ঘড়ির কাটা বিকেল পাঁচটা ছোঁয়ার আগেই কলম্বোর আকাশ জুড়ে মেঘ। কালো মেঘে সূর্যে ঢাকা পড়ায় আলো গেল কমে। স্থানীয় সময় ঠিক সোয়া পাঁটায় আলো কমে যাওয়ায় আম্পায়াররা যখন খেলা বন্ধ করে বেলস তুলে নিলেন তখনও দিনের ৪১ বল বাকি। বাংলাদেশের ফিল্ডার ও লঙ্কান দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান সাজঘরে ফেরার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল ধুম বৃষ্টি। একেবারে মুশল ধারে যাকে বলে। চললো এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে। তাই আর খেলা মাঠে গড়ানোর প্রশ্নই আসে না। দিনের প্রায় ৭ ওভার আগে খেলা বন্ধ হলো তাতে কি? প্রথম দিনটি আরও আগেই নিজেদের করে নেয় মুশফিকের দল। শততম টেস্ট। দেশে উৎসব উৎসব ভাব। বঙ্গোপসাগর হয়ে কলম্বোয় ভারত মহাসাগরেও এসে লেগেছে সে উৎসবের ঢেউ। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন, বোর্ড সিইও নিজামউদ্দীন চৌধুরী সুজন, সহ-সভাপতি মাহবুব আনাম, পরিচালক জালাল ইউনুস, আকরাম খান, আই এইচ মল্লিক ও আউয়াল চৌধুরী ভুলুসহ বোর্ডের শীর্ষ কর্তাদের বেশ কজন দলকে অনুপ্রাণিত করতে এখন কলম্বোয়। শততম টেস্টের উৎসবমুখর পরিবেশটাকে আরও চাঙ্গা করতে আগের রাতে ক্রিকেটারদের সাথে নিয়ে কেক কেটেছেন বিসিবি বিগ বস। শততম টেস্টের সকালটাও কেটেছে চমৎকার। লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড ছোট্ট অথচ দারুণ ছিমছাম ও অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে টাইগারতের শততম টেস্টকে বরণ করে নেয়। লঙ্কান বোর্ড প্রধান সোমাথিপালা নিজে উপস্থিত ছিলেন মুশফিক, তামিম ও সাকিবদের অভিনন্দেনে সিক্ত করতে। সবার জানা কাউকে অন্যরকম সংবর্ধনা দেয়া মানেই লালগালিচা সংবর্ধনা। কিস্তু আজ পি সারায় সকালে টাইগাররা পেয়েছেন নীল সংবর্ধনা।শততম টেস্ট খেলতে নামার আগে দু’দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন থেকে শুরু করে দুই অধিনায়কের পতাকা বদল এবং অতিথি দলের প্রতিটি সদস্যকে শততম টেস্টের স্মারক পদক পরিয়ে দেয়া হয়। লাল-সবুজ বেলুন ওড়ানোর মধ্য দিয়ে শেষ হলো সে আনুষ্ঠানিতার। টাইগারদের সমর্থন জোগাতে বেঙ্গল টাইগার্সরাও এখন কলম্বোয়। তারাও ক্রেস্ট দিয়ে সংবর্ধিত করেছে প্রিয় জাতীয় দলকে। আর সারা দিন জাতীয় পতাকা হাতে নিরন্তর ‘বাংলাদেশ-বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে মাঠ কাঁপিয়ে রাখলেন সোয়েব আলী (টাইগার সোয়েব)। সব মিলে উজ্জীবিত-অনুপ্রাণিত হওয়ার আদর্শ পরিবেশ। অনুকূল আবহাওয়া। তার রেশ ধরেই টাইগাররা উজ্জীবিত। অনুপ্রাণিত। মুশফিক, তামিম, সাকিব, মোস্তাফিজ, মেহেদী হাসান মিরাজ, সৌম্য সরকার, শুভাশিস ও তাইজুল- সবার ভেতরে একটা অন্যরকম অনুভবও সম্ভাবত জন্মেছে। ১০০ নম্বর টেস্ট একটা মাইল ফলক। একটা উৎসবের উপলক্ষ্য। উৎসবটা শুধু মাঠের বাইরে কিংবা আনুষ্ঠানিকতায় সীমিত থাকবে কেন? মাঠের পারফরম্যান্সই হতে পারে শততম টেস্টকে স্মরণীয় করে রাখার সবচেয়ে বড় স্মারক। ‘আমরা সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে চেষ্টা করে দেখি না কি হয়?’ বোঝা গেল এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে মাঠে নামা। কথায় বলে না, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। আজ মুশফিক বাহিনীর ইচ্ছাটাই যেন ভিন্ন। সবার মাঝে ভালো কিছু করার অন্যরকম তাগিদ। শরীরে অন্যরকম ফুর্তি সবার। প্রত্যেকে চাঙ্গা। ব্যাটারি চার্জ দিলে যেমন শক্তি ও কার্যক্ষমতা বেড়ে যায়, আজ টাইগারদের দেখে ঠিক তা-ই মনে হচ্ছিল। এই দলকেই গলে কেমন ফ্যাকাসে দেখিয়েছে। ভালো কিছু করার তাড়না, সংকল্পও কম মনে হয়েছে। আর আজ সবাই তেড়েফুড়ে কিছু করতে মরিয়া। ফিল্ডিংয়ে কি অন্যরকম ফুর্তি আর মনোযোগী সবাই। বোলাররা সবাই বল করলেন বুদ্ধি খাটিয়ে। নিয়ন্ত্রণটাও ছিল দারুণ। ফিল্ডিংটাও হলো চোস্ত। সারা দিনে কারো হাত থেকে একটি ক্যাচও ফসকালো না। বরং মেহেদী হাসান মিরাজ আর সৌম্য সরকার দুই দুটি নয়নলোভা ক্যাচ তালুবন্দি করলেন অসামান্য ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতায়। পেসার মোস্তাফিজ ও শুভাশিস দুই রকমের লক্ষ্য ও পরিকল্পনায় বল করলেন। কাটার মাস্টার স্লোয়ার-কাটারের মিশ্রণে বল করলেন সারা দিন। শুভাশিস লাইন ও লেন্থের ওপর জোর দিলেন বেশি। বুদ্ধিদীপ্ত টাইট বোলিংয়ের সাথে ফিল্ডিং ভালো হলে আর বাতাসে ভেসে ওঠা ক্যাচগুলো ঠিকমতো ধরতে পারলে প্রতিপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যায় অনায়াসে। আজ সারা দিন টাইগাররাও তাই করে দেখালেন। মোস্তাফিজ, মিরাজ, শুভাশিস, সাকিব-তাইজুলের সাড়াশি বোলিংয়ে সারা দিনে একবারের জন্য মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি স্বাগতিকরা। ১৩ রানে প্রতিপক্ষের উদ্বোধনী জুটি ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে যে উজ্জীবিত ও উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠা, তা আর থামেনি। দিন শেষে লঙ্কান কোচ গ্রাহাম ফোর্ডও আনুষ্ঠানিক সংবাদ সন্মেলনে অকপটে স্বীকার করলেন, ‘বাংলাদেশের বোলাররা বেশ ভালো বল করে আমাদের চাপে রেখেছে।’ লঙ্কান কোচ গলের সাথে পি সারা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের বোলিংয়ের মৌলিক পার্থক্য খুঁজে বের করেছেন। তার মূল্যায়ন, ‘গলেও প্রথম দু’সেশন বেশ ভালো বল করেছিলেন বাংলাদেশের বোলাররা। কিন্তু ভালো বলের পুরস্কারটা সেভাবে পায়নি তারা। তবে কলম্বোয় তারা আরও ভালো লক্ষ্য ও পরিকল্পনায় বুদ্ধি খাটিয়ে বল করেছে। আজকের বোলিংটা অনেক বেশী নিয়ন্ত্রিত।’ লঙ্কান কোচের কথার সুত্র ধরেই বলে দেয়া যায়, প্রথম দিন সামর্থ্যের সেরাটা উপহারে প্রাণপণ চেষ্টা ছিল বোলার, ফিল্ডার- সবার। তাইতো দিনেশ চান্দিমাল (২১০ বলে ৮৬*) একপ্রান্তে হিমালয়ের মতো অনড় থাকার পরও লঙ্কানরা চাপে। দিন শেষে রান ৭ উইকেটে ২৩৮। এনইউ/জেআইএম
Advertisement