েনি পেটে। আটটি ঘর ছিল তার। চারটিতে চার ভাই থেকে বাকিগুলো ভাড়া দিতেন। পাশে দুটি দোকানও ছিল।৩৫ বছর বয়সী ইসমাইলের কাছে এখন সবই স্মৃতি। ঘর আর দোকানে একটি সুতাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আগুন লাগার পর যে কাপড়ে বের হয়েছিলেন, এখন শুধু তাই সম্বল। বাবার আমল থেকে বসবাস করা ঘরগুলোর চিহ্ন আছে, তবে কোনো শোভা নেই।জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলার শুরুতেই চোখ মুছলেন। ছল ছল চোখে খানিকটা ইশারাতেই বোঝালেন। গেল বছর দোকান পুড়েছিল, তবে সে বেলায় ঘর রক্ষা পেয়েছিল। এবার সব গেছে। ইসমাইল বলেন, ‘একেবারে পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া এভাবে আগুন লাগতে পারে না। গেল বছর দুবার আগুন লেগে অনেকেই পথে বসেছিল। ধারদেনা করে ঘরগুলো আবার দাঁড় করেছিলাম। এবার সব গেল। এখন আমরা কই যাব।’‘এটি পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ড’- জোর দিয়েই বললেন সাগর নামের আরেকজন। বলেন, ‘গত শুক্রবার স্থানীয় কমিশনার মসজিদে এসে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বস্তির জায়গা খালি করে দিতে হবে। সরকার বস্তিবাসীকে পুনর্বাসন করবে।’তিনি আরও বলেন, ‘যদি বস্তি খালি করতে হয়, তাহলে আমাদের নিঃস্ব করার প্রয়োজন কি? আলোচনা করেও ব্যবস্থা নিতে পারত। আমরাও তো রাষ্ট্রের নাগরিক। আমাদেরও তো বেঁচে থাকার অধিকার আছে।’কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগার ইতিহাস পুরনো। গত এক দশকে ১৭ বার আগুন লগেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ। গত বছরের ১৪ মার্চ ও ৪ ডিসেম্বর এখানে ভয়াবহ আগুন লাগে। এতে কয়েকশ ঘরবাড়ি পুড়ে যায়। আগুন লাগানোর পেছনে ষড়যন্ত্রের গন্ধও পুরনো।রাজধানীর একেবারে কেন্দ্রে দেশের এ সর্ববৃহৎ বস্তি উচ্ছেদের জন্য রাষ্ট্রপক্ষ বেশ কয়েকবার চেষ্টাও চালায়। গত বছরও সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে চেষ্টা চালানো হয়। বস্তিবাসীর বাধার কারণে উচ্ছেদ সম্ভব হচ্ছে না। এ নিয়ে মামলাও হয়েছে একাধিকবার।এখানে আগুন লাগে অজানা কারণে, তবে নেভানোর চেষ্টা চলে বস্তিবাসীর অদম্য বলেই। বেঁচে থাকার তাগিদে আগুন নেভে বটে, তবে কড়াইলের কান্না যেন শেষ হওয়ার নয়। অদৃশ্য ষড়যন্ত্রের থাবায় হাজার হাজার মানুষের স্বপ্ন নিমেষেই পুড়ে ছাই হচ্ছে বার বার। ছাইয়ের স্তূপে দাঁড়িয়েই ফের স্বপ্ন দেখা চলে এখানে। এভাবেই আগুন আর কান্নাকে আগলে রাখেন কড়াইলবাসী।এএসএস/এমএআর/জেআইএম

Advertisement