আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশি জাকিরের জন্য কাঁদছে নিউইয়র্ক

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ছুরিকাঘাতে নিহত রিয়েল স্টেট ব্যবসায়ী জাকির খান ছিলেন সেখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটির অত্যন্ত জনপ্রিয় মুখ। বাড়িওয়ালার সঙ্গে দ্বন্দ্বে প্রাণ যায় তার। নিউইয়র্কের ব্রঙ্কসের বাসায় গত বুধবার বাড়িওয়ালার ছুরিকাঘাতে এই বাংলাদেশির মৃত্যু মেনে নিতে পারছ্নে তার পরিচিতজনরা। বাংলাদেশি কমিউনিটিতে বইছে শোকের বন্যা। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাংলাদেশি নাগরিক ও নিউইয়র্ক শহরের ব্রঙ্কস সি কলেজের গণিতের শিক্ষক রাশিদুল বারী। জাকির খান ছিলেন তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। জাকিরের চলে যাওয়ায় বাংলাদেশি কমিউনিটির লোকজন এখনো কাঁদছেন। রাশিদুল বারী হাফিংটন পোস্টে এক কলামে সেই কান্নার কথা তুলে ধরেছেন। ‘জাকিরের জন্য কান্না’ শিরোনামে লেখা ওই কলাম জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।রাশিদুল বারী লিখেছেন, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। ব্রঙ্কস সি কলেজে গণিতের ক্লাস নিচ্ছিলাম। ক্লাসের মাঝামাঝি সময়ে আমার ফোনে একটি মেসেজ আসে স্ত্রীর নাম্বার থেকে; ‘বাড়িওয়ালার ছুরিকাঘাতে জাকির খান মারা গেছেন।’ ফোন অব করে ক্লাসে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করছিলাম। চকবোর্ডে কিছু লেখার লড়াই করছিলাম। আমার এক শিক্ষার্থী প্রশ্ন করেন, প্রফেসর, সবকিছু ঠিক আছে? জবাবে আমি বললাম, হ্যাঁ সবকিছু ঠিক আছে। তবে সবকিছু যে ঠিক ছিল না তা প্রমাণিত হলো এবং আমি ক্লাস নেয়া বন্ধ করে দিলাম। শিক্ষার্থীদের পারিবারিক সমস্যার কথা বলে বিদায় নেই। যখন সবাই চলে যায়, নিজেকে প্রশ্ন করি, ‘কেন পারিবারিক প্রয়োজনের কথা বললাম?’ জাকির খান তো আমার পরিবারের সদস্য নন। এমনকি তিনি আমার বন্ধুও নন। আসলে তার সঙ্গে আমি কখনো দেখাও করিনি। তিনি আমার ফেসবুক বন্ধু ছিলেন মাত্র। আমার ৫ হাজার ফেসবুক বন্ধু আছে এবং আমি এদের অনেককেই চিনি না। সুতরাং খানের জন্য কেন আমার চোখের জল ফেলানো উচিত? ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির একটি গল্পে ফেরা যাক। আমি তখন প্রফেসর হইনি; আসলে আমি একজন সিকিউরিটি গার্ড ছিলাম।আমার পরিবার, স্ত্রী ও ছেলে আলবার্টের জন্য জরুরিভিত্তিতে একটি কক্ষ (অ্যাপার্টমেন্ট নয়) খুঁজছিলাম, (তখন আইজ্যাক জন্মগ্রহণ করেনি) সম্প্রতি সে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছে। (স্ত্রী ও ছেলে আসার আগে আমার কোনো বাসা ছিল না কারণ, আমি রাতে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কাজ করতাম এবং দিনের বেলা স্কুলে যেতাম)। যাহোক প্রত্যেক বাড়িওয়ালা আমার আয় সম্পর্কে জানার পর আমাকে ফিরিয়ে দিতো। কেউ বুঝতে চেষ্টা করেনি যে, সিকিউরিটি গার্ড বেশি অর্থ পায় না। এছাড়া আমার টিউশন ফিও পরিশোধ করতে হতো। এজন্য আমার স্ত্রী ও ছেলেকে কিছুদিনের জন্য আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় রেখেছিলাম। আমি অনেক মানুষের কাছে গিয়েছিলাম কিন্তু একজন দরিদ্র সিকিউরিটি গার্ডের জন্য কারো সময় ছিল না। এমন সময় মূলধারার একটি সংবাদপত্রে খানের সম্পর্কে একটি নিবন্ধ পড়েছিলাম। ‘পার্কচেস্টার রিয়েল স্টেট রাজা জাকির মার্কিন স্বপ্নে বসবাস করছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ চ্যাম্পিয়নশিপ গলফ কোর্সের পাশের থ্রোগস নেকে তার সমৃদ্ধ ব্যবসা, ক্রমবর্ধমান পরিবার ও একটি নিজস্ব বাড়ি রয়েছে।’ আমি তাকে তাৎক্ষণিকভাবে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই। আমার কোনো ধারণা ছিল না, কেন তিনি একজন সিকিউরিটি গার্ডের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করবেন; কিন্তু তিনি করেছিলেন। আমি একটি কক্ষ ভাড়া নিতে তার সহায়তা চাওয়ার জন্য কয়েকদিন (কয়েকদিন আমার কাছে এক মাস মনে হয়েছিল) অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।এদিকে আমি তার ফেসবুক পেজ দেখতাম এবং মনে হতো যে তিনি শুধু একজন সফল ব্যবসায়ী নন, ন্যান্সি খানের একজন প্রিয় স্বামী ও তাদের তিন সন্তান রামিন, তাইবা ও একলেলের যত্নশীল একজন বাবা।আমি এক সপ্তাহ পরে তার কাছে ফেসবুকে সহায়তার অনুরোধ জানাই। এটা ছিল ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি। আমি কোনো সাড়া পাইনি। আশ্চর্যান্বিত হলাম, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন আমি কতটুকু বহন করতে পারবো। আমি তাকে জানাই যে, আমি মাসে মাত্র ৪০০ ডলার পরিশোধ করতে পারবো। পরদিন সকালে তিনজন বাড়িওয়ালার কাছ থেকে তিনটি ফোন কল পাই; যাদের প্রত্যেকেই আমাকে একটি কক্ষ ভাড়া দিতে চান। আমি গ্লিসন অ্যাভিনিউয়ে একটি কক্ষ পছন্দ করি; পার্কচেস্টার জামে মসজিদ থেকে কয়েক ফুট দূরে। অবশেষে বাংলাদেশ থেকে আমার স্ত্রী ও ছেলে আসার পর আমরা একসঙ্গে এক ছাদের নিচে তিন সপ্তাহ থেকেছি। তখন থেকে, খানের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক বন্ধন অনুভব করতে থাকি। শুধুমাত্র তার গল্প পড়ার জন্য আমি অনেকবার বাংলা পত্রিকা এনেছি। আমরা ২০১০ সালে ওই কক্ষ ছেড়ে দিয়েছি, কিন্তু আমরা সর্বদা ওই কক্ষটিকে ভালোবাসবো। এটি ছিল ম্যাজিক বক্সের মতো। গৃহহীন হওয়ার কষ্ট শুধুমাত্র অল্পকিছু মানুষ বুঝতে পারবে। আমি বিশ্বাস করতে পারি না যে, এ ধরনের একজন মানুষ ভাড়ার জন্য খুন হবেন। তিনি ছিলেন পার্কচেস্টারের রাজা। কখন তার রাজত্ব হারালেন? এটা কীভাবে ঘটলো? কম্পিউটার চালু করে গুগলে তার নাম লিখে সার্চ করলাম। টাইম টিভির একটি প্রতিবেদনে দৃষ্টি পড়লো। বাড়িওয়ালা ৫১ বছর বয়সী তাহা মাহরান ৪৪ বছরের জাকির খানকে ভাড়া বাকি থাকার কারণে ২০ বার ছুরিকাঘাত করেছেন। আমি দেখলাম একলেল হামলার প্রত্যক্ষদর্শী, সহায়হীন ভীতসন্ত্রস্ত্র ১২ বছর বয়সী একলেল কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মৃত্যুমুখী জাকির খান ব্রঙ্কসের বাড়ির বাইরে থেকে একলেলের নাম ধরে চিৎকার করেন। বলেন, আমাকে বাঁচাও! ৯১১-তে কল দাও।’ বাড়িওয়ালা মাহরান খানের জ্যাকেট ধরে মাটিতে ফেলে দেন। নির্বিচারে তার গলা, মাথা ও কাঁধে ছুরিকাঘাত করেন। আমি আর এই সংবাদটি পড়তে পারিনি। এটি ছিল হৃদয়বিদারক।আমি যখন দরিদ্র ছিলাম তখন জাকির খানের কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি যখন দরিদ্র হয়ে পড়েন তখন আমার কাছে আসেননি। তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন। দারিদ্রতা ও পরোপকারীতা পরস্পর ভিন্ন। ভাড়া বাকি রেখে জাকির খান একটি ভুল করেছিলেন কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সবচেয়ে পাশবিক উপায়ে সন্তানের সামনে একজন বাবাকে খুন করবেন মাহরান। মাহরানের আচরণ আমাকে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের আচরণ স্মরণ করিয়ে দেয়। আমি একটি ধারণা মাথায় নিয়ে রাত সাড়ে ৮টার দিকে ব্রঙ্কস কমিউনিটি কলেজ ত্যাগ করি যে, জাকির খানের হৃদয়বিদারক মৃত্যু আমি ভুলে যাবো। এ ঘটনা মনে করে কোনো লাভ নেই। রামিনের (যে আমার ছেলে আইজ্যাকের চেয়ে মাত্র দুই বছরের বড়), তাইবা ও একলেল (যে তার পিতার খুনের প্রত্যক্ষদর্শী) চেহারা স্মরণ করে কোনো লাভ নেই।সুতরাং আমি যা দেখেছি এবং পড়েছি তার সবকিছুই ভুলে যেতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। আমি ভেবেছি শিগগিরই সবকিছু ভুলে যাবো। কিন্তু আমার এই ধারণা ভুল। আমি রাত ১০টায় বাসায় ফিরেছি। আমি আপ্লুত হয়েছি যখন আলবার্ট দরজা খুলে দেয় এবং সুবর্ণ আইজ্যাক আমার কোলে লাফিয়ে উঠে। তাৎক্ষণিকভাবে এটি আমাকে মনে করিয়ে দেয়; রামিন, তাইবা ও একলেল কার কোলে লাফিয়ে উঠবে এখন? আমি রাতের খাবার না খেয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো ঘুমের ওষুধ খেয়ে তিন নিষ্পাপ শিশুর মুখ ভুলে ভালো ঘুমের আশায় শুয়ে পড়ি। কিন্তু সকালে আবারও একই পরিস্থিতির তৈরি হয় যখন আমার দুই বাচ্চাকে লাইব্রেরিতে রেখে আসি। মারহানের হাতে খুন হওয়ার ঘণ্টা খানেক আগে জাকির খান তার বাচ্চাদের ওই লাইব্রেরিতে রেখে আসেন। এক মুহূর্তের জন্য, আমি জাকিরের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করি। এক মুহূর্তের জন্য আমি রামিন, তাইবা ও একলেলের বাবা হিসেবে নিজেকে কল্পনা করি। তাদের এখন লাইব্রেরিতে কে নেবেন? সূত্র : হাফিংটন পোস্ট। এসআইএস/আরআইপি

Advertisement