নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত। স্থানান্তরের জন্য আদালতের নির্দেশনা মিলেছে কয়েকবার। মন্ত্রীও কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। সচিব বৈঠক করেছেন দফায় দফায়। নির্দেশ না মানায় জরিমানাও বেঁধে দিয়েছিলেন আদালত। জরিমানা দেয়ার ক্ষেত্রেও ছিল গড়িমসি। স্থানান্তরের পক্ষে সোচ্চার পরিবেশবাদী, সাধারণ মানুষও। রাষ্ট্র, আদালত, জনমত- সবই রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো স্থানান্তরের পক্ষে। তবুও অদৃশ্য শক্তির বলে ট্যানারিগুলো এখনও রয়ে গেছে সেখানে। রাজধানীর অদূরে সাভারে প্লট বরাদ্দ দেয়া হলেও সেখানে যাননি ট্যানারির মালিকরা। প্রশ্ন উঠেছে, কার ইশারায় আদালতের রায়কে বারবার উপেক্ষা করা হচ্ছে? কোন সিন্ডিকেটের বলে ট্যানারির মালিকদের এমন দৌরাত্ম্য? আদালতের সর্বশেষ রায়ের বাস্তবায়ন আদৌও হবে কী? নাকি রাষ্ট্র নিজেই আগের মতো নমনীয় হয়ে অসহায় আত্মসমর্পণ করবে ট্যানারি সিন্ডিকেটের কাছে?সোমবার দুপুরে আদালতের রায় নিয়ে ‘ক্রিসেন্ট ট্যানারি’র সামনে চায়ের দোকানে বসে আলাপ করছিলেন কয়েকজন। ট্যানারির শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপে অংশ নিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। তাদেরই একজন হাজি রহমত আলী। আদালতের রায় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলেন, ‘আদালতের রায় মিলেছে সেই ২০০৯ সালে। এরপর পাল্টাপাল্টি রায় আর আবেদনের খেলাই চলেছে। এর শেষ কোথায় তা আমরা জানি না। আদৌও ট্যানারি সরবে কিনা, তা বলতেও পারি না। এখানে রাষ্ট্র বড়ই অসহায়।’ ‘হাজারীবাগেই জন্ম’ উল্লেখ করে রহমত আলী বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে এখানেই বেড়ে উঠেছি। ব্যবসার তাগিদে অন্য দেশেও গেছি। একটি শহরের মধ্যে এমন কারখানা বাংলাদেশেই সম্ভব। বিশেষ বাস্তবতায় এখানে কারখানা গড়ে উঠলেও দিন তো বদলেছে। বাস্তবতাও বদলেছে। বাস্তবতার কারণে এখান থেকে কারখানা সরানোর দাবি উঠেছে। কিন্তু বিশেষ সিন্ডিকেটের কাছে আদালতের রায়ও উপেক্ষিত। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে সরকারের ভেতরের লোকই জড়িত।’ প্রসঙ্গত, ১২ মার্চ রাজধানীর হাজারীবাগে থাকা ট্যানারিগুলো অবিলম্বে বন্ধ করতে এবং বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হাইকোর্টের দেয়া আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন।সূত্র মতে, ১৯৮৬ সালে ১৭৬ ট্যানারিকে দূষণরোধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয় সরকার। ২০০৩ সালে সাভারে চামড়া শিল্পনগর প্রকল্প শুরু হয়। ২০০৮ সালে নির্দেশ আসে, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে সরাতে হবে ট্যানারি। ২০১০ সালে হাইকোর্টে দুই বছর সময় বৃদ্ধির আবেদন করে সরকার। ২০১১ সালে পরিবেশমন্ত্রী সংসদে জানান, ট্যানারি সরবে ২০১২ সালে। ২০১৬ সালের ১০ জানুয়ারি ৭২ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন শিল্পমন্ত্রী। ওই বছরের ১ এপ্রিল ফের সাতদিন সময় দেয়া হয়। এরপর ১৮ জুলাই দিনে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানার নির্দেশ দেন সুপ্রিম কোর্ট। ১৬ অক্টোবর, ট্যানারি স্থানান্তরে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়।চলতি বছরের ১ জানুয়ারি আরো এক মাস সময় বাড়িয়ে দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। ৬ মার্চ হাজারীবাগে থাকা চলমান সব ট্যানারি অবিলম্বে বন্ধ করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে আইন অনুসারে এসব কারখানার বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগসহ সব সেবা বিচ্ছিন্ন করতে নির্দেশ দেয়া হয়। হাইকোর্টের এই আদেশ স্থগিত চেয়ে ৯ মার্চ আবেদন করেন বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান।১২ মার্চ আবেদন খারিজ করে দিয়ে উচ্চ আদালতের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। ট্যানারি স্থানান্তরে হাইকোর্টে আবেদনকারীদের পক্ষের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আপিল বিভাগের এ আদেশের ফলে ট্যানারিগুলো বন্ধ করতেই হবে। আদালতের এমন রায়ে আর কোনো জটিলতা থাকল না। ট্যানারি শ্রমিক ইউনিয়নেরে সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরাও চাই ট্যানারি কারখানাগুলো অবিলম্বে এখান থেকে সরে যাক। রাষ্ট্র, আদালতের রায়- সবাইকে মানা উচিত। তবে যে জটিলতার কারণে হেমায়েতপুরে যেতে পারছে না কারখানাগুলো, সেদিকেও সরকারকে নজর দিতে হবে।’ পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়ে তোলার জন্য যা করা দরকার, তা অবিলম্বে করার দাবি জানান তিনি। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নই। আদালতের রায় মানতে আমরা বাধ্য। কিন্তু আমাদের দিকটাও বিবেচনা করা দরকার। নতুন জায়গায় এখানো গ্যাসের সংযোগ হয়নি। কাজের পরিবেশ তৈরি হয়নি। কোটি কোটি টাকার শিল্প নিয়ে আমরা তো পথে বসতে পারি না।’এমএআর/আরআইপি
Advertisement