খেলাধুলা

টেস্টে ব্যাকরণের বাইরে এসব কী শট?

আচ্ছা টেস্ট ক্রিকেট কি ওয়ানডের মত সীমিত ওভারের খেলা? যে একটা নির্দিষ্ট সময় ও ওভার বেঁধে দেয়া আছে এর মধ্যেই যা করার তা করতে হবে? সামনে টার্গেট সেট করা আছে, তা টপকে যেতে হবে? কিংবা প্রতিপক্ষকে ৫০ বা ২০ ওভারের মধ্যে একটা কঠিন কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে হবে? ক্রিকেটের ‘অ-আ’ জানা গলির পাড়ার অবুঝ কিশোরও অবলীলায় বলে দেবে, নাহ তা কেন হবে? টেস্ট ক্রিকেট হচ্ছে পাঁচ দিনের খেলা। যার প্রথম ও শেষ কথা হলো ‘ধৈর্য্য ও সংযম।’ বড় বড় ব্যাটসম্যানদের যারা টেস্টে হাজার হাজার রান করেছেন, গণ্ডায় গণ্ডায় শতরান হাকিয়েছেন তারা সবাই ধৈর্য্য-সংযমকে পুঁজি করেই বড় হয়েছেন। ওয়ানডের মত চটকদার মার, দর্শক বিনোদনের কথা ভেবে উইকেটে গিয়ে ফ্রি স্ট্রোক প্লে`র চেষ্টা করে নয়। চার ও ছক্কার নিপুণ প্রদর্শনী এবং মার মার কাট প্রবণতা বাদ দিয়ে মাথা নিচু করে ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাকরণ মেনে মেধা ও গুণ বিচার করে তবেই লম্বা ইনিংস সাজিয়েছেন। টেস্ট ক্রিকেটের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল ভালো লেন্থ ও লাইনে পিচ পড়া ডেলিভারিগুলোকে সমীহ দেখিয়ে রক্ষণাত্মক কৌশল অবলম্বন করা। পাশাপাশি অফস্টাম্প ও লেগস্টাম্পের বাইরের বলগুলো তাড়া না করে যতটা সম্ভব উইকেট আগলে তা ছেড়ে দেয়াই আদর্শ টেস্ট ব্যাটিংয়ের অন্যতম পূর্ব শর্ত।  যত বড় মেধাবী, দক্ষ-কুশলী ব্যাটসম্যানই হোন না কেন, টেস্ট খেলতে হবে নিয়ম ও ব্যাকরণ মেনে। ব্যাকরণ না মেনে যেমন ভাষা রপ্ত করা যায় না, ঠিক একই ভাবে ক্রিকেটের ব্যাকরণ না মেনে ইচ্ছেমত ব্যাট চালিয়েও ভালো টেস্ট ব্যাটসম্যান হওয়া সম্ভব নয়। সুনীল গাভাস্কার, জিয়ফ বয়কট, ইয়ান চ্যাপেল, গ্রেগ চ্যাপেল, গর্ডন গ্রিনিজ, ভিভিয়ান রিচার্ডস, ব্রায়ান লারা, শচিন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, মাহেলা জয়বর্ধনে, কুমারা সাঙ্গাকারা , ইউনুস খান আর হাল আমলের বিরাট কোহলি, যার কথাই বলা হোক না কেন, সবাই টেস্ট খেলতে নেমে দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটের চিরায়ত ধারা ও ব্যাকরণ মেনেই ব্যাট করেছেন। করছেন। ভালো বলকে সমীহ দেখান।  অফ ও লেগস্টাম্পের বাইরে পড়ে বেড়িয়ে যাওয়া বল ছেড়ে দিতে ভুল হয় না বিরাট কোহলির মত সময়ের সেরা উইলোবাজেরও। তারা জানেন, মানেনও টেস্টে রান করার জন্য বাজে বলের অপেক্ষায় থাকতে হয়। আমি শুধু আলগা ডেলিভারি মানে হাফ ভলি, ওভার পিচ আর খাটো লেন্থের ডেলিভারিগুলো থেকেই রান করবো। বড় বড় ও বিশ্ব বরেণ্য ব্যাটসম্যানরা এমন রীতি মেনে ব্যাট চালালেও দুঃখজনক এবং কঠিন সত্য বাংলাদেশের শীর্ষ তারকাদের বেশির ভাগই সে পথে হাঁটেন না। হাঁটতে চান না। কেউ কেউ বড় গলায় বলেন, ‘অমুকে ওভাবেই খেলে। আমার অভিধানটা আমার মত। আমি নিজের মতই খেলি। এসব কথা বলে আর অপ্রয়োজনীয় শট খেলে সেই সব ব্যাটসম্যানরা যে নিজের মেধা-প্রজ্ঞা অবজ্ঞা করছেন। নিজের মেধা ও সমর্থের প্রতি অবিচার করছেন, সে বোধ ও উপলব্ধি কি আছে ? না নেই। যদি তাই থাকবে, তাহলে টেস্টে এক ইনিংসে তিন তিনজন প্রধান ব্যাটসম্যান লেগস্টাম্পের বাইরে পিচ পড়ে বেড়িয়ে যাওয়া বলে আউট হবেন কেন ? গল টেস্টে তামিম ইকবাল, সৌম্য সরকার আর সাকিব আল হাসান তিনজনই লেগস্টাম্পের বাইরের বলকে অযথা তাড়া করে উইকেট বিসর্জন দিয়ে চলে এসেছেন। আগের দিন প্রথম ভুল পথে হাঁটা যাত্রী ছিলেন তামিম ইকবাল। লঙ্কান বাঁহাতি চায়নাম্যান লক্ষণ সান্দাকানের লেগস্টাম্পের বাইরে পিচ পড়ে আরও বেড়িয়ে যাওয়া বলকে অযথা তাড়া করলেন। লেগস্টাম্পের অন্তত দুই থেকে তিন ইঞ্চি বাইরে পড়ে ছয় ইঞ্চির বেশি বেড়িয়ে যাওয়া ঐ ডেলিভারিটা ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে নির্ঘাত ওয়াইড হতো।টেস্টে এ ধরণের বল তাড়া করেন না ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু বাংলাদেশের এক নম্বর ওপেনার তামিম তাড়া করে ব্যাট আনতে ব্যর্থ হলেন। এটাই শেষ নয়। ব্যাট ফাঁকি দিয়ে বল কিপারের গ্লাভসে যাবার পর অযথা উইকেট ছেড়ে বেড়িয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনা। আজ সকালে একই ধরনের বলে আউট হলেন সৌম্য সরকার ও সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের শর্ট দুর্বলতা আছে, তারা শরীর, মুখ ও মুখ সমান উচ্চতায় কিংবা মাথার ওপরের উচ্চতায় আসা বল পেলে না ছেড়ে তেড়ে ফুড়ে মারার চেষ্টা করেন এ সত্য জানা প্রায় টেস্ট বোলারের।  লঙ্কান এক নম্বর পেসার সুরেন্দর লাকমাল তা ভালোই জানতেন। তাই তো সৌম্য সরকারকে বাউন্সার ছুড়লেন।  লেগ-মিডল স্টাম্পে পিচ পড়া ঐ ডেলিভারি  খানিকটা কৌনিকভাবে সৌম্যর ডান পাজরের সামান্য বাইরে দিয়ে যাচ্ছিল। ওয়ানডে নয় যে রান করার তাড়া আছে। তাই টেস্টে সাধারনতঃ এই সব ডেলিভারি সবাই ছেড়ে দেন। কারন ঐ ডেলিভারি ছেড়ে দিলে কোনই সমস্যা হবে না। আউট হবার সামান্যতম সম্ভাবনাও থাকবে না। কিন্তু অত চিন্তা ভাবনা না করে সৌম্য ব্যাট চালিয়ে দিলেন। পাজর ঘেঁসে বেড়িয়ে যাওয়া ডেলিভারিতে পুল খেলতে গেলে শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখা কঠিন। তার অর্থ ঐ ধরনের পুল শটের ওপর নিয়ন্ত্রন রাখা কষ্ট। কিন্তু তাতে কি সৌম্যর যে নিজের সামর্থ্যর প্রতি অনেক বেশি আস্থা! সে অতি আত্মবিশ্বাস ও আস্থা যে বিপদের কারণ হতে পারে, তা না বুঝে চালিয়ে দিলেন। পরিণতি যা হবার তাই হলো। ফাইন লেগে ক্যাচ আউট। এখানেই শেষ নয়, লেগ স্টাস্পের বাইরে পিচ পড়ে আরও বেড়িয়ে যাওয়া ডেলিভারিকে অপ্রয়োজনে তাড়া করে অকাতরে উইকেট উপহার দিলেন সাকিব আল হাসানও। শুরু থেকে রানের নেশায় হন্যে হয়ে ছোটা সাকিব আউট হলেন বাঁহাতি চায়নাম্যান লক্ষণ সান্দাকানের লেগ স্টাম্পের বাইরের বল মারতে গিয়ে। লেগস্টাম্পের সামান্য বাইরে পিচ পড়া ঐ চায়নাম্যান ( বাঁ-হাতির জন্য অফব্রেক) ডেলিভারি আরও তবে তামিমের মত এক পা বেড়িয়ে এসে নয়। জায়গায় দাড়িয়ে। বল ব্যাটে লাগলো। কিন্তু বাইরের ডেলিভারি তাড়া করতে গেলে যা হয়, তাই হলো। ব্যাটের ভিতরের কানায় লেগে বল চলে গেল উইকেটের পিছনে ওৎ পেতে থাকা লঙ্কান কিপার ডিকভেলার গ্লাভসে। এভাবেই লেগস্টাম্পের বাইরের বল অযথা খেলতে গিয়ে তামিম ও সৌম্যর পর সাকিবও আউট হলেন। তিন তিনজন নামি ও নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান যখন এমন অপ্রয়োজনী শট খেলে আউট হন তখন, কি আর দল ভাল অবস্থায় থাকতে পারে? পারে না। আর তাই তো ২ উইকেটে ১৩৩ রান নিয়ে তৃতীয় দিন শুরু করা দল আজ সকালের সেশনে ৮০ রান তুলতেই খুইয়ে বসেছে চার উইকেট। ওয়েল সেট সৌম্য আর বলের চেয়ে দ্রুত রান (১৯ বলে ২৩) করা সাকিবের উইকেট দুুটি অনেক বড় ক্ষতির কারণ। কোথায় লঙ্কানদের ৪৯৪ রানের কাছাকাছি কিংবা টপকে যাওয়া এখন সুদূর পরাহতই মনে হচ্ছে। তার বদলে এখন ফলোঅনের শঙ্কাই তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সেটা যে টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাকরণ না মেনে অপ্রয়োজনীয় ও সনগড়া শট খেলতে যাবার কারণে, তা নিয়ে কি কারো সংশয় আছে? এআরবি/এমআর/আরআইপি

Advertisement