টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে দেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। দেশের প্রধান নদ-নদীর পানি ১৫টি স্থানে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ৪২টি স্থানে পানি সমতল বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। ভাঙনের কারণে বাড়িঘর ভেসে যাওয়ায় আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে অসংখ্য পরিবার। অনেক স্থানে নিজ উদ্যোগে বাঁধ মেরামত করছেন এলাকাবাসী। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, ব্রহ্মপুত্র ছাড়া সকল প্রধান নদ-নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় গঙ্গা-পদ্মা এবং ঢাকা শহর সংলগ্ন নদ-নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে দু’এক দিনের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে। কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে জামালপুরে। সিরাজগঞ্জে ২০০ গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। নেত্রকোনায় শতাধিক গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে। সুনামগঞ্জে তলিয়ে গেছে বেশ কিছু এলাকার জমির ফসল। বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে বগুড়ায়। নদী ভাঙনের কারণে হুমকিতে রয়েছে রংপুরের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে চাহিদা অনুযায়ী ত্রাণ পৌঁছেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। খাবার পানি ও নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের সংকট দেখা দিয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামও বেড়েছে কয়েকটি এলাকায়। ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষদের মাঝে।উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে গাইবান্ধার তিস্তা ব্রহ্মপুুত্র, যমুনা, ঘাঘট, করতোয়া সহ কয়েকটি নদীর পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার বন্যাকবলিত ২১ ইউনিয়নের বাড়িঘর অধিকাংশই পানিবন্দি। চরাঞ্চলে কিছু উঁচু জায়গা থাকলেও বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধে কোন জায়গা নেই। ফলে বিপদে পড়েছেন পানিবন্দি পরিবার গুলো। কামারজানি, মোল্লারচর, কাপাসিয়া, হরিপুর, তারাপুর, গিদারী, ঘাগোয়া, কঞ্চিপাড়া, ফজলুপুর, এ্যাডেন্ডাবাড়ি, ফুলছড়িসহ ২১ ইউনিয়নের পানিবন্দি মানুষের দুর্দশা তীব্র আকার ধারণ করেছে। বন্যা দুর্গত এলাকায় মানুষ তাদের ঘরের মধ্যে উঁচু করে মাচা পেতে অথবা ঘরের ধরনার সঙ্গে চৌকি বেঁধে বাস করছেন। খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। চরাঞ্চলের প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমির বর্ষাকালীন ধান ডুবে গেছে।রংপুর প্রতিনিধি জানান, কয়েকদিন ধরে অবিরাম বৃষ্টিতে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার নিম্নাঞ্চল গুলো প্লাবিত হয়েছে। অপর দিকে বৃষ্টির ফলে চাল সহ কাঁচামালের দাম বেড়েছে ৫ থেকে ১০টাকা। গত বুধবার সকাল থেকে শুক্রবার পর্যন্ত অবিরাম বর্ষণে উপজেলার নিজপাড়া, চর নাজিরদহ, প্রাণনাথ চর, গোপিডাঙ্গা, ঢুষমারা, বিশ্বনাথ, হয়বত খাঁ, চর সাব্দী, চর গনাই সহ বিভিন্ন গ্রামের নিম্নাঞ্চল গুলো প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় তিস্তা নদীর পানি কমে গেলেও পানি বাহির হতে না পারায় আমন ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এদিকে অবিরাম বর্ষণে বাজারে শাক-সবজির সরবরাহ না থাকায় দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা। শুক্রবার মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৪০টাকা কেজি দরে।নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, নেত্রকোনায় টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে নদী ও হাওরের পানি বেড়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কলমাকান্দা, আটপাড়া, বারহাট্টা, সদর উপজেলাসহ বিভিন্ন উপজেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ওই সমস্ত গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকার আমন বীজতলা ও রোপা ধানের জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। নদীর পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জানা গেছে, গত ক’দিনের টানা বর্ষণে কংশ নদীর পানি সদর উপজেলার ঠাকুরা কোনা ইউনিয়নের দুর্গাশ্রম, তাতিয়র, বাঘরুয়া, বারহাট্টার বাউসী, নিশ্চিন্তপুর, রায়পুর, রামারবাড়ি, আসমা, আটপাড়ার মোবারকপুর, চারিয়া, তেলীগাতী, ইটাখলা, শুনই, নারাচাতল, কলমাকান্দায় উদ্ধাখালী ও গনেশ্বরী নদীর পানি বেড়ে উপজেলার নাজিরপুর, রংছাতি, লেঙ্গুরা, পাঁচগজ, কৈলাটী, বিষমপুর, সাকুয়া ইন্দ্রপুর, কৈলাটী, বেনুয়া চানকোনা, বিষমপুর কান্দাপাড়া, পুকুরিয়া, খলা, চারালকোনা, নাওরিপাড়াসহ শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ওই সব গ্রামের বীজতলা ও রোপা ধানের চারা এবং এলাকার বেশকিছু রাস্তা এরই মাঝে পানিতে তলিয়ে গেছে। কংশ নদীর পানি পূর্বধলার জারিয়া ও সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনা পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।কুড়িগ্রাম থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, বৃহস্পতিবারও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ২ সেমি., ধরলা নদীর ফেরিঘাট পয়েন্টে ৬ সেমি. এবং নুনখাওয়া পয়েন্টে দুধকুমার নদীর পানি ২ সে.মি. হ্রাস পেয়েছে। তবে কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি ৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে জেলার চল্লিশ ইউনিয়নের দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এতে তলিয়ে গেছে ১৫ হাজার হেক্টর জমির আউশ, আমন, বীজতলা ও শাক-সবজির ক্ষত। নাগেশ্বরী উপজেলার নুনখাওয়া ইউনিয়নের ১২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়েছে অন্তত ৩০টি পরিবার। বেরুবাড়ী ইউনিয়নের তার চরাঞ্চলের ৭ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যায় ভেঙে গেছে ২৩টি বাড়ি। বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের ৬ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে দেড় হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। পুরো এলাকা প্লাবিত হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। পাহাড়ি ঢলের কারণে দুধকুমার নদের অব্যাহত ভাঙ্গনে বঙ্গসোনাহাট স্থলবন্দর সেতুর সংযোগ হুমকির মুখে পড়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে স্থানীয় প্রশাসন সেতু দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে।
Advertisement
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জে সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অবিরাম বৃষ্টিতে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার হাওড় অঞ্চলে পানি বেড়েছে। পানি বাড়ায় আমন জমি ও সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছে কৃষকরা।সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সিরাজগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। যমুনা নদীর পানি তেমন না বাড়লেও শুক্রবার সকালে তা বিপদসীমার ১৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে পানি গত ২৪ ঘণ্টায় দুই সেন্টিমিটার বেড়েছে। জেলা জুড়ে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে যমুনার ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। সিরাজগঞ্জ জেলার দুই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় দুই লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দি। কাজিপুর উপজেলার সাতটি ইউনিয়নেই অন্তত লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কাজিপুরের মেঘাই-সোনামুখী আঞ্চলিক সড়কের ধারে বন্যার পানি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। নদীর পানি আর সামান্য বাড়লেই এই সড়কে পানি উঠতে পারে বলে এলাকাবাসী জানান। এই সড়কে পানি উঠলে কাজিপুর থেকে বগুড়া যাতায়াত বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষ তাদের সাধারণ কাজকর্ম না করতে না পারায় কষ্টে জীবন যাপন করছে। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র বাঁধের ওপর আশ্রয় নেয়া মানুষ এখন বেশি কষ্টে রয়েছে। খাবার ও পানির অভাবের পাশাপাশি গবাদি পশু নিয়ে কোন রকম তারা জীবন যাপন করছে। এখন পর্যন্ত তাদের কাছে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি বলে অভিযোগ করেছে বন্যাকবলিত মানুষ। এদিকে অব্যাহত পানির প্রবল চাপে বেলকুচি উপজেলার কয়েকটি গ্রাম এখন ভাঙনের কবলে পড়েছে। এই উপজেলার আগুরিয়া, রান্ধুনীবাড়ি, হরিনাথপুর, আগুরিয়াচর, বিল মহিষা গ্রামগুলো এখন ভাঙনের মুখে পড়েছে। একই সঙ্গে চৌহালী উপজেলার নদী তীরবর্তী অঞ্চলেও শুরু হয়েছে ভাঙন।বগুড়া থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, বগুড়ার ধুনট ও সারিয়াকান্দি উপজেলার বন্যায় ২৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে ধুনট উপজেলায় ৬টি ও সারিয়াকান্দি উপজেলায় ২৩টি। এদিকে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। যমুনার পানি সারিয়াকান্দি পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে যমুনার পানি বৃদ্ধির ফলে কুতুবপুরের ধলিরকান্দি থেকে কামালপুরের টিটুর মোড় পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকার ৪২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ২৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করেছে। এছাড়া ১৭টি বিদ্যালয়ের চারদিকে পানি রয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।
ধুনট উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম মণ্ডল জানান, উপজেলার ভাণ্ডারবাড়ি ইউনিয়নের ৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম জানান, কুতুবপুরের ধলিরকান্দি থেকে কামালপুরের টিটুর মোড় পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে চন্দনবাইশা আদবাড়িয়া স্কুলের নিকট থেকে রৌহাদহ বাজার পর্যন্ত ৮শ’ মিটার বাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়েছে। অধিক ঝুকিপূর্ণ বাঁধের ইতিমধ্যে ৫টি স্থানে ৩০০মিটার ধসে গেছে।জামালপুর থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, জামালপুর বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীতে বন্যার পানি বিপদসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। জেলার ৭০ হাজার মানুষ বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ইসলামপুরের চিনাডুলি ও নোয়াপাড়া ইউনিয়নের ২টি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে গেছে।জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, জেলার দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার ২৫টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। জেলার ওই ৫টি উপজেলার খাল-বিল ভরে ফসলি জমির মাঠে প্রবল বেগে বন্যার পানি প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। ইসলামপুর উপজেলার নোয়ারপাড়া ইউনিয়নের তাড়তাপাড়া এলাকায় যমুনার শাখা নদীর ভাঙন রোধে দুই বছর আগে স্বেচ্ছা শ্রমে নির্মাণ করা ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধটির প্রায় সিংহভাগ বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে। ইসলামপুরের শিংভাঙ্গা এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে গেছে।
Advertisement