বিশেষ প্রতিবেদন

হাজারীবাগের ‘ক্যান্সার’ ট্যানারি

চামড়া কারখানার বর্জ্যের উৎকট দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকার মানুষ। বাতাসের সঙ্গে গন্ধ ছড়িয়ে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে সেখানকার পরিবেশ। এতে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয়েরও আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, হাজারীবাগ এলাকার মানুষ শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। স্বাস্থ্যঝুঁকির এই হার দিন দিন বেড়েই চলছে। বর্জ্যের দুর্গন্ধের কারণে ট্যানারি শিল্পকে মরণব্যাধি ‘ক্যান্সার’র সঙ্গে তুলনা করেছেন স্থানীয়রা। তাই পরিবেশ ও মানুষের মৃত্যঝুঁকি এড়াতে অবিলম্বে ট্যানারি শিল্পকে সরানোর দাবি জানিয়েছেন তারা। সরেজমিনে দেখা যায়, হাজারীবাগজুড়ে সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ এবং স্যুয়ারেজ লাইনগুলো দিয়ে ট্যানারির দূষিত বর্জ্য যত্রতত্র প্রবাহিত হচ্ছে। কোথাও কোথাও দূষিত পানি সড়কে জমা হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করেছে। আর এই পানি থেকে ছড়ানো অসহনীয় দুর্গন্ধে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সেখানকার বাসিন্দারা। ট্যানারির বর্জ্যের উৎকট দুর্গন্ধে বমি আসার উপক্রম পথচারীদের। এরপরও প্রতিদিন নাক চেপে চলাচল করতে হচ্ছে স্থানীয়দের। তারা জানান, এলাকার পরিবেশ দূষিত হওয়ায় হাজারীবাগে বিকল্প বা নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না। এছাড়া ভাড়াটিয়ারাও অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। যারা আছেন তাদের বেশির ভাগই ট্যানারি শিল্পের সঙ্গে জড়িত।  রাসেল উদ্দিন নামে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ট্যানারির চামড়া প্রক্রিয়াজাত না করায় এলাকার পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্জ্য ও পানি শোধনাগার (ইটিপি বা সিটিপি) না থাকায় ট্যানারি থেকে অপরিশোধিত বর্জ্য গিয়ে সরাসরি বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। ‘আর উন্মুক্ত ড্রেন ও পর্যান্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকায় বাতাসের সঙ্গে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে এলাকার পরিবেশ বিপর্যস্ত হচ্ছে। এসব কারণে ট্যানারি শ্রমিক ও আশপাশের বাসিন্দারা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই অবিলম্বে এখান থেকে ট্যানারি শিল্প সরানো প্রয়োজন’ বলে দাবি করেন তিনি। হাজারীবাগের এই বাসিন্দা জাগো নিউজকে আরো বলেন, এখানকার প্রতিটি মানুষকে নাক চেপে চলাচল করতে হয়। তীব্র দুর্গন্ধে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এভাবে চলতে চলতে আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু নতুন কেউ এলে বমি করে দেয় রাস্তায়ই।সরেজমিনে হাজারীবাগে গিয়ে দেখা যায়, রানা বেকারি রোড, শেরেবাংলা রোড, মনিসার রোড, বীরবাস কাচড়া, গজমহল রোড, ট্যানারি এলাকা, দক্ষিণ সুলতানগঞ্জ, সোনাতনগড় (মেনেশ্বর), শিকারীটোলা, মনেশ্বর, তল্লাবাগ, মিতালী, চরকঘাটা, টালী অফিস রোড, দক্ষিণ মধুবাজার, মনেশ্বর রোড, মনেশ্বর লেন, বাড্ডানগর লেন, বোরহানপুর লেন, কুলাল মহল লেন, বেড়িবাঁধ এলাকা, কাজীরবাগ লেন, নবীপুর লেন, হাজারীবাগ লেন, হাজারীবাগ রোড, কালুনগর, এনায়েতগঞ্জ, গণকটুলী, ভাঙ্গী কলোনি, নীলাম্বর সাহা রোড, ভাগলপুর লেনসহ আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে ট্যানারির বর্জ্য। যা মানুষের ভোগান্তি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। হাজারীবাগ ট্যানার্স মোড়ের বাসিন্দা মুমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এলাকার অধিকাংশ বয়োজ্যেষ্ঠ ও শিশুরা বায়ূ দূষণজনিত নানা রোগে আক্রান্ত। এছাড়া গ্রামের বাড়ি থেকে কোনো মেহমান বাসায় এলে তারা আর থাকতে চান না। তাদের এলাকার বাইরে হোটেল বা অন্য কারো বাসায় রাখতে হয়। যা খুবই বিব্রতকর।জানা যায়, হাজারীবাগ শিল্প এলাকা থেকে দৈনিক ১৫ হাজার ৮০০ ঘনলিটার বিষাক্ত রাসায়নিক তরল বর্জ্য এলাকার উন্মুক্ত ড্রেন হয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ে। আর শুধু ট্যানারি থেকে প্রতিদিন নির্গত হয় ১৯ টন অদ্রবণীয় কঠিন বর্জ্য। যার মধ্যে রয়েছে পচনশীল লেদার কাটিং, ক্লোশিং লোম, রক্ত, সোডিয়াম সালফেট, ক্রোমিয়াম অক্সাইড, তেল, গ্রিজ জাতীয় পদার্থ ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত পানিসহ শতাধিক রকমের কেমিক্যাল।  এভাবে পরিবেশ দূষিত হলেও ট্যানারি শিল্পের সঙ্গে জড়িত স্থানীয়রা বললেন ভিন্ন কথা। শেরে বাংলা রোডের কেমিক্যাল ব্যবসায়ী শাহজাহান মিয়া বলেন, ট্যানারি হাজারীবাগের ঐতিহ্য। এই শিল্পের সঙ্গে শত শত পরিবার জড়িত। এলাকার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মূলত মানুষ উপকৃত হচ্ছে। ‘আমরা থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কোনো সমস্যা হয় না। তবে যারা নতুন আসে তাদের প্রথম প্রথম খারাপ লাগে’- যোগ করেন তিনি।ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক জাগো নিউজকে বলেন, পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে সবাই জানে। এলাকার বাতাসে গন্ধ রয়েছে। এই নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সিটি করপোরেশন, ঢাকা জেলা প্রশাসন, র্যা ব-পুলিশ ও পরিবেশ অধিদফতরসহ সরকারের সংস্থাগুলো অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সর্বশেষ বিষয়টি আদালতে পর্যন্ত গড়িয়েছে। আদালত থেকেও হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) স্থানীয় কাউন্সিলর জাগো নিউজকে বলেন, পরিবেশ দূষণ তো যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। বিষয়টি যেহেতু আদালতের, তাই এই বিষয়ে বেশিকিছু বলতে চাই না। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ট্যানারির বর্জ্য মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ করছে। আমরা সড়কে থাকা বর্জ্যগুলো অপসারণ করছি। কিন্তু ওই এলাকার স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে কেমিক্যালযুক্ত যে পানি যাচ্ছে তা দেখভালের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ট্যানারি মালিকদের, আমাদের নয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল মতিন বলেন, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী এখনো অনেক ট্যানারি স্থানান্তরিত হয়নি। ট্যানারিও রয়ে গেছে, এলাকার সমস্যাও রয়ে গেছে। ট্যানারির কারণে এলাকার সর্বস্তরের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু মানুষ নয়, এলাকার সার্বিক পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। দুর্গন্ধ ও দূষিত বায়ূর কারণে গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতিও মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী যত দ্রুত সম্ভব ট্যানারিগুলো স্থানান্তরের দাবি জানান তিনি।     এমএসএস/এমএআর/এমএস

Advertisement