খেলাধুলা

সাফল্যের গলে এবার ব্যাটিং বিভীষিকা!

শেষ দিন ৯৮ ওভার ক্রিজে কাটিয়ে দিতে পারলেই ম্যাচ ড্র। হাতে ১০ উইকেট। পঞ্চম দিনের খেলা হলেও উইকেট মোটামুটি ঠিকই আছে। ভাঙেনি। বল পরে হঠাৎ লাফিয়েও উঠছে না। বিপজ্জনকভাবে নিচু হয়েও আসছে না। বাড়তি টার্নও নেই। আগের চারদিন যেমন ছিল, অনেকটা সেরকমই আছে। এমন ব্যাটিংবান্ধব পিচে শেষ দিন ব্যাটিং করা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। মাস দুয়েক আগে ওয়েলিংটন ও ক্রাইস্টচার্চে এর চেয়ে প্রতিকূল কন্ডিশন আর কঠিন উইকেটে ধারালো কিউই বোলিংয়ের বিরুদ্ধে যাদের বুক চিতিয়ে লড়ার রেকর্ড আছে, তারা আজ (শনিবার) সারা দিন পার করে দিতে পারবে এমনটাই ছিল সবার ধারণা। কিন্তু হায়! ভাবনা একরকম। আর বাস্তবে হলো অন্য রকম। গলের যে আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে চার বছর আগে রচিত হয়েছিল টেস্টে সাফল্যের হীরকখচিত ইতিহাস। সেই গলে এবার নতুন ইতিহাস গড়া এবং ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটানো বহুদূরে, গল এবার বিভীষিকার মাঠ হয়ে থাকল। বিনা উইকেটে ৬৭ রান নিয়ে খেলতে নেমে শেষ দিন আড়াই ঘণ্টায় ১৩০ রানে ১০ উইকেট হারিয়ে বসে ২৫৯ রানের বড় হারের লজ্জা এসে গ্রাস করলো।চরম বাজে, শ্রী ও দায়িত্বহীন ব্যাটিংয়ের নগ্ন প্রদর্শনী হলো আজ। এমন কোনো বোলিং হয়নি। উইকেটের চরিত্র ও আচরণেও বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেনি।তিন লঙ্কান স্পিনার রঙ্গনা হেরাথ, দিলরুয়ান পেরেরা ও লক্ষণ সান্দাকানের বোলিংয়েই সব শেষ। চোখে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছিল না এই তামিম, মুশফিক ও সাকিবরাই বিশ্বের অনেক বাঘা বাঘা বোলারের বিরুদ্ধে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। বিগ হান্ড্রেডে মাঠ মাতিয়েছেন।সবচেয়ে বড় কথা, বিভীষিকার শুরু এক অনিয়মিত অফস্পিনার করুনারত্নের বোলিংয়ে। গতকাল (শুক্রবার) চতুর্থ দিন পড়ন্ত বিকেলে বৃষ্টিতে খেলা বন্ধের আগে তিনি এক বল করেছিলেন কিন্তু বলটি ‘নো’ হওয়ায় আজ সকালে পুরো ৬ বল করার সুযোগ পেয়ে যান গুনারত্নে। কে জানত সেই ওভারটিই হবে দিনের সবচেয়ে আলোচিত ওভার!তার আগে একটু আগের দিন করা একমাত্র ডেলিভারির কথা বলে নেয়া যাক। অফস্টাম্পের সামান্য বাইরের বল দেখেই চালিয়ে ছিলেন সৌম্য। একটু ধীরগতিতে বল ভিতরে এসে তার ব্যাটের ভিতরের কানায় লেগে স্ট্যাম্পের ওপর দিয়ে চলে যায়। সৌভাগ্যক্রমে একটি সিঙ্গেল পান সৌম্য। আজ দিনের প্রথম ডেলিভারিতেও আউট হয়ে যেতে পারতেন সৌম্য। অফস্টাম্পের সামান্য বাইরে ফ্লাইটেড ডেলিভারি। পড়ল গুড লেন্থে। সৌম্য দ্বিধায় ছিলেন, সামনে না পিছনে খেলবো। প্রথমে মনে করলেন পিছনের পায়ের ওপর ভর করে ফ্ল্যাশ করবো। যখন দেখলেন, বল ততটা শর্ট অফ লেন্থের না, তখন শট চেক করতে গেলেন। বল ব্যাটের ভিতরে লেগে চলে গেল শর্ট লেগে  দাঁড়ানো ফিল্ডারের ঠিক পাশ দিয়ে। ঐ ডেলিভারিতে ক্যাচ আউটের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া সৌম্য ঠিক পরের বলেই আউট। সেটাও এক বিস্ময়! গুড লেন্থ অফস্পিন। পিচ পড়লো অফ-মিডলে। সৌম্য পা না নিয়ে জায়গায় দাঁড়িয়ে হাফ কক খেলতে গেলেন। আদর্শ অফ ব্রেক, বল ব্যাট ও প্যাডকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল পিছনে। যাবার সময় যে বেলস চুমে গেল, সৌম্য তা টেরই পাননি। বল যে সোজা বেলসে গিয়ে আঘাত হেনেছে, তা টেরই পাননি। ভেবেছিলেন আম্পায়ার বুঝি কট বিহান্ড দিয়েছেন। তা ভেবে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা। পরে যখন দেখলেন, বেলস পড়ে গেছে, তখন ধীরে ধীরে সাজঘরের পথে। আগেরদিন শতভাগ আস্থা ও আত্মবিশ্বাসে খেলে রাতটুকু পার করে পরদিন সকালে অমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অ্যাপ্রোচ! ভাবা যায়! এরপরের শিকার মুুিমনুল হক। যাকে ভাবা হয় টেস্টে বাংলাদেশের এক নম্বর ব্যাটসম্যান। কিন্তু শুধু টেস্ট দলে থাকতে থাকতে এ যুবার কেমন যেন আস্থা ও আত্ববিশ্বাস কমে গেছে । উইকেটে এসে সামনের পায়ের উপর ভর করে চমৎকার এক অফড্রাইডে বাউন্ডারি হাকিয়ে রানের খাতা খুললেন। মনে হলো শতভাগ আস্থা ও আত্ববিশ্বাস ভিতরে। এরপর যেই না স্পিনের মুখোমুখি হওয়া, সেই থেকে খানিক নিষ্প্রভ হয়ে পড়া। অফস্পিনার পেরেরার বলে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে জড়িয়ে পড়া। মিডল স্টাম্পের ওপর পিচ পড়া ডেলিভারিটি সোজা হয়ে আসলো। মুমিনুল ঠিক পা নিব কি নেবো না করে নিতে পারলেন না। বল গিয়ে আঘাত হানলো পিছনের পায়ে। মুমিনুলের ধারণা তিনি এলবিডব্লিউ নন। ননস্ট্রাইকে দাঁড়িয়ে থাকা তামিম ইকবাল তাকে রিভিউ নিতে না করলেন। কিন্তু মুমিনুল নিজ গরজেই রিভিউ নিলেন। কিন্তু রিভিউ নিয়ে যেটা করলেন, তা আরও বিস্ময় জাগানিয়া। থার্ড আম্পায়ার যখন রিভিউ করছেন ততক্ষণে মুমিনুল প্রায় হেঁটে মাঠের শেষ প্রান্তে চলে এসেছেন। পরে রিভিউতে পরিষ্কার হলো, বল ব্যাটে লাগেনি। পিচ পড়া এবং উইকেট সোজাই ছিল। সিদ্ধান্ত সঠিক। মুমিনুল আউট।এরপরের শিকার তামিম ইকবাল। এ বাঁহাতির উইকেটও জমা পড়ল অফস্পিনার পেরেরার ঝুলিতে। ঠিক অফস্ট্যাম্প বরাবর গুড লেন্থ ডেলিভারি। তামিমের না খেলে উপায় ছিল না। কিন্তু তার প্রত্যাশার চেয়ে শার্প টার্ন হল। বল ব্যাটের বাইরের কোনা ছুঁয়ে চলে নিচু হয়ে দ্রুত চলে গেল স্লিপে। প্রথম স্লিপে দাঁড়িয়ে থাকা ফিল্ডার গুনারত্নে খুব দক্ষতা ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে মাটির ঠিক ওপর থেকে তা ধরে ফেলে তামিমকে ( ৫৫ বলে ১৯) সাজঘরে পাঠান।তারপর আরেক বাঁহাতি সাকিবের বিদায়। দলের প্রয়োজনে মাথা নিচু করে রক্ষণাত্মক মেজাজে খেলার চেষ্টাই করেছিলেন। কিন্তু বলের ঠিক পিছনে শরীর ও পা নিয়ে খেলার অভ্যাস কম বলে শুরুতে অফস্পিনার পেরেরার বলে বেঁচে গেলেন কোন রকমে। বল স্লিপ ফিল্ডারের পাশ দিয়ে চলে গেল সীমানার ওপারে। শেষ পর্যন্ত মাত্র ৮ রানে ফিরে আসা। লঙ্কান অধিনায়ক রঙ্গনা হেরাথের ভাল জায়গায় পিচ পড়া টার্নিং ডেলিভারি। সাকিব ফরোয়ার্ড খেলতে গেলেন। কিন্তু ব্যাট সোজা ছিল না। টার্নে বল চলে গেল শর্ট লেগে। অসামান্য ক্ষিপ্রতা, চপলতা ও দক্ষতায় মাটিতে শরীর ফেলে তা ধরে ফেললেন করুনারত্নে। ঠিক দুই বল পর পতন ঘটল পঞ্চম উইকেটের। প্রথম বলটি রক্ষণাত্মক মেজাজ ও ঢংয়ে শর্ট কভারে খেললেও ঠিক পরের বলেই আউট মাহমুদউল্লাহ। শুধু মাত্র স্লথ গতির কারণে এলবিডব্লিউ হলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। এবারো বোলার রঙ্গনা হেরাথ। উইকেট সোজা ডেলিভারিতে ঠিক যতটা দ্রুত শরীর ও বাঁ-পা সামনে এনে ডিফেন্স করা উচিৎ, খানিক দ্বিধাগ্রস্ত মাহমুদউল্লাহ তার কিছুই করতে পারলেন না। বল গিয়ে আঘাত হানলো পিছনের প্যাডে। ০ রানে ফিরে গেলেন মাহমুদউল্লাহ। বিভীষিকাময় ১ ঘণ্টা! মাত্র ৪৬ রানে আউট পাঁচ পাঁচজন ব্যাটসম্যান। এরপর অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম আর কিপার লিটন দাস মিলে লাঞ্চের আগে সোয়া ঘন্টা সময় কাটিয়ে মৃদু আশা জাগালেন। কিন্তু লাঞ্চের পর আবার সেই বিভীষিকাময় ব্যাটিং। মধ্যাহ্নবিরতির পর খেলা শুরু হতেই ঠিক দ্বিতীয় বলে আউট অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম। এবার বোলার বাঁহাতি চায়নাম্যান সান্দাকান। লেগস্ট্যাম্পের এক ফুট বাইরের বলকে তাড়া করতে গেলেন অধিনায়ক। কেন গেলেন? কি দরকার ছিল ওই শট খেলার? তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। এটা ওয়ানডে হলেও কেউ খেলতো না। কারণ বলটি নির্ঘাত ওয়াইড হতো।  অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম (৩৫) সই বলের পিছনে তাড়া করে উইকেট বিষর্জন দিলেন। আর এরই সঙ্গে শেষ হলো মৃদু সম্ভাবনারও। অধিনায়ক চলে যাবার পর মিরাজকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই না চালিয়ে কিপার লিটন দাস (৩৪) গেলেন অপ্রয়োজনে বিগ হিট নিতে। তাতেই আকাশে তুলে বিদায় নেয়া। এভাবেই বিভীষিকাময় একদিন হয়ে থাকলো ২০১৭ সালের ১১ মার্চ। এআরবি/এমআর/আরআইপি

Advertisement