শহরের বুকে বেড়ে ওঠা বিনীতা রানী। পার্বত্য খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। নারী হয়েও প্রশাসকের চেয়ারে বসে কাজ করছেন একজন পুরুষের মতোই। নারী-পুুরুষের মধ্যে কোনো ধরনের ব্যবধান দেখতে চান না বিনীতা রাণী। কর্মক্ষেত্রে মানিকছড়ি তার অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখানকার মানুষ সমতল জেলার মানুষের চেয়ে অনেক বেশি সহজ-সরল। এখানকার মানুষ অল্পতেই খুশি থাকে। পুরুষই সব পারে এ ধারণা ভাঙতে চান নবীন এ প্রশাসক বিনীতা রানী। আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে জাগোনিউজ২৪.কম এর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় তিনি বলেন তার প্রশাসক হয়ে ওঠার গল্প। বলেছেন পরিবার, শিক্ষা লাভ আর তার নারীদের নিয়ে স্বপ্নের কথা। আগামী প্রজন্মের নারী শিক্ষার্থীদের দেখিয়েছেন কেউ না দেখানো পথ। ব্যবসায়ী বাবা আর গৃহিণী মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় ও একমাত্র মেয়ে বিনীতা রাণী। ১৯৯৯ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি ও ২০০১ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়ো টেকনোলজি বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করেন বিনীতা রানী। ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত বিনীতা রানী ১৯৮৩ সালে রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটায় জন্মগ্রহণ করেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয় বিনীতা রানী ২৮তম বিসিএস-এ উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেন। কর্মজীবনের শুরুতেই ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর রাজবাড়ী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে শেরপুর সদর, নরসিংদীর পলাশ ও গাজীপুর সদরে দায়িত্ব পালন করেন। সেখানেই তিনি সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। পদোন্নতি লাভের পর ২০১৬ সালে ২৪ নভেম্বর পার্বত্য খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন।একজন প্রশাসক হওয়ার পেছনে তার মা-বাবাসহ পরিবারের সহযোগীতা আর নিজের ইচ্ছা শক্তি বড় ভূমিকা রেখেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো দিন অভাব কি জিনিস বুঝতে দেয়নি। একজন মেয়ে হিসেবে আমাকে কেউ আলাদা করে দেখেনি। আমাকে সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা দিয়েছে। আমার ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়নি। আর সে কারণেই আমি আজ এখানে পৌঁছাতে পেরেছি।শিক্ষকতা বা অন্য কোনো পেশায় না গিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে কেন যোগ দিলেন জানতে চাইলে বলেন, দেশের জন্য আর দেশের মানুষের জন্য কিছু করার মানসিকতা থেকেই প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেয়া। এখানে থেকে মানুষের জন্য কিছু করার অবধারিত সুযোগ রয়েছে বলেও জানান তিনি। প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসে যোগদানের আগে ইউসেফ বাংলাদেশ নামের সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের একটি প্রাইভেট স্কুলে ১৬ মাস শিক্ষকতা করেছেন উল্লেখ করে বিনীতা রানী বলেন, শিক্ষকতা পেশাকে তিনি খুব উপভোগ করতেন। মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা থেকেই প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেয়া বিনীতা রানী একজন নারী হিসেবে ভবিষ্যতে নারী সমাজের উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। আজকের অবস্থানে আসতে কোনো প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করতে হয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিকূলতা ছিল না বললে ভুল হবে। আমার এখানে আসতে খুব বেশি অনুকূল পরিবেশ ছিল না। মাতৃকূল আর পিতৃকূলে সরকারি চাকরিতে তিনিই প্রথম এমনটাও জানালেন নবীন এ প্রশাসক বিনীতা রাণী। পথ দেখানোর কেউ ছিল না বলে নিজেকেই পথ খুঁজে নিতে হয়েছে। ভয়কে জয় করতে পারার মধ্যেই একজন মানুষের স্বার্থকতা নিহীত থাকে বলে মনে করেন বিনীতা রানী।একজন নারী প্রশাসক হিসেবে কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অসুবিধায় পড়েছেন কিনা জানতে চাইলে নিজেকে একজন নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেই দেখতে চান বিনীতা রানী। এখানে কাজ করার জন্য সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি পরিবেশ আছে। আর তাই অসুবিধায় পড়ার কোনো কারণ নেই। সুযোগ-সুবিধা আর পরিবেশ মানুষকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। আমাদের দেশের নারীরা পিছিয়ে কেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নারীরা পিছিয়ে আছে এ কথা পুরোপুরি ঠিক না। বিশ্বায়নের এ যুগে নারীদেরও এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের দেশের নারীরা এখন সবক্ষেত্রেই পুরুষের সঙ্গে সমানতালে যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। যে অংশটি পিছিয়ে আছে, তারা নিজেদের বিকশিত করার সুযোগ পায়নি বা সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। তিনি বলেন, ঘরের কোণে পুতুল খেলা আর রান্না শেখা নয় দুনিয়াকে জানতে হবে। পুরুষরা বাইরে যাবে আর মেয়েরা শুধু পুতুল খেলবে, মায়ের কাছে রান্না শিখবে, ঘর গোছাবে এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের হাজারো প্রতিকূলতা থাকবে উল্লেখ করে আগামী প্রজন্মের নারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, সব প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হবে। এজন্য নিজের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা ইচ্ছা শক্তিকে জাগ্রত করতে হবে। ভয়কে জয় করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। বেগম রোকেয়ার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। নিজেকে বিকশিত করার মধ্যদিয়ে পরিবার ও সমাজকে নিজের অবস্থান জানিয়ে দিতে হবে। তখন কেউ তার উপর কিছু চাপিয়ে দিতে পারবে না। কেউ কাউকে জায়গা তৈরি করে দিবে না বরং নিজেকেই নিজের জায়গাটুকু তৈরি করে নিতে হবে। মুজিবুর রহমান ভুইয়া/এআরএ/এমএস
Advertisement