দেশজুড়ে

সেলাইয়ের কাজ করে ছেলেকে নায়ক বানিয়েছেন মা

নারী শব্দটি উচ্চারণ করতেই আমরা সবাই নাড়ির টান অনুভব করি। নারী মানে একজন মা, কন্যা, বোনসহ বিভিন্ন সম্পর্কের বন্ধন। এ সম্পর্কের মাঝে আছে অনেক মধুরতা, আবেগ, আনন্দ ও সুখের ছায়া। আবার এই নারীরাই অর্থনৈতিক মুক্তির তাগিদে প্রতিদিন ঘরে-বাইরে নিরলস সংগ্রাম করছেন স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য। আজ সাফল্যের পতাকা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। এই এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে অনেক শ্রম-ত্যাগ-সাহসিকতার গল্প। বিশ্ব নারী দিবস সামনে রেখে মুন্সিগঞ্জের এমন এক নারীর সফল হয়ে ওঠার গল্প থাকছে জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য।  ইচ্ছা, আন্তরিকতা, একাগ্রতা, পরিশ্রম ও সততা মুন্সিগঞ্জের সফল নারী উদ্যোক্তা সাফিয়া খাতুনকে উচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছে।২০ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন তিন সন্তানের এ জননী। কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। শক্তভাবে হাল ধরেছিলেন বলে আজ তিনি স্বাবলম্বী। ছেলেমেয়েদের স্বাবলম্বী করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সমাজে।মুন্সিগঞ্জ সদর পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডে খালইস্ট এলাকার মৃত শামসুল হকের স্ত্রী সাফিয়া খাতুন। স্বামী ছিলেন মুন্সিগঞ্জ জেলা রেজিস্ট্রার। স্বামীর মৃত্যুর পর একটি সেলাই মেশিন নিয়ে জীবনযুদ্ধে নামেন তিনি। নিজের বুদ্ধি, সাহস, মনোবল, সততা ও অদম্য ইচ্ছার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম ধীরে ধীরে তাকে নিয়ে যায় সাফল্যের পথে। সাফল্যের ধারা অব্যাহত রেখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি।এক মেয়ে ও তিন ছেলেসহ চারজনের সংসারে একটি সেলাই মেশিনই ছিল উপার্জনের উৎস। মাথা গোঁজার জন্য স্বামীর দেয়া ঘর। সেলাইয়ের কাজ করে ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন নিজেকে স্বাবলম্বী ও সন্তানদের মানুষ করার লক্ষে। একপর্যায়ে হস্ত ও কুটির শিল্পের কাজ শুরু করেন। ঘুরে দাঁড়াতে থাকে তার জীবনযুদ্ধের চাকা। পাশাপাশি তার সংসারও চলে স্বাভাবিক গতিতে। এক মেয়ে সৌদি প্রবাসী ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন। বড় ও মেজ ছেলে স্বাবলম্বী হয়ে সংসার আর কর্ম নিয়ে ব্যস্ত। ছোট ছেলে আশিক চৌধুরী বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের একজন নায়ক। সেলাইয়ের কাজ করেই তিনি তার সন্তানদের মানুষ করেছেন। ছেলেকে নায়ক বানানোর পাশাপাশি অন্য সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ২০০৯ সালে সাফিয়া খাতুন নিজ বাড়িতে গড়ে তোলেন দুস্থ-বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত ও প্রতিবন্ধী নরীদের নিয়ে হস্ত ও কুটির শিল্প প্রশিক্ষণশালা।আট বছর আগে সাফিয়া খাতুনের বাড়িতে গড়ে তোলা ‘দুস্থ মহিলা কল্যাণ সমিতি’ থেকে প্রতি বছর অন্তত ৪০ জন নারীকে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক বিভিন্ন কোর্সের মাধ্যমে হস্ত ও কুটির শিল্পের প্রশিক্ষণ দেন। এ কল্যাণ সমিতি থেকে প্রায় ৩০০ নারী এ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন।এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বাঁশ, বেত, পাট, পুতি, ব্লক, বাটিক, শোপিস তৈরিসহ বিভিন্ন হস্তশিল্প কাজ শেখানো হয়। বেত ও পুতি দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের ব্যাগ তৈরি করা হয়। বাঁশের মোড়া, বেতের টেবিলসহ পাটের তৈরি ম্যাট, পাপোস ও ব্লক-বাটিকের বেডকভার, থ্রিপিস এবং শাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। এসব পণ্য প্রশিক্ষণকেন্দ্রসহ জেলা ও জেলার বাইরে বিভিন্ন তাঁতমেলা, বস্ত্রমেলা, পহেলা বৈশাখ, নারী দিবসসহ বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করা হয়।সাফিয়া খাতুন জেলা যুব উন্নয়ন অধিদফতরের একজন কনটেইনার হিসেবে কাজ করছেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি নারীদের হাতে-কলমে কাজ শিখাচ্ছেন। নারীরা প্রশিক্ষণ শেষে যুব উন্নয়ন থেকে একটি সনদপত্র পান। সনদধারী নারীরা এ কাজের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে চাইলে যুব উন্নয়ন থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কাজ শুরু করতে পারে।সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে সংগ্রামী নারী সাফিয়া খাতুন ২০১৩ সালে বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে জয়িতা হিসেবে স্বীকৃতি পান। ২০১৪ সালে সফল আত্মকর্মী হিসেবে যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে প্রথম স্থানে পুরস্কৃত হন। ২০১৭ সালে শ্রেষ্ঠ যুব মহিলা হিসেবে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে সমবায় পুরস্কার পান।নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে দুস্থ মহিলা কল্যাণ সমিতির সভানেত্রী সাফিয়া খাতুন বলেন, এখন নারীরা আর ঘরে বসে নেই। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দেয়া হলে কোনো নারী আর দুস্থ থাকবে না। ধৈর্য ও সংগ্রাম করে আমি সফল হয়েছি। সন্তানদের মানুষ করেছি। ভবিষ্যতে আমার ইচ্ছা বৃহৎ আকারে হস্তশিল্পের শো-রুম করা এবং সরকারের সহায়তায় দেশের বাইরে নেপাল ও ভুটানের বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করা।এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণার্থী কামরুন্নাহার, শাকিলা বেগম ও রোকসানা বেগম জানান, সাফিয়া খাতুনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কাজ শিখে অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন এবং হচ্ছেন। যারা আগে কুটির ও হস্তশিল্পের কাজ জানতো না তারা আজ উপার্জনের পথ খুঁজে পেয়েছে। আমরাও এ কাজ শিখে স্বাবলম্বী হতে চাই। তাই এখানে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছি।ভবতোষ চৌধুরী নুপুর/এএম/জেআইএম

Advertisement