বিশেষ প্রতিবেদন

নারীর মনস্তাত্ত্বিক বাধা আগে ভাঙতে হবে

নারীরা দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছেন। তারা প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন, সফল হচ্ছেন। কিন্তু পুরুষের তুলনায় এ হার অত্যন্ত নগণ্য। নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রধান বাধা ‘নারীরা নিজেরাই’- এমনটি মনে করেন পুলিশ কর্মকর্তা সহেলি ফেরদৌস। তার মতে, এখনো অধিকাংশ নারী নিজেদের চার দেয়ালের বাইরে বের করে আনতে পারেননি। সত্যিকার অর্থে নারীদের এগিয়ে যেতে হলে নিজেদের মনস্তাত্ত্বিক বাধা আগে ভাঙতে হবে।৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। ‘নারী-পুরুষের সমতায় উন্নয়ের যাত্রা, বদলে যাবে বিশ্ব, কর্মে নতুন মাত্রা’ স্লোগানে জেন্ডার বৈষম্য দূর করে নারীদের এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন চৌকস নারী পুলিশ কর্মকর্তা সহেলি ফেরদৌস। পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের এআইজির (সহকারী মহাপরিদর্শক) দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।খুলনা শহরে বড় হলেও অনেক বাধা মাড়িয়ে প্রতিযোগিতার এ সময় নিজের অবস্থান জানান দিয়ে এ পর্যায়ে এসেছেন সহেলি ফেরদৌস। সামাজিকভাবে জেন্ডার বৈষম্যের শিকার হলেও পারিবারিকভাবে পেয়েছিলেন অপার সহযোগিতা। গত রোববার পুলিশ সদর দফতরে নিজ কার্যালয়ে নারী দিবস উপলক্ষে ‘জাগো নিউজ’কে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে কর্মক্ষেত্রে নারীদের যোগ্যতা, বৈষম্য, পদায়ন, অধিকার ও মর্যাদার বিষয়ে কথা বলেন তিনি। নিচে তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-জাগো নিউজ: নারীদের প্রতি বৈষম্য সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাচ্ছি। সহেলি ফেরদৌস: যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী সে দেশে নারীদের পিছিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। নারীদের অগ্রগতি ও এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অবদান যুগান্তকারী। আমাদের মায়ের আমলে যে অবস্থা ছিল তা থেকে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছেন এখনকার নারীরা। তবে পুরুষের তুলনায় যদি বলেন, সুযোগ ও পারিপার্শ্বিকতার কারণে এখনো পিছিয়ে নারীরা। তবে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা এখনও নারীবান্ধব হয়নি। এ বৈষম্যই নারীদের পিছিয়ে থাকার মূল কারণ।জাগো নিউজ: পুলিশের বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন। এখন মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের এআইজির দায়িত্ব পালন করছেন। খুব কাছ থেকে নিজ বাহিনীতে নারীদের অবস্থান পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। এখানে নারীদের অবস্থান কেমন?সহেলি ফেরদৌস: নারীরা পুলিশে অসাধারণ ভালো করছে, যা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মানুষ বিশ্বাসই করতে চাননি। সরকারের আস্থার প্রতিদান নারী পুলিশ সদস্যরা পদে পদে কাজের মাধ্যমে প্রমাণ দিচ্ছেন। নারী ট্রাফিক কর্মকর্তারা বিশেষ করে নারী সার্জেন্ট হিসেবে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তারা প্রশংসা পাওয়ার মতো দায়িত্ব পালন করছেন। এখন তিন জেলায় পুলিশ সুপারের দায়িত্ব সফলভাবে সামলে যাচ্ছেন চৌকস তিন নারী কর্মকর্তা। নারীরা যে পারেন তা আর কল্পনায় নয় বাস্তবে দেখিয়ে দিচ্ছেন কাজের মাধ্যমে। জাগো নিউজ: নারীদের সমঅধিকার ও মর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে আপনি কতটা দায়ী করবেন? সহেলি ফেরদৌস: দেশে আগের তুলনায় জেন্ডার বৈষম্য কমে এসেছে। তবে এখনো কর্মক্ষেত্র, পরিবার ও সমাজে চলতে-ফিরতে নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা জিইয়ে রাখার কারণে এমনটি হচ্ছে। জেন্ডার সেন্স এথনো নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। লিঙ্গ সংবেদনশীলতা সবার মধ্যে এখনো আসেনি। অনেক নারীই হয়তো জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সেজন্য পরিবারের সমর্থন ছিল। তবে অধিকাংশ নারীই যোগ্যতা ও মেধা থাকা সত্ত্বেও অকালেই ঝরে যায় শুধু সহযোগিতা না পাওয়া এবং পুরুষতান্ত্রিকতার কারণে।জাগো নিউজ: পিছিয়ে থাকা কিংবা এগিয়ে যাওয়ার পথে নারীর নিজের সংকীর্ণ মানসিকতা কি অনেকাংশে দায়ী নয়? সহেলি ফেরদৌস: অবশ্যই। চমৎকার একটা কথা বলেছেন। আমার তো মনে হয়, নারীরা তাদের নিজেদের কারণে পিছিয়ে। নারী যতটুকু এগিয়ে তার জন্য পরিবার কিংবা সমাজের সহযোগিতা ছিল। কিন্তু এর চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে ওই নারীর নিজের আগ্রহ ছিল বেশি। সংকীর্ণতার খোলস ভেঙে নিজেকে উপস্থাপন করতে পেরেছে বিধায় এগিয়েছে নারীরা। নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রধান বাধা নারীরা নিজেরাই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা হয়তো সেকেন্ড বাধা। নারীর প্রথম বাধা তাদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা। সে বাধা পার হতে পারলে পথ পরিষ্কার।জাগো নিউজ: পুলিশে নারী সদস্যদের অবস্থান সম্পর্কে যদি বলতেন?সহেলি ফেরদৌস: নারী সদস্যদের নানা প্রতিকূলতা পার হয়ে কাজ করতে হয়। নারীকে এখনো প্রমাণ করতে হয় পুরুষের ন্যায় আমরাও পারি। কিন্তু একজন পুরুষ পারবে কি পারবে না তা খেয়াল করা হয় না। এখানে সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক বৈষম্যের শিকার নারীরা। বর্তমানে পুলিশে নারীর সংখ্যা ৬.০ শতাংশ। তাহলে বুঝুন পুলিশে নারীদের অবস্থা! যদিও গত তিন বছরে পুলিশে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। আমার মনে হয় পুলিশে বেশকিছু সেক্টর রয়েছে, যেখানে নারীরাই বেশি সফলতা পাবে।জাগো নিউজ: মেধা কিংবা যোগ্যতার কারণে কি নারীরা পিছিয়ে যাচ্ছেন?সহেলি ফেরদৌস: যোগ্যতা ও মেধা নারীর যথেষ্ট রয়েছে। কিন্তু স্পেস না পাওয়ার কারণে তা প্রমাণ হচ্ছে কম। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘সমানে সমান’ মানসিকতা এখনো তৈরি হয়নি। তবে যতটুকু সুযোগ নারীরা পেয়েছেন, তারা প্রমাণ দিয়েছেন। আমাকে কখনো শুনতে হয়নি আমি নারী। পুলিশে পুরুষ সদস্যরা যতটা না অপরাধের ধরনভেদে শাস্তি পেয়েছেন সে তুলনায় নারীরা বেশ সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন।জাগো নিউজ: বর্তমানে ব্যবসা, চাকরি, শিক্ষা, রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে নারীদের উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? সহেলি ফেরদৌস: অবশ্যই এটা ভালো দিক। যেকোনো দেশকে এগিয়ে যাওয়ার প্রধান শর্ত তো সমানে সমান অংশীদারিত্ব, দায়িত্ব ও কর্তব্য। বাংলাদেশে নারীকে নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে দেখার মানসিকতা যত দ্রুত তৈরি হবে, তত দ্রুত নারীরা এগিয়ে যাবে, এগিয়ে যাবে দেশ।জাগো নিউজ: এবারের নারী দিবসে নারীদের এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আপনার ব্যক্তিগত অভিমত জানতে চাচ্ছি? সহেলি ফেরদৌস: নারীদের এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সবার আগে তাদেরই সংশোধন হতে হবে। নিজেদের খোলস থেকে বের করে আনতে হবে। ভাবতে হবে, কাজে-কর্মে তা প্রমাণ করে প্রস্তুত হতে হবে। কোনো বাধাকে ভয় পেলে চলবে না। পৌরুষোচিত মানসিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের কাজটা সঠিক সময়ে সফলভাবে শেষ করতে হবে। একটি দিন শুধু নারীর নয়, জেন্ডার বৈষম্যের ঊর্ধ্বে সবাইকে ভাবতে হবে, ৩৬৫ দিনই হবে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার দিন।জেইউ/এমএআর/এমএস

Advertisement