বিশেষ প্রতিবেদন

আগুনে পুড়েছে ঝর্না-রমজানের স্বপ্নও

‘ঘরবাড়ি, টাকাপয়সা, চাল-ডাল সব পুইড়া গ্যাছে। বই-খাতা, স্কুলড্রেসও পুইড়া গ্যাছে। আজ ক্যামনে স্কুলে যামু? কি পড়মু? বই কিনে দিবো কে?’ পুড়ে যাওয়া বইগুলো বুকে নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিল রাজধানীর কড়াইল বস্তির মায়ের দোয়া শিশু বিদ্যা নিকেতনের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ঝর্না আক্তার ও তার ছোট ভাই প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী রমজান।ঝর্না-রমজানের স্বপ্ন ছিল ভালোভাবে লেখাপড়া করে একদিন সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বাবা-মায়ের কষ্ট লাঘব করবে। কিন্তু সব স্বপ্ন, সব আশা নিমেষেই পুড়ে গেল আগুনে। বাড়ির অন্য সব জিনিসের সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তাদের সব বই। বই হারিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কিত তারা। কিভাবে স্কুলে যাবে? কি পড়বে? কে তাদের বই-খাতা কিনে দেবে? এমন অনেক প্রশ্ন এখন তাদের মনে।ঝর্না ও রমজানের বাবা জয়নাল আবেদিন একটি কারখানায় শ্রমিক সর্দার হিসেবে কাজ করেন। মা লেবুজা বেগম গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। বাবা মায়ের অল্প আয় দিয়েই তাদের দিন চলে। বাবার আয় দিয়ে লেখাপড়ার খরচ চালানো কঠিন। মা বাসাবাড়িতে কাজ করে যে টাকা পান তা দিয়েই তাদের পড়াশুনার খরচ চলে। বাবার আয় দিয়েই চলে ৫ সদস্যের পরিবার।কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঝর্না আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। মা অন্যের বাসায় কাজ করে আমাদের বই-খাতা-কলম কিনে দেন। গত রাতে আমাদের সব পুড়ে গেছে। আমার বাংলা, ইংরেজি, অংক, গণিত, বিজ্ঞান ও সাধারণ জ্ঞানসহ সব বই পুড়ে গেছে। এখন কোথা থেকে বই কিনবো? খাতা-কলম কিনে দিবে কে? স্কুলড্রেস কোথায় পাবো? বলেই কাঁদতে শুরু করে সে।তার পাশে বসে প্রিয় বই-খাতাগুলো সাজানোর চেষ্টা করছে ছোট ভাই মো. রমজান। সেও একই স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার রোল-২। ভালো পড়ালেখার কারণে স্কুলের সব শিক্ষক তাকে খুব আদর করে। মায়ের কাছে তার একটা গাড়ি কেনার আবদার ছিল। মা বলেছে, প্রথম হলে কিনে দিবে। গড়ির জন্য ভালো করে পড়েছে সে। এবার পরীক্ষায় রোল নম্বর হয়েছে ২। পরদিনই মা লেবুজা বেগম তাকে একটা গড়ি কিনে দিয়েছেন। দুর্ভাগা কপাল! গত রাতে আগুনে রমজানের সেই গড়িও পুড়ে যায়।রমজান জগো নিউজের এ প্রতিবেদকের কাছে বলে, ‘মা আমাকে একটা গড়ি কিন্না দিছে। আমি ভালো করে লেখাপড়া করছি। এখন আমি কি পড়বো। আমাকে বই কিনে দেন। আব্বা কিন্না দিবো না। তার থেকে টাকা নাই। এখন আমি কি পড়বো? খাতা-কলম কে কিনে দিবো?’ঝর্না ও রমজানদের গ্রামের বাড়ি শেরপুর জেলার চরশ্রীপুরে। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তারা দু’জনই ছোট। তাদের আরেক ভাই একটি বেসরকারি কোম্পানিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।শুধু ঝর্না কিংবা রমজান নয়, বস্তিতে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গেছে রাজধানীর মহাখালী মডেল হাই স্কুলের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদাউসের বইগুলোও। তার রোল নম্বর-২। সব হারিয়ে পোড়া ঘরের দরজায় বসে বসে কাঁদছিল সে। আগুনের কারণে ঘরের কিছুই রক্ষা করতে পারেনি তারা। আগুল লাগার সঙ্গে সঙ্গে সব রেখেই পালাতে হয়েছে তাদের। সকালে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর বিধ্বস্ত পোড়া ঘরে এসে দেখে, তার স্কুলের বই-খাতা ও ড্রেসসহ সবকিছুই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।জান্নাত জাগো নিউজকে বলে, ‘আমার সব বই পুড়ে গেছে। বহু পরিশ্রম করে তৈরি করা হ্যান্ডনোটটিও পুড়ে গেছে। মায়ের স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা পয়সাসহ অনেক কিছু ছিল। এখন স্কুলের স্যারের কাছে নতুন বই দেয়ার জন্য আবেদন করবো। বই দিলে পড়তে পারবো, না দিলে লেখাপড়া বন্ধ! স্যারেরা বই দিলেও খাতা-কলম দিবে কে? কে স্কুলের ড্রেস কিনে দিবে?’ সে চিন্তা উঁকি দিচ্ছে ৮ম শ্রেণির এই মেধাবী শিক্ষার্থীর মনে।উল্লেখ্য, বুধবার রাত ২টা ৫৫ মিনিটের দিকে কড়াইল বস্তিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুন লাগার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট গিয়ে তা নেভাতে কাজ শুরু করে। পরে আরও ছয়টি ইউনিট তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ২০টি ইউনিটের চেষ্টায় প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। প্রায় দেড়শ একর জায়গার উপর গড়ে উঠেছে কড়াইল বস্তি। এই বিশাল বস্তিতে কয়েক লাখ মানুষ বাস করেন। প্রায় প্রতিবছরই এখানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।এমএসএস/এআরএস/এমএআর/জেআইএম

Advertisement