মতামত

তেলের বিজ্ঞাপনে চুল ধরে মার বনাম নারী অধিকার

দর্শকের আবেগের জায়গাকে পুঁজি করে বিজ্ঞাপন নির্মাণ নতুন কিছু নয়। সঠিকভাবে ভাবতে গেলে দোষেরও কিছু নয়। স্বাভাবিকভাবে, খোলা চোখে আমরা যা দেখি বেশিরভাগ সময়ই তা উপলব্ধি করতে পারি না। সেই একই দৃশ্য যখন নির্মাতারা বিজ্ঞাপন, নাটক কিংবা সিনেমার মাধ্যমে দেখান আমরা তার অন্তর্গত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারি। কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শিশু সন্তান কোলে দরিদ্র এক নারীর ছবি ভাইরাল হয়েছিল। মা ও শিশু দুজনেরই পরনে ময়লা, জোড়াতালি দেয়া পোশাক, শিশুটির নাক বেয়ে ঝরছিল সর্দি। বাস্তবে এরকম কাউকে দেখলে আমরা স্বভাবতই চোখ কুঁচকে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নেই। কিন্তু ডিএসএলআর-এ তোলা সেই ছবিটিতে দেখা যায় মা ও শিশু হাসছে, আর সেই হাসির ছবিটিকেই আমরা তখন বিশুদ্ধ হাসি, পবিত্র হাসি ইত্যাদি শিরোনাম দিয়ে আমাদের ওয়ালে শেয়ার করি। আমাদের দেখার যে চোখ, তা খুলে দেয়ার দায়িত্ব অনেকটাই লেখক, নির্মাতাদের। সম্প্রতি নারী দিবস উপলক্ষে নির্মাণ করা একটি নারকেল তেলের বিজ্ঞাপনে সেরকমটাই চোখে পড়ে। নারী নির্যাতন আমাদের দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। দেশের প্রায় আশি শতাংশ নারীই শারীরিক বা মানসিকভাবে পরিবার বা পরিবারের বাইরে নির্যাতিত হন। বিজ্ঞাপনটিতে দেখা যায় নামী কোনো রূপচর্চাকেন্দ্রে পোশাক-আশাকে ভদ্রস্থ (নামী রূপচর্চাকেন্দ্রে নিশ্চয়ই নিম্নবিত্ত বা নিরক্ষর কেউ যাবেন না) এবং আধুনিক একজন নারী তার চুল কাটাতে যান। রূপচর্চাকর্মীকে বলেন যেন তার চুল ছোট করে কেটে দেয়া হয়। রূপচর্চাকর্মী চুল কাটতে নিয়ে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেন এত সুন্দর চুল কেন কেটে ফেলতে চাইছেন, তিনি নানাভাবে অন্যান্য কাট দেয়ার জন্য প্রলুব্ধ করার চেষ্টাও করেন। তবে যিনি চুল কাটাতে গিয়েছেন তিনি তার সিদ্ধান্তে অনড়। চুল একদমই ছেঁটে ফেলতে চাইছেন তিনি। শেষপর্যন্ত কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আরো ছোট করে কেটে দিন, যেন (চুল মুঠি করে ধরে দেখান) এভাবে ধরা না যায়। অর্থাৎ সেই আধুনিক ও শিক্ষিত নারীটি (সম্ভবত তার স্বামীর হাতে) মার খান এবং মারের সময় তাকে চুলের মুঠি ধরে মারা হয়।বউ পেটানো এদেশের অনেক পুরুষের কাছেই এক ধরণের অধিকারের মতো। নারীকে ভালোবাসে এমন পুরুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বেশিরভাগ পুরুষ ভালোবাসা বলতে বোঝে দখলদারিত্ব। নারীকে কতটা দখলে রাখা যায়, এটাই তাদের কাছে ভালোবাসার পরিমাপক। নারীর সঙ্গে মতে মিলছে না, তাহলে সে নারী বেয়াদব অথবা বেহায়া। কিছুদিন আগে আমার লেখা প্রথম উপন্যাস প্রকাশ হয়। সেখানে মূল চরিত্র একজন নারীর। যার জীবনের কিছু ঘটনা তুলে ধরেছি। উপন্যাসটি পড়ে বেশকিছু পুরুষ পাঠক অবাক হয়ে আমাকে বলেছেন, এক জীবনে এত দুঃখ মানুষ কীভাবে সামলায়? এও কি সম্ভব? তাদের অবাক হওয়া দেখে আমি আরো বেশি অবাক হয়েছি, কারণ এর থেকে অনেক বেশি দুঃখ এবং কষ্টের জীবন আমি দেখেছি; এবং অবশ্যই তা একজন নারীর। এতে আমার যে ধারণাটি হলো, আমাদের পুরুষেরা নারীর দুঃখবোধের খোঁজ খুব একটা রাখেন না, হোক না তা হালকা কিংবা গভীর। আমাদের দেশে একটি ছেলে ছোটবেলা থেকেই দেখে দেখে বড় হয় যে তার মা তার পরিবারের জন্য রান্না করছে, তার বোনটি নিজের খাবারের ভাগ হয়তো নিজে না খেয়েই তার জন্য রেখে দিচ্ছে, মায়ের মতামতের তেমন একটা গুরুত্ব নেই পরিবারে, বোনটিকে হয়তো তার অমতেই বিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব দেখে বড় হওয়া ছেলেটি যে নারীর জন্য আলাদা মায়া অনুভব করবে না এটাই স্বাভাবিক। আমরা আমাদের লেখনীর মাধ্যমে, নির্মাণের মাধ্যমে পুরুষদের মধ্যে মমত্ববোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করবো। তাদের ভোতা অনুভূতি চোখা করার দায়িত্বও আমাদের। কিন্তু কৌশলে যেন তাদেরকে উস্কে দেয়া না হয়! তেলের বিজ্ঞাপনটিতে দেখানো হয়েছে শিক্ষিত এবং আধুনিক নারীটি মার খাচ্ছে এবং সে তা চেপেও যাচ্ছে। আমি বলছি না যে শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত নারীরা মার খাচ্ছে না, মার হয়তো অনেকেই খাচ্ছে। কিন্তু নারীটি যে সে বিষয়টি চেপে যাচ্ছে এবং চুল ধরে যাতে মারতে না পারে তাই চুলই কেটে ফেলছে- এটি দেখানো কতটুকু যৌক্তিক? মাথাব্যথা হলে কি আমরা মাথা কেটে ফেলি? মার যে শুধু চুল ধরেই দেয়া যায়- এমন তো নয়। যে চুল ধরে মারতে পারে, সে যেকোনোভাবেই আঘাত করতে পারে! যার কাছে মার খাচ্ছে, চুল কাটার পর আবার তার কাছেই ফিরে যাওয়া কতটুকু নিরাপদ?নারীরা আমাদের দেশে এখন অনেক ক্ষেত্রেই নিঃসন্দেহে অগ্রসর। একজন আধুনিক, শিক্ষিত নারী স্বামীর হাতে মার খাচ্ছে এবং তা গোপন রেখে সহ্য করে যাচ্ছে এরকমটা দেখিয়ে সহজেই দর্শককে আবেগপ্রবণ করা যায় এবং তাতে করে পণ্যের বিক্রিও হয়তো বাড়বে। একটা কথা মাথায় রাখা জরুরি, বিজ্ঞাপন নির্মাণের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ব্যবসায়। লাভের হিসাব না করেই তারা বিজ্ঞাপন নির্মাণ করেছেন এমনটা ভাবা বোকামী। কিন্তু এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দর্শকের মাথার মধ্যে এটাই কি আসন গেড়ে বসছে না যে, এমনটা ঘটাই স্বাভাবিক? নারী মার খাবে এবং তা চেপে গিয়ে তার সৌন্দর্যের সহায়ক চুল কেটে ফেলবে! আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা, জাতীয় সংসদের স্পিকার প্রত্যেকেই নারী। এমনই একটা দেশের নারকেল তেলের বিজ্ঞাপনে এমন চিত্র তুলে ধরা কতটুকু ইতিবাচক? আধুনিক, শিক্ষিত নারীটি মার খেয়ে তার প্রতিবাদ করছে- এরকমটা দেখানো হলো না কেন? দর্শকের আবেগপ্রবণ মনে এই বিষয়টিই কৌশলে স্বাভাবিক হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে না তো? আমাদের দরকার এমন নারীর যে আঘাত এলে তা প্রতিহত করতে পারে, চুপিচুপি নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়ে আঘাতকারীর কাছেই ফিরে যাওয়া দুর্বল নারী আমাদের দরকার নেই। দরকার নেই এমন বিজ্ঞাপনচিত্রের যেখানে নারীকে শুধু দুর্বল হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়। যে জাতির অর্ধেক জনসংখ্যা নারী, তাদের ভাবনা এবং নির্মাণ আরো অনেক বেশি সুচিন্তিত ও প্রসারিত হওয়া উচিৎ।এইচএন/আরআইপি

Advertisement