খুলনায় জন্ম। মা-বাবা বা পরিবারের কেউই ভাবেননি মেয়েটি একদিন নাম করবে। দেশসেরা অভিনেত্রীদের একজন হয়ে উঠবে। তবে ছোটবেলা থেকেই অভিনয় ও গানের প্রতি ছিল তার দারুণ আগ্রহ। সেই আগ্রহ নিয়েই নাম লিখিয়েছিলেন ‘আনন্দ বিচিত্রা ফটো বিউটি কনটেস্ট’ প্রতিযোগিতায়। এখানে বিজয়ী হয়ে যাত্রা শুরু হয় তার। ১৯৯০ সালে টেলিভিশনের বাণিজ্যিক ধারার বিভিন্ন অনুষ্ঠান নিয়ে হাজির হন তিনি। তবে মনের মধ্যে অভিনেত্রী হওয়ার বাসনা সুপ্তই থেকে গেল। অবশেষে ভাগ্যদেবী মুখ ফিরে যেন চাইলেন। ডাক পান চলচ্চিত্রে। পরিচালক সোহানুর রহমান। বলিউডের ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তাক’ ছবিটির কপিরাইট এনে নির্মাণ করা হবে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। পরিচালক এক জোড়া নতুন মুখ উপহার দিতে চান ছবিটি দিয়ে। সেখানে সালমান শাহ নামের এক তরুণের বিপরীতে অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হলেন তিনি। সাল ১৯৯৩। ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে এলো। অনেকটাই এলাম, দেখলাম ও জয় করলাম’র মতোই দেশ মাতেয় দিলেন নায়িকা। তারপর থেকেই শুরু হলো মুগ্ধ পথচলার। দিনে দিনে আজ তিনি চলচ্চিত্রের প্রিয়দর্শিনী মৌসুমী। প্রযোজক, পরিচালক ও দর্শকদের সেরা পছন্দ হয়ে রাজত্ব করেছেন দুই দশকেরও বেশি সময়। আদর্শ স্ত্রী, মা ও গৃহিণী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অভিনেত্রী মৌসুমী সফল হয়েছেন প্রযোজক হিসেবেও। পরিচালনায়ও দেখিয়েছেন নির্মাণের মুন্সিয়ানা। শুধু তাই নয়, অভিনয়-মডেলিংয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও গান নিয়েও হাজির হয়েছেন মৌসুমী। বেশ কিছু চলচ্চিত্রে গেয়েছেন জনপ্রিয় অনেক গান। বর্তমানে তাকে চরিত্রভিত্তিক অভিনয়েই বেশি দেখা যায়। অভিনয় করছেন ছোট পর্দায়ও। সম্প্রতি জাহিদ হাসানের সঙ্গে কাজ করেছেন ভিশন রেফ্রিজারেটরের বিজ্ঞাপনে। রাজধানীর কোক স্টুডিওতে হয়েছে এর শুটিং। সেখানেই জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপে এই চিত্রাভিনেত্রী জানালেন চলচ্চিত্রে তার জানা-অজানা অনেক কথা। আলোকচিত্রী মাহবুব আলমের ক্যামেরায় লিখেছেন লিমন আহমেদজাগো নিউজ : অনেকদিন পর বিজ্ঞাপনে কাজ করছেন। কেমন লাগছে?মৌসুমী : বিজ্ঞাপনে কাজ করতে আমার খুব ভালো লাগে। এখানে সৃষ্টিশীলতার অনেক জায়গা আছে। অভিনয় নিয়েও একটা চ্যালেঞ্জ থাকে। জাগো নিউজ : এই বিজ্ঞাপনটি সম্পর্কে বলুন....মৌসুমী : এটি ভিশন রেফ্রিজারেটরের বিজ্ঞাপন। বিগ বাজেটে নির্মিত হচ্ছে এটি। একটি বিয়ে বাড়ির সেট সাজানো হয়েছে রাজকীয় আয়োজনে। আমি ও জাহিদ হাসান বিয়ের অতিথি হিসেবে হাজির হবো। মূলত জিঙ্গেলভিত্তিক টিভিসি এটি। খুব ভালো লাগছে কাজ করে। আমি আগেও আরএফএল’র পণ্যের বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি। এবার ফ্রিজের বিজ্ঞাপনে কাজ করলাম। জাগো নিউজ : জাহিদ হাসানের সঙ্গে অনেকবারই জুটি বেঁধে কাজ করেছেন নাটক, চলচ্চিত্রে। এবার বিজ্ঞাপনেও জুটি হলেন। এটি নিয়ে আপনার প্রত্যাশা ও অনুভূতি জানতে চাই.....মৌসুমী : এক কথায় বললে অসাধারণ। জাহিদ হাসানের সঙ্গে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই নাটকে কাজ করেছি। পরবর্তীতে আরও অনেকগুলো নাটক-টেলিফিল্মে কাজ করেছি আমি। আর ‘প্রজাপতি’ নামে একটি চলচ্চিত্রেও তার সঙ্গে কাজ করা হয়েছে। এবার আমরা বিজ্ঞাপনেও জুটি হলাম। আমার অনেক প্রত্যাশা এই টিভিসিটি নিয়ে। দর্শক এটি গ্রহণ করবেন সেই বিশ্বাস আছে। এর বাজেট, সেট ডিজাইন, নির্মাণের মুন্সিয়ানা ভালো লাগবে সবার। আর সহশিল্পী হিসেবে জাহিদ হাসান চমৎকার একজন। বড় মাপের অভিনেতা তিনি। দীর্ঘদিন ধরে সমান জনপ্রিয়তায় কাজ করে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে কাজ করাটাকে বরাবরই উপভোগ করি আমি। জাগো নিউজ : এবার আপনার সাম্প্রতিক কাজগুলো নিয়ে কথা বলব। শুনছি পি এ কাজলের পরিচালনায় রিয়াজের বিপরীতে কাজ করতে যাচ্ছেন?মৌসুমী : এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কিছু নয়। কাজল ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। তিনি গল্পটার একটা ছায়া আমাকে শুনিয়েছেন। রিয়াজের কথাও বলেছেন। আমি গল্পটা চেয়েছি পড়ে দেখার জন্য। সেটি হাতে এলে পড়ে গল্প পছন্দ হলে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তিবদ্ধ হবো। আর রিয়াজ থাকবে কি না সেটিও তখন নিশ্চিত করে বলা যাবে। কারণ, সেও গল্পটি পড়তে চেয়েছে। আসলে এই বয়সে এসে নিজের চরিত্রগুলোর মধ্যে অভিনয় ও সৃষ্টিশীলতার ছোঁয়া না থাকলে কাজ করতে ইচ্ছা করে না। চরিত্রের ব্যাপ্তি যাই হোক না এর গুরুত্বটাই প্রাধান্য দেই। চরিত্রের গুরুত্ব না থাকলে ছবি করি না। জাগো নিউজ : পি এ কাজলের ছবিটিতে আপনার চরিত্রটি একজন নারী ফুটবল দলের ম্যানেজার বলে শোনা যাচ্ছে। এটি আপনার জন্য কেমন গুরুত্ব বা কতোটা চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করেন?মৌসুমী : যতটুকু শুনেছি ভালো লেগেছে। মনে হয়েছে চরিত্রটি আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন এবং ব্যতিক্রম। এটি আসলে গল্পপ্রধান একটি চলচ্চিত্র হবে। সেখানে নারী ফুটবল দলের ম্যানেজার থাকবেন বেশ গুরুত্ব নিয়ে। সে জায়গা থেকে এটা আমার কাছে বেশ চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। দেখা যাক কী হয়। দর্শকের মনে দাগ কেটে যায় এমন সুযোগ পেলে আমি চেষ্টার ত্রুটি রাখব না।জাগো নিউজ : একটা সময় মান্না-মৌসুমী-ডিপজল- এই ত্রয়ী অসংখ্য সুপারহিট ছবি উপহার দিয়েছে। মান্না ভাই আজ আর নেই। কিন্তু অনেকদিন পর আবারও মৌসুমী-ডিপজল একসঙ্গে কাজ করছে। কেমন লাগছে?মৌসুমী : মান্নার চলে যাওয়াটা আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। সে যেখানেই থাক, আল্লাহ তাকে শান্তিতে রাখুক। তাকে নিয়ে আমি ও ডিপজল ভাই অনেক ছবিতে কাজ করেছি। গেল মাসে আমরা যখন ‘দুলাভাই জিন্দাবাদ’ ছবিটিতে কাজ শুরু করি তখন মান্নাকে বারবার মনে পড়েছে। আর একটি ব্যাপার হলো এই ছবিটি পরিচালনা করছেন মনতাজুর রহমান আকবর। আমাদের ‘ত্রয়ী’কে নিয়ে আকবর ভাইও অনেকগুলো ছবি বানিয়েছিলেন। সেদিক থেকে আমাদের নতুন ছবিটিতে ফেলে আসা দিনের একটা আবহ আছে। খুব ভালো হতো মান্নাকে পেলে। কেন যে মানুষ এভাবে হারিয়ে যায় অকালে। দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ারে কত প্রিয় মানুষকে হারাতে হলো!জাগো নিউজ : দুলাভাই জিন্দাবাদ ছবিটি নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কেমন?মৌসুমী : আমি ছবিটি নিয়ে আশাবাদী। এখানে গ্রাম বাংলার মানুষকে মুগ্ধ করার মতো একটি গল্প আছে। প্রতিটি চরিত্রই মনে দাগ কাটবে। আর ডিপজল ভাইয়ের চরিত্রটি ভালো লাগবেই। গ্রামের একজন সহজ-সরল মানুষ। মানুষের বিপদে পাশে থাকেন। প্রতিবাদী তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এর গানগুলোও বেশ শ্রুতিমধুর। মিম ও বাপ্পীও বেশ ভালো করছে। জাগো নিউজ : আগের ডিপজল ও এই সময়ের ডিপজলের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতার মিল-অমিল কী?মৌসুমী : তেমন কোনো অমিল নেই। ডিপজল ভাই একজন শক্তিমান অভিনেতা। চিত্রনায়ক জসিমের পর তিনিই ভিলেন ও নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। সুদর্শন চেহারা না থেকেও তিনি দর্শকদের মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তিনি ভাবেন অভিনয়টা কেমন হলে দর্শক দেখতে আসবে। দর্শক হলে ফেরানোর ভাবনাটা তার আগের মতোই আছে। তবে বয়স হয়েছে। তাই এনার্জিটা আগের মতো নেই টানা শুটিং করে যাওয়ার। তবুও তার একাগ্রতা, অভিনয়ের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখে নতুন হিরো বা অভিনেতাদের অনেক কিছু শেখার আছে। জাগো নিউজ : এছাড়া নতুন কোনো কাজ করছেন?মৌসুমী : আরও দুটি ছবিতে কাজ করছি। কথা হচ্ছে বেশকিছু গল্প নিয়ে। যদি পছন্দ হয় তবে শিগগিরই জানাব। জাগো নিউজ : আপনার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘কপোতাক্ষ’র কী খবর?মৌসুমী : বলার মতো তেমন কোনো খবর নেই। ছবির বাজার আগের অবস্থায় নেই। ইচ্ছা থাকলেও সাহস হয় না। তবে পরিকল্পনা আছে আবারও প্রযোজনায় আসার।জাগো নিউজ : পরিচালক মৌসুমীরও অনেকটা বিরতি হয়ে গেল। আর কী দেখা যাবে না?মৌসুমী : চলচ্চিত্রে পরিচালনার কথা বললে বিরতিটা বেশ লম্বাই। তবে গেল বছর আমি ‘শূন্য হৃদয়’ নামে একটি টেলিফিল্ম পরিচালনা করেছিলাম। আর চলচ্চিত্রে প্রযোজনার মতোই পরিচালনায়ও ইচ্ছা আছে। কিন্তু এখনকার যে অবস্থা তাতে করে সাহসটা পাই না। আমি ২০০৩ সালে ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ দিয়ে পরিচালনা শুরু করি। ফেরদৌস, রাজ্জাক ও ববিতার পাশাপাশি আমিও এতে অভিনয় করেছিলাম। ছবিটি দর্শক ও সমালোচক মহলে বেশ প্রশংসিত ছিল। এরপর ২০০৫ সালে ইমপ্রেসের ব্যানারে ‘মেহের নিগার’ ছবিটি বানিয়েছিলাম। এই ছবিটিও প্রশংসিত ছিল। আমি মনে করি, এই দুটি ছবির পর আমার ওপর একটা আস্থা বা নির্ভরতা তৈরি হয়েছে দর্শকের। তার মূল্য আমাকে দিতে হবে। তাই যাচ্ছে তাই ছবি নির্মাণ না করে বিরতিতে আছি। ভালো গল্পের খুব অভাব আমাদের এখানে। তেমন গল্প পেলে আবারও হয়তো পরিচালক মৌসুমীর প্রত্যাবর্তন ঘটবে। জাগো নিউজ : আপনার বড় সন্তান ফারদিন এহসান স্বাধীন এরই মধ্যে নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে ছোট পর্দায়। তাকে কী চলচ্চিত্র পরিচালনায়ও দেখা যাবে?মৌসুমী : হ্যাঁ। আমার ছেলে সে নিজের ভালো লাগার জায়গা থেকেই পরিচালনাকে পছন্দের জায়গা হিসেবে নিয়েছে। আমার কোনো আপত্তি নেই। সানীরও নেই। বরং আমরা দুজনই তার পাশে আছি। তাকে সহযোগিতা করেছি। ফারদিন বর্তমানে দেশের বাইরে সিনেমা নির্মাণ নিয়েই পড়াশোনা করছে। হলিউডের খ্যাতিমান লোকজনদের সঙ্গে মিশছে ও কাজ করার চেষ্টা করছে। আমি স্বপ্ন দেখি আমার ছেলে চলচ্চিত্র নির্মাণে এই ইন্ডাস্ট্রিকে সমৃদ্ধ করবে। জাগো নিউজ : এবার আপনার গান নিয়ে কথা বলব। আপনি বেশ কিছুতে ছবিতে গান করেছেন। তার অনেকগুলো প্রশংসিতও হয়েছে। কখনো গানের অ্যালবাম প্রকাশের ইচ্ছা করেনি?মৌসুমী : গান আমি পছন্দ করি। গাইতে এবং শুনতে। ছোটবেলায় ইচ্ছা ছিল গায়িকা হবো। কিন্তু সময়ের স্রোতে সে আর হয়ে ওঠেনি। অভিনেত্রী হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেলাম। শখের বশে কিছু গান করেছি। তবে অ্যালবাম আকারে শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশের ইচ্ছা হয়নি। সুযোগ হলে আগামীতেও গান করবো কেবল চলচ্চিত্রেই।জাগো নিউজ : জনপ্রিয় ব্যান্ড ফিডব্যাক তাদের ‘উল্লাস’ অ্যালবামে ‘মৌসুমী’ নামের একটি গান করেছিলো। সেটি গেয়েছিলেন মাকসুদুল হক। দেশজুড়ে বেশ শ্রোতাপ্রিয় হয়েছিলো গানটি। মফস্বল এলাকাগুলোতে একটা গল্প ছড়ানো আছে- গানটি নায়িকা মৌসুমীকে নিয়ে করা। জানতে চাই, এই গানটি আপনাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে? একজন নায়িকার নামে গান। সেটি সর্বত্রই বাজছে। কেমন লাগত তখন?মৌসুমী : আসলে এই গানটি আমার নিজেরও খুব ভিষণ প্রিয়। ফিডব্যাক আমারও পছন্দের ব্যান্ড। আর মাকসুদ ভাইয়ের কণ্ঠ সে তো অসাধারণ। ইউনিক। আজও তার কণ্ঠ এবং গায়কী সবার থেকে মিষ্টি লাগে, দরদমাখা মনে হয়। আর ‘মৌসুমী’ গানটির সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা সম্পূর্ণই মন থেকে বানানো। কেননা, এই গানটি যখন তৈরি হলো তখনও আমি নায়িকা বা ফেমাস কোনো মৌসুমী হয়ে উঠিনি। আর মাকসুদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা বা পরিচিতি ছিলো না। আমি তখন সংগ্রাম করছি শোবিজে যাত্রার। হঠাৎ একদিন গানটা শুনলাম। খুব ভালো লাগলো। অ্যালবামটি আমিও কিনেছিলাম। তবে যেটা হয়েছে অস্বীকার করব না, এই গানটি আমার ক্যারিয়ারে দারুণ প্রভাব ফেলেছিল। বলা যেতে পারে এটি ছিলো উত্থানের সময়টাতে আমার জন্য প্লাসপয়েন্ট। সবখানে ‘মৌসুমী’ রব। বেশ সহজ হয়েছিলো নিজেকে পরিচিত করতে। আর খুব ভালো লাগতো যেখানেই যেতাম সেখানেই গানটি শুনতে পেতাম বলে। নিজের নামে একটি গান সবখানে শুনতে পারাটা অবশ্যই আনন্দের। এটা ছিলো আমার জন্য অনুপ্রেরণার। অনেকে কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেসও করতেন, গানটির মৌসুমী আমি মৌসুমীই কি না। আমি মজা পেতাম। না বলতাম। কেউ বিশ্বাস করতো, কেউ করতো না। তবে মাকসুদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে আমিও জানতে চাইব- কে এই মৌসুমী? যাকে নিয়ে এত চমৎকার আকুলতায় গেয়েছিলেন তিনি।জাগো নিউজ : আবারও চলচ্চিত্রে ফিরছি। আপনার অনেক চলচ্চিত্রই ঢাকা ছবির আর্কাইভকে সমৃদ্ধ করেছে। অনেক ছবি এখনও দর্শককে মোহিত করে। যদি রিমেকের জন্য বাছাই করতে বলা হয় তবে কোন ছবিগুলো আপনি তালিকায় রাখবেন?মৌসুমী : রিমেক আসলে একটি আলোচিত-সমালোচিত বিষয়। প্রায় সময়ই রিমেক করা ছবি আগের ছবিটির মানকে ধরতে পারে না। তবে আমার নিজের ছবির মধ্যে রিমেকের জন্য ছবি বাছাই করাটা কঠিন। কেননা, নিজের সব কাজই সেরা মনে হয়। আর কিছু কাজ আছে যা সত্যি ভাল। তবুও আমি ‘গরীবের রানী’ ছবিটিকে এক নম্বরে রাখব। কারণ এই ছবিটি দিয়ে আমার প্রযোজনার শুরু হয়েছিলো। সুপারহিট একটি ছবি। এর সময়োপযোগিতা এখনও আছে বলে মনে করি। দর্শক এখনও ছবিটি দেখবেন। এর বাইরে সালমানের সঙ্গে আমার ছবিগুলো রিমেক করা যেতে পারে। দর্শকের কাছে এখনও সালমান পছন্দের সেরা নায়ক।জাগো নিউজ : আপনার যাত্রাটা হয়েছিলো রোমান্টিক নায়িকা হিসেবে। আপনি প্রতিষ্ঠাও পেয়েছেন এই ইমেজে। আপনার চোখে পাঁচজন সেরা রোমান্টিক নায়ক কারা?মৌসুমী : এ খুব কঠিন প্রশ্ন। নায়করাজ রাজ্জাক, ফারুক সাহেবরা খুবই রোমান্টিক। তাদের অনেক ছবি আছে যা আজও প্রেমিক-প্রেমিকাদের মনে দাগ কাটে। এনাদের পর জাফর ইকবাল, নাঈম ভাইয়ের নাম বলতেই হবে। এরপর সানী রোমান্টিক হিরো হিসেবে যাত্রা করলেও অ্যাকশান-রোমান্টিক হিরো হিসেবেই সে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। তার পরবর্তীতে সালমান শাহ। আজও সে রোমান্সের কিং হয়ে আছে ঢাকাই ছবিতে। সালমানের পর রিয়াজ, ফেরদৌস ও শাকিবকেই রোমান্টিক বলতে হবে। আর ইলিয়াস কাঞ্চন নানা ইমেজে পর্দায় হাজির হয়েছেন। তার অনেক রোমান্টিক ছবি আছে যা দর্শক মুগ্ধ করেছে। কিন্তু তিনি অ্যাকশান, সামাজিক গল্পের ছবিতেও দুর্দান্ত অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।জাগো নিউজ : চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে বেশ জমজমাট ইন্ডাস্ট্রি। চলছে অনেক মিটিং, পরিকল্পনা। এই নির্বাচন নিয়ে আপনার ভাবনা জানতে চাই.....মৌসুমী : একজন শিল্পী হিসেবে আমার ভাবনা আর দশজনের মতোই। শিল্পীদের জন্য অতীতে শিল্পী সমিতি যেভাবে নিবেদিত ছিল আগামীতেও তেমনি একটি কমিটি আসবে। অভিজ্ঞরা দায়িত্ব নেবেন। যাদেরকে সবসময় পাশে পাওয়া যায় তারা কমিটির দায়িত্ব পাবেন। আর যেহেতু ওমর সানী এবারে সভাপতি পদের জন্য নির্বাচনে যাচ্ছে তার স্ত্রী হিসেবে আমি তাকে সমর্থন করব। তার জন্য নির্বাচনী প্রচারণায় থাকব। আমি চাইব, সানীর হাতেই শিল্পী সমিতির দায়িত্ব আসুক। এ শুধু আমার স্বামী বলেই নয়, আমি জানি ও শিল্পীদের কতোটা ভালোবাসে। ও নিজেকে কতোটা নিবেদিত করে ইন্ডাস্ট্রির জন্য কাজ করতে পারে। সদ্য শেষ হওয়া কমিটির মধ্যে ও ছিলো সহ সভাপতি আর অমিত হাসান ছিলেন সেক্রেটারী। এই দুজন সবসময়ই শিল্পীদের খোঁজ নিয়েছেন, শিল্পীদের পাশে থেকেছেন। সম্প্রতি যে পিকনিকটি নিয়ে অনেকেই উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে নানা কথা ছড়াচ্ছেন। কিন্তু তারা একবারও ভাবছেন না, এই পিকনিকটি সানী প্রায় একাই আয়োজন করেছেন। না দিয়েছেন কেউ কোনো আর্থিক সাহায্য, না দিয়েছেন মানসিক সাহায্য। সবাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। অনেকেই এসেছেন। যেহেতু হুট করে আয়োজন করা কিছু ভ্রান্তি ছিলো। কিন্তু সেই ভ্রান্তির দিকটা হাইলাইট না করে, বনভোজন আয়োজনের যে একান্ত ইচ্ছেটা ছিল সেটা আড়ালে রাখা হচ্ছে। শিল্পী সমিতির সদস্য হয়েও কিছু মানুষ বনভোজন নিয়ে ফেসবুক ও নানা জায়গায় গীবত করে বেড়াচ্ছেন। আমার কাছে হাস্যকর লাগে, তারা বুঝতেও পারেন না শিল্পী সমিতির দুর্বলতা প্রকাশ করা মানে তার নিজেরেই দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়া। কারণ সে নিজেও এর সদস্য।আমরা শিল্পী। এখানেই থাকব, একসঙ্গে কাজ করব। কমিটি কেবল অভিভাবকত্বের একটা প্রতীক। এমন প্রতীক হবার নির্বাচন নিয়ে কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি করা ঠিক নয়। কেউ কেউ পারলে এখনই সভাপতি-সেক্রেটারি হয়ে পদে বসে যান-এমনই অবস্থা। যার যোগ্যতা আছে সেই দায়িত্বে যাবে, নির্বাচিত হবে। কিন্তু উগ্রতা, অভদ্রতা, মিথ্যে প্রচারণা শিল্পীদের মানায় না। ব্যানার একটি গুরুত্বপূর্ণূ বিষয় নির্বাচনে। তবে তারও আগে ব্যাক্তি ইমেজ একটি বিষয়। এইসবকিছু এখানে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। শাকিব খানের ব্যাক্তি ইমেজের নেতিবাচকতা সানীসহ বিভিন্ন প্রার্থীদের উপর বর্তানো হচ্ছে হাস্যকরভাবে। বলা হচ্ছে, এই শিল্পী সমিতির আমলেই কলকাতার ছবি ও শিল্পীরা অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে। অথচ, প্রথম অবৈধ ছবিটিতে মিশা সওদাগরই অভিনয় করেছেন। সে নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। সবাই চিৎকার করছেন তখন, যখন সবকিছু একটা নিয়মের মধ্যে এনে শাকিব দুই বাংলার ছবিতে প্রতিনিধিত্ব করছে। সে একটা ভারসাম্য বজায় রেখে কলকাতার বাজারে এদেশের ছবির বাজার তৈরিতে চেষ্টা করছে। এই বিষয়টাকেও নিজেদের স্বার্থ পূরণের জন্য রঙ মাখিয়ে মিথ্যে দিয়ে ছড়ানো হচ্ছে। সাংবাদিকদের উচিত সবকিছু বিবেচনা করা। যা সত্য তা লেখা। আমি ও সব শিল্পীরাই যোগ্য প্রতিনিধিকে চাই আমাদের নেতৃত্বে। জাগো নিউজ : শাবনূর, পপি, পূণির্মা এবং আপনাকে নাম ও যোগ্যতা অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারছে না ইন্ডাস্ট্রি। দর্শকরাও বঞ্চিত হচ্ছেন। দিন দিন সিনিয়র শিল্পীরা গুরুত্ব হারাচ্ছেন আমাদের চলচ্চিত্রে। এই বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?মৌসুমী : এটি আমাদের জন্য অশনি সংকেত, হুমকিরই আরেক নাম। খুব দ্রুত এই জায়গাটিতে উন্নতি করতে হবে। বলিউডে সত্তর পেরিয়েও অমিতাভ বচ্চন শাহরুখ খান, রণবীর কাপুরদের সঙ্গে সেরা অভিনেতা হিসেবে বিভিন্ন পুরস্কারের জন্য মনোনীত হচ্ছেন। আর আমাদের দেশে রাজ্জাক, আলমগীর, ফারুক, ইলিয়াস কাঞ্চন, রিয়াজদের মতো অভিনেতারা কাজ করাই সুযোগ পান না। কারণ একটাই, ভালো গল্প ও চরিত্র। আমাদের এখানে একটা স্বস্তা এবং প্রতিষ্ঠিত ফরম্যাট আছে। সেটি হলো নায়ক-নায়িকা বয়স্ক হলে তারা বাবা-মা, ভাই-ভাবী হবেন। অভিনেতা বা অভিনেত্রী হিসেবে নিজেদের আর প্রমাণের কিছু নেই। অথচ কী অসম্ভব মেধাবী আমাদের সিনিয়ররা। ববিতা, সুচন্দা, কবরী, আনোয়ারা, শবনম, সুজাতা, রোজিনা, সুচরিতা- কী সব নাম। উনারা যোগ্য গল্প ও চরিত্রে কাজ করতে পারছেন না বলে ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরে যাচ্ছেন। এতে করে মুরুব্বীহীন, অভিভাবকহীন হয়ে পড়ছে ইন্ডাস্ট্রি। স্বাভাবিকভাবেই উঠকো মানুষেরা লাইমলাইটে আসছেন। নানা রকম ধান্ধা-ফিকিরে আটকে যাচ্ছে ঢাকাই ছবি। জুনিয়ররাও তাদের সিনিয়র সম্পর্কে তেমন মূল্যায়ণ দেখাচ্ছে না। অবক্ষয় হচ্ছে সম্পর্ক ও পারিবারিক পরিবেশের।জাগো নিউজ : এর উত্তরণের পথ নেই?মৌসুমী : আছে। চলচ্চিত্রের এখন হল সংকট, বাজেট, টেকনিক্যাল সমস্যা, নির্মাণের মুন্সিয়ানা, পাইরেসীসহ অনেক সমস্যা। তার মধ্যে সিনিয়রদের গুরুত্ব না দেয়াটাও অন্যতম একটি। সিনিয়র শিল্পীদের আনাগোনা বাড়লে দর্শকের আগ্রহ বাড়বে। এর জন্য গল্পের উন্নতি ঘটাতে হবে, বৈচিত্রতা আনতে হবে। ভালো গল্পকার ও নতুন গল্পকারদের সুযোগ দিতে হবে। গৎবাঁধা গল্পের বাইরে গিয়ে ভাবনায় বৈচিত্র না আনলে, সিনিয়রদের চরিত্রের গুরুত্ব না বাড়লে শুধু প্রেম-ভালবাসা দিয়ে ইন্ডাস্ট্রি চলতে পারে না। ভিনদেশি ছবির আদলে কপি করা ছবি কখনই আমাদের নিজস্বতাকে বাঁচাবে না। আর নিজস্বতা না থাকলে কোনো কিছুর প্রতি মানুষের দায় কাজ করে না। আমাদের সময়েও একদিকে আমরা কলেজ পড়ুয়া চরিত্রে অভিনয় করেছি অন্যদিকে আনোয়ার হোসেন, গোলাম মোস্তফা, শওকত আকবর, রাজ্জাক, আলমগীর, হুমায়ূন ফরীদি, শাবানা, ববিতারা ক্যারিশমাটিক চরিত্রে কাজ করে বাজিমাত করেছেন। তাদের অনেকে এখন আছেন। অনেকের সামর্থ্য আছে। এইসব সুপারস্টারেরা ফিরলে আমার বিশ্বাস দর্শকও হলে ফিরবেন। সোহানুর রহমান সোহান, মতিন রহমান, মুশফিকুর রহমান গুলজারের মতো সিনিয়র নির্মাতারাও ভাল কিছু করতে পারছেন না ভাল গল্পের অভাবে। তাই ভাল গল্পের বিকল্প নেই। আর যারা এখন নায়ক-নায়িকা হিসেবে পর্দায় আসছে তাদেরকেও ভালো গল্প গুরুত্ব দিতে হবে। সিনিয়রদের সংশ্লিষ্টতা বাড়াতে হবে। কেননা, একদিন কিন্তু তাদেরকেও বয়স্ক হতে হবে। তখন, তারাও উপেক্ষায় অভিমান নিয়ে দূরে থাকবে।জাগো নিউজ : অনেকটা পথ আপনি পাড়ি দিয়ে এসেছেন। তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ চলচ্চিত্রের অভিনয়ে যা যা পাওয়া সম্ভব সবই পেয়েছেন। ইউনেস্কোর দূত হিসেবেও কাজ করেছেন। তবুও প্রত্যাশার কোনো শেষ নেই। নিজেকে নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?মৌসুমী : আমি আসলে পরিকল্পনা করিনি। নায়িকা হব এটা কোনোদিন আমার পরিবারের কেউ ভাবেনি। যখন সবাই চিনছে, সম্মান করছে তখন মা ও বাবা খুব অবাক হলেন। তারা আমাকে সমর্থন দিলেন। বিয়ের পর আমার স্বামীও আমাকে সবসময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। দর্শকরা তো শুরু থেকেই আমাকে গ্রহণ করেছেন। এই কৃতজ্ঞতা চিরকালের। সবার ভালোবাসার মৌসুমী হয়েই থেকে যেতে চাই। আরও সমৃদ্ধ করার জন্য কিছু কালজয়ী চরিত্রে কাজ করে যেতে চাই। যে ইন্ডাস্ট্রি আমাকে মৌসুমী বানিয়েছে সবসময় তার ও তার মানুষদের পাশে থাকতে চাই। পারিবারিকভাবেই আমি মানুষের সঙ্গে মিশে বড় হওয়া মেয়ে। বিপদে আপদে কারও পাশে থাকতে পারলে ভাল লাগে।জাগো নিউজ : নতুনদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন....মৌসুমী : প্রথমেই বলব অভিনয় জানতে হবে এবং তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। প্রযোজক, পরিচালক থেকে শুরু করে ইন্ডাস্ট্রির প্রতিটি মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে। আজকাল শিডিউল ফাঁসানোর অনেক খবর পাই। এটা ঠিক নয়। আমরা পরিচালকের সঙ্গে এমনটি করার সাহস পেতাম না। নতুন পরিচালক ও প্রযোজক যারা তাদের বলব, নতুন ভাবনার নতুন কিছু উপহার দিতে হবে দর্শকদের। সবকিছুই বদলে যাচ্ছে। তারসঙ্গে তাল মেলাতে হবে। সাংবাদিকরা ইন্ডাস্ট্রির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের সঙ্গে সম্প্রীতির সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। কোনো বৈরীতা নয়, পরিবার হয়ে সবাইকে কাজ করতে হবে চলচ্চিত্রের স্বার্থে। সাংবাদিকরাও চলচ্চিত্রের প্রচারে আন্তরিক হবেন। নতুন যে প্রজন্ম এখন সাংবাদিকতায় নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা প্রয়াত সাংবাদিক আওলাদ হোসেনকে অনুসরণ করতে পারে। আরও অনেকেই আছেন যারা চলচ্চিত্রকে নিজেদের প্রেমিকার মত করে ভালোবেসেছেন।জাগো নিউজ : এবার সংসারী মৌসুমীর গল্প বলুন.....মৌসুমী : সংসার আমার প্রাণ। স্বামী আর মেয়ে ফাইজাকে নিয়ে প্রতিদিনের দিনযাপন। ছেলেটাকে মিস করি। পড়াশোনার জন্য ও থাকে দেশের বাইরে। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন। মিলেমিশে মানুষে মানুষে আদর্শ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। এলএ
Advertisement