আজ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সেই বিখ্যাত ভাষণের দিন, যে ভাষণ বাঙালি জাতিকে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত করেছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের এইদিনে বসে কি কারো পক্ষে একটুও ভাবা সম্ভব যে, আসলে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ৭ তারিখে এই ভাষণ দেয়া নিয়ে সেদিন এই শহরে কী হয়েছিল? বঙ্গবন্ধু এই ঐতিহাসিক ভাষণ দেওয়ার প্রাক্কালে কী পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন? বাঙালি জাতিই বা সামগ্রিক ভাবে কী ভয়ঙ্কর অবস্থার ভেতর ছিল? পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কী করছিলো? দেশের ভেতরকার স্বাধীনতা-বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দ কী করছিলো? কিভাবে সবদিক সামলে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ৭ই মার্চের এই ভাষণটি দেয়া সম্ভব হয়েছিল? এরকম হাজারো প্রশ্ন নিয়ে আজকে আমরা আলোচনা করতে পারি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা লক্ষ্য করেছি যে, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার তাগিদ আসলেই কম ছিল। এমনকি ২০০৭/২০০৮ সালের ৭ই মার্চের দিন এদেশে বঙ্গন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচারও করা হয়নি। এর আগে আওয়ামী লীগ ভিন্ন অন্য সরকারগুলির আমলেও জাতীয়ভাবে ৭ই মার্চকে পালন করা হয়নি, আওয়ামী লীগ দলীয় ভাবে দিবসটি পালন করেছে। অথচ, যে কোনো দেশে, যে কোনো জাতির জীবনেই ৭ই মার্চের মতো কোনো দিন থাকলে সেটি সম্মিলিত ভাবেই অর্থাৎ দল-মত-নির্বিশেষে দিবসটি জাতীয় দিবস হিসেবেই পালিত হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা বাংলাদেশের কথা বলছি, বাঙালি জাতির কথা বলছি, যে জাতি কখনওই কোনো বিষয়ে একমত হতে পারে না, সেটি ১৯৭১ সালে যেমন ছিল তেমনই ২০১৭ সালেও আছে। কিন্তু আজকের এই লেখায় ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের আগের রাত ও সেই দিনটি নিয়ে কিছু কথা বলতে চাইছি। অবশ্যই সে জন্য আমি মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ও কিছু বইয়ের সাহায্য নিয়েছি। লেখার শেষে এ সম্পর্কিত তথ্যসূত্র দেওয়া থাকবে আগ্রহী পাঠকের জন্য। কেমন ছিল ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ? বিভিন্ন তথ্য ও পুস্তকাদি ঘেঁটে দেখা যায় যে, পাকিস্তানের সামরিক সরকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে মোটেও আগ্রহী নয় যেহেতু সংখ্যারগিষ্ঠের হাতেই সেক্ষেত্রে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই হবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃবৃন্দ অর্থাৎ ইয়াহিয়া ও ভুট্টো, দু’পক্ষই নিশ্চিত যে তারা কোনো ভাবেই বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। ভুট্টোর লারকানার জমিদারীতে গিয়ে দুই নেতা মাস্তি’ করার ছলে এরকম সিদ্ধান্তই নিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় লারকানায় দুই পাকিস্তানী নেতার ছবি বেরিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগ নিজেদের কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করছেন এদেশে বসে। সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু আওয়ামী লীগ তথা দেশকেও তিনি প্রস্তুত করছেন একটি যুদ্ধের জন্য। আজকে অনেকেই একথা স্বীকার করতে চান না কিন্তু পাকিস্তানী অ্যাকাডেমিক বা সামরিক কর্মকর্তাদের লেখা পুস্তক বা সংবাদপত্রের নিবন্ধগুলো যদি দেখি তাহলে দেখতে পাই যে, তারা স্পষ্ট ভাষায় একথাই লিখছেন যে, একদিকে ভুট্টো-ইয়াহিয়া পাকিস্তানে বসে বাঙালি হত্যার ছক কষছেন (একথা তারা স্বীকার করেননি বটে, কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয় না) আরেকদিকে পূর্ব পাকিস্তানে (যদিও বঙ্গবন্ধু পঞ্চাশের দশকেই পাকিস্তান গণপরিষদে বক্তৃতা দিয়ে বলেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান বলা যাবে না, বলতে হবে পূর্ব বাংলা কারণ এই নামটি এই অংশের জনগণের মুখের ভাষা ও জীবনাচরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। যদি পূর্ব পাকিস্তান বলতেই হয় তবে পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে তবেই এই নামে ডাকা যেতে পারে, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু তখনও গণভোটের ওপর জোর দিচ্ছেন একজন আপাদমস্তক গণতান্ত্রিক নেতার মতো) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার দল সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে পাকিস্তানীদের মোকাবিলার জন্য। মজার ব্যাপার হলো, পূর্ব বাংলায় ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর থেকেই পাকিস্তানের জাতীয় দিবসগুলির কোনোটিই আর সর্বাত্মকভাবে পালন করা হয়নি। বিশেষ করে একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নেতা হিসেবে কোনো জাতীয় দিবসেই বঙ্গবন্ধু বা অন্য জাতীয় নেতারা অংশ নেননি। পাকিস্তানী সামরিক সরকার ও তাদের আজ্ঞাবহ বুদ্ধিজীবীদের কাছে বিষয়টি কেবল অস্বস্তিকরই ছিল না, তারা পরবর্তীতে এ বিষয়টিকে অত্যন্ত জোরালো ভাবে উপস্থিত করেছেন। একটি অত্যন্ত সুদক্ষ ও প্রশিক্ষিত সেনা বাহিনীর সঙ্গে যুঝবার জন্য তৈরি হচ্ছে একটি জাতি, যদিও সেই জাতিটি খানিকটা হলেও বিভক্ত। আমরা কি একথা জানি যে, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় সারা দেশে পাকিস্তানের ইসলাম-নির্ভর রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনের পর থেকেই একের পর এক জনসভা করে যাচ্ছিলো? বিশেষ করে ফেব্রæয়ারিতে যখন বাঙালি একুশে ফেব্রæয়ারি উদযাপন করছে তখন একের পর এক জনসভা হচ্ছে কুমিল্লায়, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন শহরে। মার্চ মাসের শুরুতেই বেশ কয়েকটি জনসভা আহ্বান করে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগসহ ইসলাম-নির্ভর রাজনৈতিক দলগুলি। তারা এসব জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতায় একমাত্র ইসলামকে মুখ্য উপাদান হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে। এরকমই একটি জনসভা যা জামায়াতে ইসলামী আয়োজন করেছিল, আওয়ামী লীগ সেটা পণ্ড করে দেয়। এরপর দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইসলাম-নির্ভর রাজনৈতিক দলগুলি আসলে কোনো ধরনের সভা করতেও ভয় পেতো বলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের লেখনী থেকে জানা যায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তারা একথা জোর দিয়েই বলেন যে, সত্তরের নির্বাচনের পর থেকেই পূর্ব বাংলায় এক অভূতপূর্ব বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ার সৃষ্টি হয়। যে জোয়ারে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা বিশাল এক ভূমিকা পালন করে। তারা একথাও বলতে চান যে, শেখ মুজিব বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই নবজাগরণে বিভিন্ন আয়োজনে সশরীরে যোগ দেন এবং তার দলের নেতারাও তাতে যোগ দিয়ে উত্তেজনাকর বক্তব্য রাখেন। শেখ মুজিব নিজে প্রকাশ্যে ও ঘরের ভেতর যে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা পাঠ করতেন সেকথা পাকিস্তানীদের লেখায় একাধিকবার পাওয়া যায়। পুরো মার্চ মাস জুড়ে বাঙালি ও পাকিস্তানীদের মধ্যে যে টানাপড়েন তা আসলে আর কিছুই নয়, দু’পক্ষেরই সময় ক্ষেপণ। পাকিস্তানী সামরিক সরকার এই সময় ধরে পাকিস্তান থেকে সেনাবাহিনী আনার কাজটি শেষ করছে আর বাঙালি নেতৃত্ব তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দল ও জাতিকে তৈরি করছেন যুদ্ধের জন্য। ঢাকা শহরের যে বর্ণনা পাকিস্তানীদের কাছ থেকে পাওয়া যায় তা মূলতঃ অসহযোগের এবং পাকিস্তানকে অস্বীকারের। যেমন পূর্ব বাংলা থেকে কোনো সম্পদ যাতে পাকিস্তানে যেতে না পারে সে জন্য বিমানবন্দরে যাওয়ার পথগুলোতে জনগণ ব্যারিকেড বসায়। সেসব ব্যারিকেডে অবাঙালিদের তল্লাশি করা হতো বলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সামরিক কর্মকর্তাদের বিবরণ থেকে জানা যায়। এরকমই এক তল্লাশির সময় একজন পাঠানকে হত্যা করা হয় বলেও দাবি করা হয়েছে। ধরে নিচ্ছি পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তারা অতিরঞ্জিত বক্তব্য দিয়েছেন কিন্তু ব্যারিকেড যে দেয়া হয়েছিল সেটাতো সত্য। বিমাবন্দর দিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঢাকায় আসছে এই খবর কোনো বাঙালির কাছেই অজ্ঞাত ছিল না। এমনকি দু’জন বাঙালি যুবক পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের বিমান উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বলে অজুহাত দিয়ে বিমানবন্দর থেকে সকল বাঙালি কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়া হয় এবং পাকিস্তান সেনা ও বিমানবাহিনী বিমানবন্দরের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। ঘটনা যখন এতোটাই সঙ্গীন তখনই ৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জিওসি’র পক্ষ থেকে একটি বার্তা পাঠানো হয়, যদিও পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তারা দাবি করেন যে, শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে দু’র দূত এসেছিল জিওসির কাছে গভীর রাতে, তাদেরকেই জানানো হয়েছিল কিন্তু যেভাবেই হোক বার্তাটি শেখ মুজিবকে দেয়া হয়েছিল তাতে কোনোই সন্দেহ নেই, সেখানে স্পষ্টভাষায় বলা হয়েছিল, তিনি (শেখ মুজিব) যদি পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেন, তাহলে আমি সম্ভাব্য সব কিছুই জড়ো করবো। বিশ্বাসঘাতকদের হত্যার জন্য ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিনগানÑ সবই এবং প্রয়োজন যদি হয় ঢাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবো, যাতে এখানে শাসন করার জন্য বা শাসিত হওয়ার জন্য কিছুই না থাকে” (সিদ্দিক সালিক, উইটনেস টু সারেন্ডার)। শেষ করি আজকে আরেকটি তথ্য দিয়ে, তাহলো, ৭ই মার্চ ভোর বেলা পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন এবং স্পষ্ট ভাষায় শেখ মুজিবকে হুশিয়ার করে দেন যে, মুজিবের বিচ্ছিন্নতাবাদী পদক্ষেপকে আমেরিকা সমর্থনতো করেই না, বরং তাকে জোরালো ভাবে প্রতিহত করা হবে। পাকিস্তানী সেনা বাহিনীতো জানিয়েই দিয়েছিল রাতে, সকালে যুক্তরাষ্ট্রও জানালো, আমাদের জানা দরকার যে, আরো কোন্ কোন্ শক্তি বঙ্গবন্ধুকে সেদিন একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে নিষেধ করেছিল, ইতিহাস একদিন সে তথ্যও আমাদের জানাবে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেদিন একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়েও যে কথা বলেছিলেন তাতে বাঙালির বুঝতে বাকি ছিল না যে, বঙ্গবন্ধু কী বলতে চেয়েছেন। মেজর জিয়াউর রহমানের মতো একজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তাও কিন্তু সেদিন ঠিক বুঝে গিয়েছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার ঘোষণাই শুনিয়েছেন (বিচিত্রা, ১৯৭৪)। জিয়ার মতো সামরিক ব্যক্তিত্ব যদি এটুকু বুঝে থাকেন তাহলে বাঙালি জাতি ৭ই মার্চের ভাষণ থেকে কী বুঝেছিল, সেটা একবার ভেবে দেখুনতো? জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। ঢাকা ৭ই মার্চ, মঙ্গলবার ২০১৭লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.comএইচআর/পিআর
Advertisement