প্রায় ১৩ বছর ধরেই হত্যাকাণ্ডটি ছিল রহস্যে ঘেরা। কোনো ক্লু ছিল না। কয়েক দফা মামলাটির ফাইনাল রিপোর্টও দেয় সিআইডি। এরপরেও অনেকটা নাটকীয়ভাবে বগুড়ার সাংবাদিক দীপংকর চক্রবর্তীকে হত্যার চাঞ্চল্যকর মামলাটির ক্লু-আসে পুলিশের হাতে। ঢাকার হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী শীর্ষ জেএমবি নেতা জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী বগুড়ার আদালতে এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। চার সদস্যের কিলিং গ্রুপে তিনি নিজেও অংশ নিয়েছিলেন বলে আদালতকে জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, বিগত ২০০৪ সালে এই হত্যাকাণ্ডটি করা হয়েছিল জেএমবির শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই ও শায়খ আব্দুর রহমানের জামাতা শায়খ আব্দুল আউয়ালের নির্দেশে।মঙ্গলবার বগুড়ার পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, হলি আর্টিসান হামলার আসামি রাজিব গান্ধী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে, জেএমবির শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই ও শায়খ আব্দুর রহমানের জামাতা শায়খ আব্দুল আউয়ালের নির্দেশে সাংবাদিক দীপংকর চক্রবর্তীকে হত্যা করা হয়। দীপংকর চক্রবর্তী জেএমবি ও বাংলা ভাইকে নিয়ে লেখালেখির কারণে তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। হত্যাকাণ্ডে রাজীব গান্ধীসহ আরো তিন জন অংশ নেয়। এরা হলেন- জেএমবির কিলিং গ্রুপের সদস্য মানিক, সানাউল্লা এবং নুরুল্লাহ। বগুড়ার জহুরুলনগরে একটি ছাত্রবাসে বসে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। হত্যার আগের রাত ১০টায় মানিক মোটরসাইকেলে করে সানাউল্লা ও নুরুল্লাহকে নিয়ে শেরপুরে যান। এর আগে বাসে সেখানে পৌঁছে রাজীব গান্ধী। নিহত সাংবাদিক দীপংকর চক্রবর্তীরাজীব গান্ধীর দায়িত্বে ছিল গতিবিধি লক্ষ্য করা, আর হত্যার মূলদায়িত্বে ছিলেন সানাউল্লা ও নুরুল্লাহ। রাত ১২টায় বগুড়া থেকে কাজ শেষে সাংবাদিক দীপংকর চক্রবর্তী শেরপুরে নেমে একটি হোটেলে চা পান করেন। পরে ফেরার পথে বাড়ির গেটের ঠিক সামনে তাকে হত্যা করা হয়। নিহত দীপংকর চক্রবর্তী ছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সহ-সভাপতি ও স্থানীয় দৈনিক দুর্জয় বাংলার নির্বাহী সম্পাদক। বিগত ২০০৪ সালের ২ অক্টোবর রাতে শেরপুর উপজেলার সান্যালপাড়ায় নিজ বাড়ির সামনে নির্মমভাবে অজ্ঞাত পরিচয় দুষ্কৃতকারীরা তাকে হত্যা করে। হত্যাকারীরা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার দেহ থেকে মাথাকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। তৎকালীন সময়ে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বগুড়াসহ সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ঘটনার পরপরই দীপংকর চক্রবর্তীর ছেলে পার্থ সারথী চক্রবর্তী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি প্রথমে শেরপুর থানা পুলিশ তদন্ত করে। পরবর্তীতে তদন্তভার পায় সিআইডি পুলিশ। তারাই প্রথম ২০০৭ সালের ২৬ নভেম্বর আদালতে ক্লু-লেস মামলা হিসেবে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেছিল। এরপর বাদীর নারাজি আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটি পুনরায় তদন্তের আদেশ হয় এবং ২য় দফার তদন্তভার পুনরায় সিআইডিকে দেয়া হয়। এরপর সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুস সামাদ মিঞা ২০১৩ সালের ১৩ জুলাই আবারো একই ধরনের চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেন। বাদীর পুনরায় নারাজি আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটির তদন্তভার ২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বগুড়ার ওপর দায়িত্ব প্রদান করে। পুলিশ সুপার জানান, ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিসান হামলার অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী জাহাঙ্গীর আলম ওরফে নাছির ওরফে রাজীব গান্ধী ওরফে সুভাস ওরফে জাহিদ ওরফে জাকির ওরফে আদিল ওরফে টাইগার ওরফে আবু ওমর আল বাঙ্গালকে (৩৩) ইতোপূর্বে বগুড়া পুলিশ গ্রেফতার করে। তাকে শেরপুরের জোয়ানপুরে জেএমবি আস্তানায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ড নেয়া হয়। এ সময় ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে অতীত কর্মকাণ্ডের বর্ণনাকালে রাজীব গান্ধী সাংবাদিক দীপংকর খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন। জেএমবি নেতা জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীপুলিশ সুপার আরো জানান, মামলাটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সহ-সভাপতি ও স্থানীয় দৈনিক দূর্জয় বাংলার নির্বাহী সম্পাদক সাংবাদিক দীপংকর চক্রবর্তীকে ২০০৪ সালের ২ অক্টোবর রাতে বাড়ির গেটের সামনে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে। ২০০৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মামলাটি থানা পুলিশ, ডিবি পুলিশ, সিআইডি পুলিশের ১২জন কর্মকর্তা তদন্ত করেছে। ২০১২ সালে সিআইডি পুলিশ বগুড়ার চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলাটির চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেয়। এরপর বাদী নিহতের ছেলে পার্থ সারথী চক্রবর্তীর নারাজি আবেদনের প্রেক্ষিতে কয়েক দফা শুনানির পর বগুড়ার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক ২০১৪ সালে মামলাটি পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন। নির্দেশনা অনুসারে ১২নং তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে ডিবির এসআই মজিবর রহমান সেটি তদন্ত করছেন। মামলাটি ক্লু-লেস বলে আদালতে চার বার চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়া হয়। তবে, সেই রিপোর্টে বলা হয় হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত ছিল। লিমন বাসার/আরএআর/পিআর/জেআইএম
Advertisement