খেলাধুলা

জয়সুরিয়ার সঙ্গে খানিকক্ষণ

গল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের তিনতলার পুরোটা মিডিয়ার জন্য বরাদ্দ। দু দুটি সুন্দর ছিমছাম প্রেস বক্স। একটি শ্রীলঙ্কার সাংবাদিকদের জন্য। অন্যটিতে বিদেশি সাংবাদিকরা বসেন। যেটা এখন বাংলাদেশি সাংবাদিকদের হয়ে গেছে। ঐ দুই প্রেস বক্সের মাঝখানে টিভি, রেডিও ধারাভাষ্য কক্ষ। সবগুলো কক্ষই বেশ সাজানো গোছানো। একটি রুম কেবল ভিন্ন। যেখানে প্রচার মাধ্যমের কারো বসার অধিকার নেই। স্পষ্ট লেখা ‘শ্রীলঙ্কান ন্যাশনাল সিলেক্টরস রুম।’ কাঁচ ঘেরা সেই ভবনে আজ সকাল থেকে বসা একজন `সানাৎ জয়সুরিয়া`। নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো বিশেষণ এক সঙ্গে চলে আসে। একজন ক্রিকেটার। আদর্শ অলরাউন্ডারের প্রতিমূর্তি। হার্ডহিটিং ও ড্যাশিং ওপেনার। রাজার খেলা, খেলার রাজা আর প্রথাগত, ব্যাকরণ সম্মত এবং শৈল্পিক ও নান্দনিকতার খেলা ক্রিকেটে শুধু উত্তাল উইলোবাজি করেও যে জগত বিখ্যাত হওয়া যায় শ্রীলঙ্কার সানাৎ জয়সুরিয়া তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ব্যাট ছিল যেন খোলা তরয়ারি। প্রথাগত, ব্যাকরণ সম্মত এবং ক্রিকেটীয় ব্যাটিং যারা পছন্দ করতেন, তাদের হয়তো তেমন ভালো লাগতো না। কিন্তু আম জনতার ফাস্ট চয়েজ ছিলেন এ লঙ্কান ফ্রি স্ট্রোক মেকার। ব্যাকরণ না মেনে নিজের মত করে খেলতেই পছন্দ করতেন বেশি। বেশির ভাগ সময় ঠিক ব্যাকরণ মেনে বলের পিছনে শরীর ও ডান পা না নিয়ে খানিকটা দূর থেকে নিজের খেয়াল খুশি মত ব্যাট চালাতেন। কিন্তু অসীম সাহস, অসামান্য রিফ্লেক্স আর চপলতার জন্য ঠিক বলকে ব্যাটের মাঝখানে আনতে পারতেন। তাইতো জয়সুরিয়ার ব্যাটে লাগা মাত্র অনেক বাঘা বাঘা বোলারের সমীহ জাগানো ডেলিভারিও মুড়ি মুড়কির মত উড়েে সীমানার ওপারে আছড়ে পড়তো। প্রতিপক্ষ বোলার ও ফিল্ডারের মাথা ব্যথার কারণ এ আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান ক্যারিয়ারের প্রায় পুরো সময় ছিলেন বোলারদের মাথা ব্যথার কারণ। একদিনের সীমিত ওভারের ফরম্যাটে যখন প্রথম ফিল্ডিং বিধিবদ্ধতা আসলো, (শুরুতে ১৫ ওভার পরে ১০ ওভার), তখন জয়সুরিয়া আর কালুভিথারানার উত্তাল উইলোবাজি, ফ্রি স্ট্রোক প্লে আর ৩০ গজের ফিল্ডারের মাথার ওপর দিয়ে অনায়াসে তুলে চার-ছক্কা হাঁকানো ছিল রীতিমতো দেখার বিষয়। ১৯৯৬ সালে অর্জুনা রানাতুঙ্গার সুযোগ্য নেতৃত্ব আর অরবিন্দ ডি সিলভার অসাধারণ ব্যাটিং সত্বেও শ্রীলঙ্কার প্রথম বিশ্বকাপ জয়ে জয়সুরিয়ার অবদান অনেক। তাই তিনি লঙ্কান ক্রিকেটের ‘সোনার ছেলে।’ ১৯৬৯ সালের ৩০ জুন মাতারায় জন্ম নেয়া এ কালজয়ী ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু ১৯৮৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ওয়ানডে দিয়ে। টেস্ট অভিষেক তারও দুই বছর পর ১৯৯১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী হ্যামিল্টনে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। আর ক্রিকেটকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানিয়েছেন ২০১১ সালে ২৮ জুন ওভালে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ওয়ানডে দিয়ে। কিন্তু ক্রিকেটের সঙ্গে যার নাড়ির সম্পর্ক তিনি কি আর ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে পারেন? জয়সুরিয়াও পারেননি। ক্রিকেটের টানেই ফিরে এসেছেন আবার ক্রিকেটে। খেলা ছেড়ে ২০১৩ সালে লঙ্কান ক্রিকেটে প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব নেন। বছর খানেক ঐ গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন থেকে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। শ্রীলঙ্কার সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন। তারপর এক সময় মনে হলো নাহ, রাজনীতি আমার জায়গা নয়। আমার ভুবন ক্রিকেট। তাই আবার ক্রিকেটে ফেরা। আবার শ্রীলঙ্কার প্রধান নির্বাচক হওয়া। জয়সুরিয়ার মত এক ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব হাত মেলানো দূরত্বে, বাংলাদেশের মিডিয়া বসে থাকবে? নিশ্চয়ই না। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার চলতি সিরিজ কাভার করতে যাওয়া সাংবাদিকরা নেমে পড়লেন জয়সুরিয়ার সাক্ষাৎকার নেয়ার মিশনে। প্রথমে না না করলেও পরে ঠিক সময় দিলেন। তাও একবারে নয়। প্রিন্ট, অনলাইন ও টিভি মিডিয়া দুই বহরের সঙ্গে আলাদা কথা বললেন জয়সুরিয়া। প্রথমে টেলিভিশন চ্যানেলের বন্ধুরা কথা বললেন। পরে টিভিতে ইন্টারভিউ শেষে ঠিক সিলেক্টরদের নির্ধারিত কক্ষের বাইরে দাড়িয়ে প্রিন্ট ও অনলাইন সাংবাদিকদের সঙ্গেও মিনিট সাতেক একান্তে কথা বললেন লঙ্কান ক্রিকেট তথা বিশ্ব ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তী। একদমই সাদা মাটা পোশাক আশাক, হালকা আকাশী ফুল শার্ট আর জিন্স প্যান্ট পড়নে। কথা বার্তায় যেন বিনয়ের অবতার। নিচু স্বরে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিলেন গুছিয়ে। অনেক কথা, নানা প্রসঙ্গ ও প্রশ্ন উঠল। তার দীর্ঘ ক্যারিয়ার কেমন কেটেছে? নিজের অর্জন প্রাপ্তিতে কতটা তৃপ্ত, কোন অতৃপ্তি-অপ্রাপ্তি আছে কিনা? বর্তমান দায়িত্বটা কেমন উপভোগ করছেন। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের ভবিষ্যত এসব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে উঠে এসেছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও। এখানেই শেষ নয়, ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট খেলতে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানের হয়ে খেলা এবং মোহামেডানের অন্যতম শীর্ষকর্তা মাহবুব আনামের আতিথিয়তা সবই মনে আছে তার। শুধু একটি প্রসঙ্গেই নিরব জয়সুরিয়া। ক্রিকেট ছেড়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া নিয়ে কোন রকম মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছেন এ ক্রিকেট গ্রেট। কথোপকোথন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে ছবি তুললেন হাসিমুখে। কোন এক সাংবাদিক সেলফি তুলতে গিয়ে ভুল বাটনে টিপ দিচ্ছিলেন, সেটাও নোটিশ করলেন হেসে হেসে। কথা বার্তা, আচার আচরণে একজন সত্যিকার ভদ্র, নম্র ও বিনয় বার বার বলে দিচ্ছিল কবি গুরুর সে অমর সংলাপ, `বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে।` জয়সুরিয়ারা কেন এত বড় মাপের ক্রিকেটার? তার সঙ্গে অল্প সময়ের কথোপকোথনেই জানা হলো, কারণ তিনি বড় মাপের ভদ্র মানুষ। অহংকার গরিমা কি? তা নেই তার অভিধানে। এআরবি/এমআর/জেআইএম

Advertisement