মতামত

আপনি কি নাইস?

ধরুন কেউ আপনাকে বলল, ‘অমুক রেস্টুরেন্টের খাবার খুব নাইস’ অথবা ‘অমুক ছায়াছবিটা বেশ নাইস’ অথবা ‘অমুক বইটা খুব নাইস’। এই মন্তব্যগুলো শুনে উল্লেখিত রেস্টুরেন্ট, ছায়াছবি, অথবা বই সম্পর্কে কি আপনি খুব আগ্রহী হয়ে উঠবেন? ছুটে গিয়ে খেয়ে, দেখে, অথবা পড়ে নিতে মন ব্যাকুল হয়ে উঠবে? এই অভিজ্ঞতাগুলো নিতে না পারলে জীবনকে বৃথা মনে হবে? নিশ্চয়ই না, কারণ ‘নাইস’ শব্দটি কোনো কিছুর সম্পর্কেই আপনার মনে একটা আলোড়ন জাগাতে সক্ষম হয় না, আপনার চোখের সামনে একটা স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরতে পারে না। তারপরও এই শব্দটি অহরহ ব্যবহার করে চলেছি আমরা। আজ ভোরে কাজে যাবার পথে গাড়িতে রেডিও শুনছিলাম। ‘নাইস’ শব্দটি নিয়ে একটা ভিন্নধর্মী আলোচনা শুনে এই নিয়ে কিছু লেখার পুরোনো ইচ্ছেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।  বাংলাভাষার পাঁচ প্রকার শব্দের মধ্যে একটা হলো ‘বিদেশি শব্দ’। নানান ঐতিহাসিক এবং বিবর্তনমূলক কারণে অন্যান্য ভাষার প্রচুর শব্দ বাংলায় শুধু ঢুকেইনি বরং এতোটাই গেড়ে বসেছে যে এসব শব্দ ছাড়া বাংলা ভাষাকে এখন কল্পনাই করা যায় না। ‘স্কুল’, ‘কলেজ’, ‘ইউনিভার্সিটি’, ‘চেয়ার’ এসবের বাংলা প্রতিশব্দের চেয়ে এই বিদেশি শব্দগুলোকেই এখন অনেক বেশি আপন মনে হয়। কিছুদিন আগে আমার স্বামীর কাছে জানলাম চার্চের বাংলা শব্দ গীর্জা মূলত বাংলা নয়, বরং পর্তুগীজ।  এরকম আরো ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে।  ভাষা একটা পরিবর্তনশীল এবং গতিময় বিষয় যা পরিবর্তনের মাধ্যমেই সম্মৃদ্ধতর হয়ে উঠে, কাজেই বিদেশি শব্দের ব্যবহার নিয়ে আমার কোনো এলার্জি নেই, কিন্তু উড়ে এসে জুড়ে বসা কিছু শব্দ আমাকে খুব যন্ত্রণা দেয় কারণ জুড়ে বসলেও এদের অবস্থানটা কেন যেন ঠিক জুতসই নয়। এরকমই একটা শব্দ হচ্ছে ‘নাইস’। আমার প্রশ্ন হলো ‘নাইস’ শব্দটা আসলে কতটুকু নাইস?  আমি যখন ছাত্রদের বর্ণনামূলক রচনা লিখতে শেখাই তখন প্রথমেই বলি, কোনো কিছুর বর্ণনা দিতে  গিয়ে কখনো ‘নাইস’ শব্দটা ব্যবহার করবে না। এটা হচ্ছে বহু ব্যবহারে জীর্ণ, রসকষহীন একটি বিশেষণ যা পড়ে একটা বস্তুর গুণাবলী সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণাই পাওয়া যায় না, এবং মনে হয় বর্ণিত বস্তুটি সম্পর্কে বর্ণনাকারীর তেমন কোনো অনুভূতি বা মতামত নেই, আর থাকলেও ‘নাইস’ শব্দটির ব্যবহার তার প্রকাশকে দমিয়ে রাখে। বিলেতে বোধ হয় এটাই সর্বাধিক ব্যবহৃত বিশেষণ অথচ গুগলে ‘কমন এডজেক্টিভ’ অনুসন্ধান করলে এটা আসবে না। সম্ভবত যারা এসব শব্দ-তালিকা বানান তারাও এই শব্দটি নিয়ে বিব্রত। Entrepreneurs নামে একটি পোর্টালে  নাটালি সিসন নামে এক লেখক এই বিষয়ে বিশদ একটি নিবন্ধ লিখেছেন যেখানে ‘নাইস’ শব্দটির প্রতি তার তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে। তার দাবি হলো ইংরেজি ভাষা থেকে এই শব্দটিকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দিতে হবে। একটু বাড়াবাড়ি রকমের দাবি বটে, কিন্তু আমি তার বিরক্তির জায়গাটা বুঝতে পারি। সহজ কথা সহজে বলতে পারা যেমন চমৎকার একটা ব্যাপার, তেমনি সহজের সীমার ভেতরে থেকেই ভাষায় কিছুটা বৈচিত্র্য আনতে পারাও কাম্য। নাটালির মতে, মানুষ দিনে দিনে এতো অলস হয়ে পড়েছে যে তারা একটা অনুভূতিকেও সুন্দরভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা করতে অনিচ্ছুক। ভাষার অসাধারণ ক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করছে এরা।  এই শব্দ-যুদ্ধে নাটালি কিন্তু একা নন, বেশির ভাগ ভাষা শিক্ষকরা একই মত পোষণ করেন, এবং তার লেখায় মন্তব্যগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছে নাটালি এই বিষয়ে অনেকেরই সমর্থন পেয়েছেন।  ‘নাইস’ শব্দটিকে ভাষার জগত থেকে উপড়ে ফেলে দেয়ার ব্যাপারে আমি নাটালির সাথে একমত নই, কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই শব্দের ব্যবহারের প্রয়োজন আছে বলেই আমার মনে হয়। যেমন ধরুন, কারো সাথে আপনার এইমাত্র পরিচয় হয়েছে, তাকে ‘আয়াম এক্সাইটেড টু মিট ইউ’ বলাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ‘নাইস টু মিট ইউ’ বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। আবার কোনো মানুষ সম্পর্কে, যার  প্রতি আপনার তীব্র ভালোলাগা নেই অথচ যাকে অপছন্দও করেন না, ‘হি ইজ কোয়াইট নাইস’ জাতীয় কিছু বলাটাই স্বাভাবিক। এসব ক্ষেত্রে এই শব্দের ব্যবহারে আমি কোনো সমস্যা দেখি না। কিন্তু যত্রতত্র ‘নাইস’ বলে প্রশংসার কাজ চালিয়ে দেয়াকে আমি দূষণীয় বলে ভাবি। যেক্ষেত্রে আপনার ভালোলাগার মাত্রাটা আসলেই অনেক বেশি, সেক্ষেত্রে কেন আপনি আরো বেশি অভিব্যক্তিপূর্ণ একটি শব্দ ব্যবহার করবেন না? বিলেতে কিন্তু লেখালেখিতে এই শব্দের ব্যবহার খুব কম, এবং কথাবার্তায়ও যারা অনেক চৌকস তারা এই শব্দটা তেমন একটা ব্যবহার করেন না।  অথচ আমরা ভাবি, ‘নাইস’ বললে সাংঘাতিক প্রশংসা করা হলো। ফেসবুকে একটা তথ্যবহুল বা আকর্ষণীয় পোস্ট পড়েও অনেকে মন্তব্য করেন: ‘নাইস’। ফেসবুকে কষ্ট করে মন্তব্য করার ঝক্কি পোহানোর মানেই হলো পোস্টটা আপনার অনেক ভাল লেগেছে, তাহলে এই কার্পণ্য কেন? ‘নাইস’ থেকে বেশি কিছু বলার না থাকলে মন্তব্য না করাই ভাল, তাই না? যা’ই হোক আমার, নাটালির, আর অন্যান্য ভাষা-শিক্ষকদের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও ‘নাইস’ শব্দটি আমাদের জীবনে বোটকা গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং যেতে থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস। বিশ্বায়নের ফলে বিভিন্ন নতুন ধ্যান-ধারণার সাথে প্রতিনিয়ত পরিচিতি ঘটছে আমাদের, ফলে নতুন নতুন বিদেশি শব্দের ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে অনেক বিষয়ে প্রাণখুলে আলোচনা করার জন্য বাংলায় জুতসই শব্দ নেই। এসব ক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দের ব্যবহারে কারোই আপত্তি থাকার কথা নয়। আমার আপত্তির জায়গাটা হলো: অবজ্ঞার সাথে যে ইংরেজি শব্দকে ইংরেজ সমঝদাররা ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন, তারই অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারে কেন এতোটা অভ্যস্ত হয়ে উঠছি আমরা? আমাদের নিজেদের শব্দ ভাণ্ডার কি এতোই দুর্বল? যদি তা’ই হয়ে থাকে, যদি বাংলায় জোর করে ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে কথা বলার এবং লেখার চাহিদা আমাদের থেকে থাকে, তাহলে ইংরেজি ভাষায় চমৎকার সব বিশেষণগুলো শিখছি না কেন আমরা? যেমন- ‘খাবারটা আউট অফ দিস ওয়ার্ল্ড ছিল’। ‘সিনেমাটা অসম্ভব ফেসিনেটিং এবং ফুল অফ সাসপেন্স ছিল’। ‘আমার নতুন শিক্ষক খুব উইটি আর হিউমারাস একজন মানুষ’।  যাক, অনেক কঠোর কথা বললাম। বিদায় নেবার আগে কিছু ‘নাইস’ কথা বলে যাই। আমাদের ধারণা ভাল মানুষদের ভাত নেই, তারা কখনো সফল হয় না। আজ সকালে বিবিসি রেডিওতে এই বিষয়ে  একজন মনোবিজ্ঞানীর গবেষণার ফলাফলের কথা শুনছিলাম। তার মতে যারা অন্যের আবেগ, মতামত ও সুখ-দুঃখ কে শ্রদ্ধা করেন ও গুরুত্ব দেন এবং প্রয়োজনে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করেন তারাই মানুষ হিসেবে ‘নাইস’ এবং তিনি গবেষণার মাধ্যমে দেখেছেন এ ধরনের মানুষের জীবনে সাফল্য অর্জন করার সম্ভাবনা বেশি কারণ তারা সবসময় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করেন যা তাদের সফলতার পথকে মসৃণ করতে সাহায্য করে। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ, বহুল বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব ট্রাম্পের উদাহরণ টেনে এই মনোবিজ্ঞানীর গবেষণাকে উড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। আবার বিল গেটস, স্টিভ জবস, ডেভিড বেকহাম, এঞ্জেলিনা জলি’র মত ভালোবাসা-সিক্ত সফল মানুষদের কথা ভেবে তার কথা মেনেও নেয়া যেতে পারে। সর্বোপরি, যে তত্ত্ব আমাদেরকে মানুষ হিসেবে ‘নাইস’ হতে উদ্বুদ্ধ করে তা মেনে নিতে বাধা কোথায়? আফটার ওল, হোয়াট হ্যাভ উই গট টু লুজ?  লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী শিক্ষক, অনুবাদক, ও নাট্যকর্মী।এইচআর/এমএস

Advertisement