মতামত

নারী দিবস এবং বৈষম্যহীনতার পথ

বাংলাদেশের আনাচে কানাচে প্রতিনিয়ত যে নারীরা খুন, ধর্ষণ, অপহরণ ও হামলার শিকার হচ্ছেন তাদের জন্য বিশ্ব নারী দিবস কি বার্তা বয়ে আনছে? খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের ছাত্রী ইতি চাকমাকে গলা কেটে খুন করা হয়েছে। কক্সবাজারে নাহিদা আক্তার নামে এক ছাত্রীকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করেছে জাহেদুল ইসলাম নামে এক বখাটে। কেন? কারণ সে নাকি ওই দুর্বৃত্তের ‘প্রেমের প্রস্তাবে’ সাড়া দেয়নি। এদিকে মিতু হত্যাকাণ্ডে এবার সন্দেহের তীর তারই স্বামী বাবুল আক্তারের দিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ। প্রশ্ন উঠতে পারে কোথায় নিরাপদ নারী? জন্মের আগেই কন্যাশিশুর ভ্রূণকে হত্যা করা হয়। জন্মের পর মেয়ে জন্ম দেওয়ার অভিযোগে মাকে তালাক তো ঘটছে হরহামেশা। এমনকি কন্যাশিশুকে মেরে ফেলাও হচ্ছে হয়তো আঁছড়ে ফেলে কিংবা পুকুরে ছুঁড়ে দিয়ে। আর না হলে অযত্নে অবহেলায় বেড়ে উঠছে সে। আর পারিবারিক নির্যাতন, স্বামী ও শ্বশুরপক্ষের আত্মীয়দের হাতে খুন এগুলো তো কোনো বিষয়ই না। পথে ঘাটে যৌন হয়রানি, খুন ধর্ষণ, অপহরণ চলছে তো চলছেই। কে রুখবে বখাটেদের। এখন তো আবার বিশেষ বিধানে শিশু বয়সে তাকে বিয়ে দিতেও আর আইনি বাধা নেই। বাল্যবিবাহ যদি অভিভাবক দরকার মনে করে তাহলে দিতে পারবে। যখন অভিভাবক মনে করেছিল ‘সতীদাহ’ দরকার তখন যেমন নারীকে চিতায় উঠিয়ে দিয়েছে জীবন্ত অবস্থাতেই। তেমনি এখনও যদি অভিভাবক মনে করে মেয়েটির লেখাপড়ার দরকার নেই তাকে বিয়ে দিলেই ‘মঙ্গল’ তাহলে তাই দেওয়া হবে। আবার যদি কোনো বয়স্ক ব্যক্তি মনে করে শিশুকে বিয়ে করবে বা ‘দখল’ করবে আর অভিভাবকরা তার টাকা বা প্রভাবের কাছে বিক্রি হয় তাহলে সেই শিশুটিকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিতেও আর কোনো বাধা নেই।  এমন পরিস্থিতিতেই ৮ মার্চ পালিত হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ বছর দিবসের শ্লোগান হলো ‘নারী পুরুষ সমতায় উন্নয়নের যাত্রা, বদলে যাবে বিশ্ব, কর্মে নতুন মাত্রা।’ বাল্যবিবাহ, নির্যাতন এসব নিয়ে সমতাভিত্তিক উন্নয়নের যাত্রা অব্যাহত থাকবে কিভাবে আমার বোধগম্য নয়। এরই ফাঁকে একটি ছোট খবরের দিকে চোখ আটকে গেল। খবরটি খাদিজা ও বদরুল প্রসঙ্গে। খাদিজাকে মনে আছে তো? সেই যে পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পর পর যাকে চাপাতি দিয়ে মারাত্মকভাবে কোপানো হয়। যার বেঁচে থাকারই কথা নয়। শুধুমাত্র অসীম প্রাণশক্তিতে ও কপালজোরে বা বলা যায় সৃষ্টিকর্তার কৃপায় বেঁচে যায় সিলেটের যে মেয়েটি। তার কথাই বলছি। তো বেঁচে ওঠার ফলে সে এখন তার উপর হত্যাচেষ্টার মামলায় নিজেই সাক্ষ্য দিতে পারছে। সেই সংক্রান্ত খবরে বলা হয়েছে আদালতে হামলাকারী বদরুল নাকি খাদিজার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে ‘আমার ফাঁসি হোক কিন্তু তুমি সুখে থাকো। কিন্তু তুমি সত্যি কথা বলো।’ ফিল্মিস্টাইলে ছুঁড়ে দেওয়া এ ধরনের সংলাপ পড়লে কি মনে হয় না যে বদরুল একজন হিরোটাইপের মানুষ? এখানেই শেষ নয় আরও আছে। আদালতে বদরুলের আইনজীবী বারে বারে প্রমাণ করার  চেষ্টা করছেন যে খাদিজার সঙ্গে নাকি বদরুলের ‘প্রেম’ ছিল। খাদিজা সেই প্রেম ভেঙে দেওয়াতেই নাকি বদরুল ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে কুপিয়েছে। সংবাদটি পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম এই ধরনের সওয়াল জবাবের মানে কি? আইনজীবী কী প্রমাণ করতে চান? ধরলাম খাদিজার সঙ্গে বদরুলের প্রেম ছিল। পরে খাদিজা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাতে কী হলো? তাহলে কি হত্যাচেষ্টা বৈধতা পায়? কোন আইনের বলে? বরং বদরুলের আইনজীবী তাকে বাঁচানোর জন্য আইনি প্রশ্ন তুলতে পারতো যে কুপিয়েছে সেই বদরুল কি না। যদিও এ ঘটনার ভিডিও আছে, আছে শত শত সাক্ষী। হত্যা চেষ্টা মামলায় বদরুলের যথাযথ শাস্তি হওয়া যেখানে প্রয়োজন সেখানে কি না প্রশ্ন উঠছে বদরুলের সাথে তার প্রেম ছিল  কিনা। যদি প্রেম থাকে তাহলে কি কোপানোর বৈধতা পাওয়া যায়? এ ধরনের খবর পরিবেশনের সময় মিডিয়ারও একটু সচেতন হওয়া প্রয়োজন। বদরুলের মতো মারাত্মক অপরাধীদের যেন কোনোভাবেই ‘প্রেমিক’, ‘হিরো’ ইত্যাদি বনে যাওয়ার কোনো অবকাশ না থাকে। কক্সবাজারে বখাটের আক্রমণের শিকার নাহিদা আকতার, খাগড়াছড়িতে খুন হওয়া ইতি চাকমা আর প্রতিনিয়ত খুন ধর্ষণের শিকার আদিবাসী, বাঙালি, পাহাড়ি, সমতলবাসী, সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু সকল নারীর কাছে যেদিন সমঅধিকারের বার্তা পৌঁছাবে সেদিন আর কত দূরে জানি না। আর সেইসঙ্গে দেশের প্রতিটি পুরুষ কবে নারী-পুরুষ সকলের অধিকার নিয়ে সচেতন হবে, নিজের পুরুষতন্ত্রের খোলস ছিঁড়ে মানুষ হয়ে উঠবে জানি না। কবে ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্রহননে ব্যস্ত না হয়ে সম্মিলিতভাবে ধর্ষকের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হবে জানি না। ১৯১০ সালে ক্লারা জেৎকিন যে নারী দিবস ঘোষণা করেছিলেন জানি না আর কত শতাব্দি পরে তা সমানাধিকারের, বৈষম্যহীনতার আলোয় সার্থক হবে, উজ্জ্বল হবে। এই লড়াইতে শুধু নারী নয়, সামিল আছেন সকল বিবেকবান পুরুষ। নারীর মুক্তি, নারীর অধিকার মানবাধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হোক নারীর অধিকার, প্রতিষ্ঠিত হোক সকল নাগরিকের মানবিক অধিকার। বৈষম্যহীন বিশ্বের পথে সফল হোক নারীর অগ্রযাত্রা। সবাইকে নারী দিবসের অগ্রিম সংগ্রামী অভিবাদন।লেখক : কবি, সাংবাদিক। এইচআর/এমএস

Advertisement