বিশেষ প্রতিবেদন

পুরুষ নয়, নারীর প্রতিপক্ষ হচ্ছে সামাজিক সিস্টেম

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। প্রসিকিউটর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল। বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি। বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে নারীর ক্ষমতায়ন, উন্নয়ন, অধিকার নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন জাগো নিউজের।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।জাগো নিউজ : পৃথিবী বদলাচ্ছে নিত্যদিন। নারীর ক্ষমতায়ন কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : এবারের বিশ্ব নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘সাহসী হও পরিবর্তন আনো’। আজকের দিনে নারীর অগ্রগতি যেমন আছে, তেমনি নারীর উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতাও আছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকায় নারীর অবদান প্রতিদিন বাড়ছে। গার্মেন্ট, কৃষি, নির্মাণসহ সবক্ষেত্রেই নারীর অবদান রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থনীতির এই ক্ষমতায়নে নারীর অধিকার কতটুকু? অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা গেলেও, সেই টাকায় নারীর নিয়ন্ত্রণ থাকছে, তা বলা যাবে না। নারীর টাকায় নিয়ন্ত্রণ থাকছে পুরুষের। সে পুরুষ বাবা, স্বামী, ভাই বা ছেলেও হতে পারেন। শ্রমের বিনিময়ে নারীর অর্জিত অর্থ সে কীভাবে খরচ করবে, সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না নারী। এ কারণেই অর্থনীতিতে নারীর অবদানের একটি সামগ্রিক চিত্র দেখলে নারীর ক্ষমতায়ন মূল্যায়ন করা যায় না।জাগো নিউজ : রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে কি বলবেন?তুরিন আফরোজ : তিন দশক ধরে সংসদের প্রধান নেতৃত্বে নারী। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী নারীরা দায়িত্ব পালন করছেন। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি নারী। উচ্চ আদালতের বিচারক নারী। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় বিপুলসংখ্যক নারী প্রতিনিধি রয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী এখনও বৈষম্যের শিকার।জাগো নিউজ : এ বৈষম্যের জন্য কোন বিষয়কে দায়ী করবেন?তুরিন আফরোজ : পুরুষ নয়, নারীর প্রতিপক্ষ হচ্ছে সামাজিক সিস্টেম। সামাজিক সিস্টেমে নারীর শত্রু নারীও হতে পারেন। পরিবারে একজন নারী দ্বারা অপর নারী বৈষম্যের শিকার হতে পারেন। এ কারণেই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই আমি নারী প্রতিবন্ধকতার জন্য দায়ী করব।জাগো নিউজ : তার মানে নিজেদের অধিকারে নারীকেই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে।তুরিন আফরোজ : অবশ্যই। পুরুষ হচ্ছে সামাজিক সিস্টেমের একটি মাত্র পার্ট। নারীকে বাদ দিয়ে তো আপনি এই সিস্টেমকে শিকার করতে পারেন না। সামাজিক সিস্টেমই নারীকে নারীর প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলছেন।জাগো নিউজ : সামাজিক এই সিস্টেম তো এক বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে।তুরিন আফরোজ : উত্তরাধিকার আইনের দুর্বলতার কারণেই নারীকে দু্র্বল পক্ষ ভাবা হয়। যতদিন নারী তার অধিকার ভোগে আইনের সমতা পাবে না, ততদিন এই নারীর প্রতি সামাজিক বৈষম্য থাকবেই।জাগো নিউজ : সিডও সনদে বাংলাদেশের ভূমিকা তো এখনও প্রশ্নবিদ্ধ?তুরিন আফরোজ : এটি আমাদের অবাক করেছে। জাতিসংঘের সিডও সনদের ভিত্তিতে নারীর প্রতি বৈষম্য রোধে যখনই উত্তরাধিকার আইনের কথা বলা হয়, তখনই বাংলাদেশ বলে নারীকে সমান অধিকার দেয়া যাবে না। যখনই নারীর সমতার কথা আসে, তখনই ধর্ম, মৌলবাদ, কুসংস্কারের প্রসঙ্গ সামনে আসে।জাগো নিউজ : ধর্ম, সামাজিক রীতিকে তো অস্বীকার করার উপায় নেই?তুরিন আফরোজ : ইসলাম ধর্মে নারীর প্রতি বৈষম্যের কথা কোথাও বলা নেই। সূরা আন নাসে নারীর অধিকারের কথা বলা আছে। ইসলামী চিন্তাবিদরাও একই মত দিচ্ছেন। ইসলামী চিন্তাবিদরা বলছেন, পরিবারে একজন পুরুষ যা পাবেন, অন্তত নারী তার অর্ধেক পাবেন। অর্থাৎ নারীকে পুরুষের বেশিও দিতে পারেন। সীমারেখা অতিক্রম করতে কোনো বাধা নেই। যখনই এই প্রসঙ্গে কথা ওঠে তখনই বলা হয় ইসলাম চলে যাবে।জাগো নিউজ : অন্যক্ষেত্রেও এমন প্রশ্ন ওঠে?তুরিন আফরোজ : হ্যাঁ। নারী মাঠে খেলতে নামলেই বলা হয় ধর্ম গেল। নারী যখন খেলে তখন পুরুষ দর্শকদের মাঠে প্রবেশে বাধার একটি আইন করলেই হয়। আমাদের অধিকাংশ আইন-ই অমুসলিম দেশ থেকে আনা। শত শত বছর ধরে সেই আইন দ্বারা সমাজ চলছে। অথচ নারীর উত্তরাধিকার আইনের কথা বলা হলেই ধর্মের কথা আসে। তার মানে ধর্ম শুধু নারীরাই রক্ষা করতে পারেন। পুরুষের জন্য আইন না, ধর্ম না।জাগো নিউজ : নারীও তো এ ক্ষেত্রে সরব না?তুরিন আফরোজ : নারীকে নিয়ে গালগল্প নারীরাই বেশি করেন। এটি আমাদের সামগ্রিক সিস্টেমের কারণেই হচ্ছে। নারীরাই নারীর সমালোচনায় মুখর। অধিকার নিয়ে তারা সরব হবে কখন?  জাগো নিউজ : দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থেকেছেন। বাইরে থেকেই ডিগ্রি নিয়েছেন। সেখানে নারীর অধিকার কেমন দেখেছেন?  তুরিন আফরোজ :  নারী হওয়ার কারণে হিলারি ক্লিনটন যখন বিজয়ী হতে পারেন না, তখন গোটা বিশ্বের নারী সমাজের চিত্র সহজেই অনুমেয়। বিশ্বজুড়েই নারীর ওপর একটি বোঝা চাপানো থাকে। কোথাও সে বোঝা সহজে অপসারণ করা যায়, কোথাও কঠিন হয়ে পড়ে। তবে উন্নত বিশ্বে নারীকে যে সমতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়, তা আমাদের এখানে হয় না।জাগো নিউজ : নারীর উন্নয়নে আপনার পরামর্শ কী?তুরিন আফরোজ :  নারীর অধিকার নিয়ে সবার আগে পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে। নারীর মুক্তির জন্য নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে। নারী যে একজন মানুষ, তা নারীকেও বুঝতে হবে। নারীকে আরও সচেতন হতে হবে। নিজের অধিকারের জন্য নিজের পরিবারকেই দুর্গ মনে করতে হবে।এএসএস/এমএস

Advertisement