কলেজের প্রধান ফটক পেরুতেই দৃষ্টিনন্দন গাঢ় লাল দালান। পরতে পরতে ইতিহাস আর ঐতিহ্য ধারণ করছে রাজশাহী কলেজ। শতবর্ষি এ কলেজের প্রতিষ্ঠা ১৮৭৩ সালে। রয়েছে ঐতিহাসিক বেশ কিছু স্থাপনাও। তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে নেই এ ইতিহাস চর্চা। ফলে অনেকের কাছেই অজানা কলেজের ইতিবৃত্ত।বিভিন্ন সময় প্রকাশিত কলেজের বই-পুস্তক থেকে জানা যায়, প্রাচীন বাউলিয়া ইংলিশ স্কুল ও কলেজিয়েট স্কুলের হাত ধরেই আজকের রাজশাহী কলেজের যাত্রা। প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায় ১৮৭৮ সালে প্রথম গ্রেড মর্যাদা পায় কলেজটি। রাজশাহী কলেজ নামকরণ তখনকারই। উত্তরবঙ্গের প্রথম কলেজ হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির পর সবছরই চালু হয় বিএ কোর্স। এরপর ১৮৮১ সালে স্নাতকোত্তর এবং ১৮৮৩ সালে যোগ হয় বিএল কোর্স। যদিও ১৯০৯ সালে মাস্টার্স কোর্স ও বিএল কোর্সের অধিভুক্তি বাতিল করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও অধিভুক্ত হয়। এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স ও সম্মান ডিগ্রি প্রদান করছে রাজশাহী কলেজ। চালু রয়েছে উচ্চমাধ্যমিক পাঠক্রমও। ছাত্র নথিভুক্তি বন্ধ হওয়ায় ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বন্ধ ছিল এ কার্যক্রম। মাত্র ছয়জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করা রাজশাহী কলেজ এখন পরিণত হয়েছে উত্তরের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে।বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ রাজশাহী কলেজ। বিশেষ করে ভবনগুলো এনে দিয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। কলেজের ঐতিহাসিক ভবনের কথা উঠতেই চলে আসে প্রশাসনিক ভবনের নাম। ১৮৮৪ সালে ব্রিটিশ স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত হয় এ ভবন। এটি ব্রিটিশ ভারতীয় ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের অন্যতম নির্দশন। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বিতল এ ভবন।ঐতিহ্যের এ ভবনটির চুঁড়ায় এক সময় ছিল রোমান পুরাণের জ্ঞান ও চারুশিল্পের ভাস্কর্য প্যালাস-অ্যাথিনি। পরে একই আদলে আরও দুটো ভাস্কর্য হেমন্ত কুমারী ছাত্রাবাসে স্থাপিত হয়। এই চারটি ভাস্কর্যই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দখলদার পাক বাহিনীর দোসরদের চাপে অপসারিত হয়। প্রশাসনিক ভবনটি কলেজের প্রথম নিজস্ব স্থাপত্যের নিদর্শন। এর জন্য ব্যয় হয় ৬০ হাজার ৭০৩ টাকা। পুঁঠিয়ার মহারাণী শরৎসুন্দরী দেবী ১০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন এই সুদৃশ্য ইমারত নির্মাণে। মহারাণী কলেজের সীমানা প্রাচীর ও রেলিং নির্মাণেও অর্থ প্রদান করেছিলেন। তবে ১৯৩৩-৩৪ শিক্ষাবর্ষের প্রসপেকটাসে ভবন নির্মাণ ব্যয় মোট ৬১ হাজার ৭০৩ টাকার কথা উল্লেখ আছে।নির্মাণ শেষে বাউলিয়া হাইস্কুল থেকে রাজশাহী কলেজের ক্লাসসমূহ এই নবনির্মিত ভবনে স্থানান্তরিত হয়। অনেকে ধারণা করেন এই নতুন ভবনে ক্লাস শুরু হলে বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর ক্লাসসমূহ চালুর বিষয় অনুমোদিত হয়। প্রশাসন ভবনের সামনেই লোকজ বাংলার দেখা মিললো ‘রাজশাহীর চোখ’ টেরাকোটায়। আরেক টেরাকোটা ‘রক্তে ভেজা বর্ণমালা’ নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে দেশের প্রথম শহীদ মিনার। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মত পলাশের নুয়ে পড়া ডালে যেন শ্রদ্ধায় রঙিন আলপনা এঁকেছে প্রকৃতি। এ ভবনের পেছনে গাঁদা, ডালিয়া, জিনিয়া, ক্যালেন্ডুলার সৌরভে ভরেছে ক্যাম্পাস।শহীদ মিনার পেরিয়ে এবার বামে বাঁক নেয়া যাক। চোখে পড়বে প্রশাসন ভবনের আদলেই গড়া আরেক ঐতিহাসিক ভবন। ভবটির সিঁড়ির ওপরে সাদার ওপরে কালো হরফে লেখা ‘হাজী মুহম্মদ মুহসীন’। এ ভবনের নামকরণ করা হয়েছে প্রখ্যাত এই দানবিরের নামেই। ১৮৮৮ সালে নির্মিত হয় এ ভবন। তখন হাজী মুহম্মদ মহসীন এটির নির্মাণে আর্থিক অনুদান দেন। তৎকালীন কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থাতি মাদরাসা ভবন হিসেবে ব্যবহৃত এটি। পরে মাদরাসা অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার পর এ ভবনটি কলেজরই ভবন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ভবনটির সামনের রাস্তার ওপারে পুকুর। ভবনের সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই ১০১ নং কক্ষ। এটি বর্তমানে গ্যালারি কক্ষ নামেই পরিচিত। সভা-সেমিনার, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কর্মশালা আয়োজন হচ্ছে এ কক্ষে। ভবনের ১০২ নম্বর কক্ষটি রাজশাহী কলেজ নাট্য সংসদের দফতর। সেখানে গিয়ে দেখা গেলো, সংগঠনের কয়েকজন কর্মীকে। নাটকের রিহার্সেলে ব্যস্ত তারা। পাশের ১০৩ নম্বর কক্ষটি রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির দফতর। বাইরে থেকেই দেখা গেলো একদল শিক্ষার্থী বসে আছেন টেবিলের চারপাশে। একজন সামনে বসে কি যেন বোঝাচ্ছেন। পরে জানা গেলো এখানে চলছে সংবাদ ও লেখনি শিল্পী তৈরির জ্ঞান চর্চা।ভবনের ১০৯ ও ১১০ নম্বর কক্ষে রোভার স্কাউটের দফতর। পড়ালেখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সামাজিক দায়বদ্ধতায় উদ্বুদ্ধ করছে সংগঠনটি। মঞ্চই এখানে জীবন দর্পণ। শৈল্পিক নৃত্য আর কণ্ঠে উঠছে জাগরণের সুর। এসব নিয়েই ১০৭ ও ১০৮ নম্বর কক্ষে ব্যস্ত বরেন্দ্র থিয়েটার এবং রাজশাহী কলেজ সংগীত চর্চা কেন্দ্রের কর্মীরা। কর্মী হলে কী হবে এরা সবার আগে রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী । হাজি মোহাম্মদ ভবন থেকে নেমে দখিনের পথে এগুলে দূরে চোখ চলে যায় আরেকট প্রাচীন লাল দালানে। গুণে গুণে ১৬৫ ধাপ ভবটির সিঁড়ি পর্যন্ত। ওপরে তাকাতেই সাদা কালো ইংরেজি ও বাংলায় লেখা ফুলার ভবন। এ ভবনটিও শত বছর পেরিয়েছে। মাঠের একেবারেই দখিনে অধ্যক্ষের দোতলা বাসভবন। এই ভবনটিতে উপ-মহাদেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদগণ বসবাস করে গেছেন। কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ মহোদয়ও এখানেই বসবাস করছেন। এটিও নির্মিত হয়েছে ব্রিটিশ স্থাপত্য শৈলিতে। এ ভবনের ইতিহাস নিয়ে অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়েছে। এদের একজন ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী কাউসার আলী। তিনি বলছিলেন, এগুলো বিষয় সম্পর্কে তাদেরও জানাশোনা সীমিত। এসব বিষয় নিয়ে চর্চাও হয় না তেমন। নিজের ইচ্ছায় জানতে চান। শুধু শিক্ষার্থীরা নয় এ নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত কথা বলতে অনিহা শিক্ষকদের মাঝেও। কলেজের শতবর্ষি ভবনগুলোর ইতিহাস জানতে গিয়ে পাওয়া যায় পড়তে হয়েছে বিড়ম্বনায়। প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি হননি কোনো শিক্ষকই।ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান জানান, তারা আসেন, ক্লাস নেন, চলে যান। কেবলই তাদের বিভাগের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। ইতিহাস চর্চার সুযোগ নেই। এ নিয়ে উদ্যোগও নেয়া হয়নি।শিক্ষার্থীদের ইতিহাস চর্চার আগ্রহ আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি শিক্ষার্থীদের মাঝে থাকবেই। খুব বেশি হলে ইতিহাসের শিক্ষার্থী হিসেবে জানানো হয়েছে ভবটির নির্মাণ সাল ও কারা নির্মাণ করেছিলেন। তাও জানানো হয়েছে প্রাপ্ত শিলাখণ্ড থেকেই। ইতিহাস চর্চায় প্রত্যেক বিভাগকে আলাদা উদ্যোগ নেয়া দরকার। উদ্যোগ নিতে হবে কলেজকেও। কলেজের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে শ্রেণিকক্ষে তেমন চর্চা নেই স্বীকার করেন একাধিক শিক্ষক। তারা জানিয়েছেন, কলেজের লাইব্রেরিতে এ নিয়ে সমৃদ্ধ বই-পুস্তক রয়েছে। যে কেউ চাইলে সেখান থেকে জেনে নিতে পারেন কলেজের ইতিহাস। নিজেকে করতে পারেন আরও বেশি সমৃদ্ধ। ইতিহাসের অংশ রাজশাহী কলেজ। এ ইতিহাস চর্চার দায়িত্ব সবার। ফেরদৌস সিদ্দিকী/এএম/আরআইপি
Advertisement