ভার্চুয়াল জগত নিয়ে যতই বাদানুবাদ থাকুক না কেন, এই কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, যে এই জগতটা আমাদেরকে আমাদের কল্পনার চেয়েও দ্রুত গতিতে গ্রাস করছে। তাই, যত তাড়াতাড়ি এর ভালো, মন্দ, গতি, প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা যায় ততই ভালো। জেনে বুঝে একে আলিঙ্গন করলে হয়তো সমস্যা কিছুটা এড়ানো যাবে। সেদিন একজন গবেষকের সাক্ষাৎকার শুনছিলাম। তার কাজ হোল সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন তথ্যের উপরে কিছু অ্যাল্গরিদ্ম দিয়ে প্যাটার্ন বের করে ব্যক্তি সম্পর্কে বিভিন্ন গোপন তথ্য বের করা। যেমন সে উদাহরণ দিচ্ছিল সেকচুয়াল ওরিয়েন্টেশন। কোন ব্যক্তি যদি সোশ্যাল মিডিয়াতে তার প্রকৃত `সেকচুয়াল ওরিয়েন্টেশন` প্রকাশ নাও করে, তার পরেও সে কোন সাইটে যায়, কোথায় লাইক দেয়, তার বন্ধু বান্ধব কারা, তারা কী লাইক করে, তাদের সবার কমেন্টের ধরন, বিষয়, ছবির স্টাইল সব কিছু থেকে নাকি খুব সহজেই তার সেকচুয়াল ওরিয়েন্টেশন জানা সম্ভব। অর্থাৎ চূড়ান্ত গোপন কথাটিও আর থাকছে না গোপন। তার চেয়েও ভয়াবহ যেটা সেটা হোল এই সব তথ্যকে সত্য ধরে নিয়ে এর উপর ভিত্তি করে অনেক বড় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, ধরা যায় ভবিষ্যতে আরও হবে যার ফলাফল সবার জন্য শুভ নাও হতে পারে। যার সাক্ষাৎকার শুনছিলাম, সে খুব দুঃখ করে বলছিল যে এই অ্যাল্গরিদ্ম থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আফ্রিকার একটি রাষ্ট্রে বিরাট সংখ্যক সমকামী মানুষের খবর পাওয়া গেছে এবং তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। ভাবা যায়? আমাদের নিজেদের অজান্তেই আমাদের পছন্দ, অপছন্দ, নীতি, বিশ্বাস, আদর্শ কিংবা দুর্নীতি, দুশ্চরিত্র , বিতর্কিত চিন্তা ভাবনা, অভ্যাস সব তথ্যই চলে যেতে পারে যে কোন ক্ষমতাবান মানুষের হাতে। সে যদি ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করতে চায় আর তার পছন্দের সাথে অমিল কিছু খুঁজে পায়, তাহলেই ঘটতে পারে সর্বনাশ। এতোটা না জানলেও আমরা কম বেশি অনলাইন জগতে প্রাইভেসি, নিরাপত্তা এই সমস্যা গুলো সম্পর্কে জানি। কিন্তু তার পরেও আমরা দিন দিন এই জগত সম্পর্কে আসক্ত হয়ে পড়ছি। কিন্তু কেন? আমি আমার অবসারভেশন গুলো বলতে পারি। এক. এখানে খুব সামান্য চেষ্টায় নিজের কল্পনার মতো একটা জীবন সাজানো যায়। সে জীবনের অস্তিত্ব থাকে শুধু ছবিতে, স্ট্যাটাসে, মেসেজে। কল্পনাবিলাসী, অলস বা অক্ষম মানুষের জন্য এটা সবচেয়ে সহজ উপায়। তীব্রভাবে চেষ্টা করলে হয়তো নিজেকেও সেই মিথ্যা দিয়ে অনেকটাই ভুলিয়ে রাখা যায়। দুই. যারা বাস্তব জীবনে কিছুটা অন্তর্মুখি, তাদের অনেকেরই একটা সুপ্ত আকাঙ্খা থাকে নিজের কথা বলার। অনলাইন জগত সেই সুযোগটা এনে দেয়। বাস্তবে মুখোমুখি দুজন মানুষের কথা বলার জন্য অনেক গুলো নিয়ামক দরকার, সেগুলো অনলাইনে অনুপস্থিত। তাই খুব সহজেই দেশ, কাল, পাত্র, বয়সের পার্থক্য ডিঙিয়েও খুব অল্প পরিচিত মানুষের সাথেও অনেক কথা বলা যায়, যেটা সামনাসামনি এতোটা সহজ নয়। তিন. সহজলভ্যতা আরেকটি বড় ব্যাপার। বেশিরভাগ সময়ই আমরা যাদের সাথে যোগাযোগ করতে চাই, তাদেরকে হাতের কাছে পেয়ে যাই। চার. নিঃসঙ্গ মানুষের জন্য এটি একটি বিরাট পৃথিবীর দ্বার খুলে দেয়। পাঁচ.এর মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য মানুষ, অসংখ্য জ্ঞানের, বিনোদনের সুযোগ মেলে। বিন্দুমাত্র পরিশ্রম না করেও, কেউ চাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন ধরনের বিনোদন পেতে পারে ঘরে বসে নামমাত্র খরচে। ছয়.সবার সাথে অন্তর্ভুক্ত বা দলভুক্ত বা গোষ্ঠিভুক্ত হয়ে আছি, আমি একা বিচ্ছিন্ন কিছু নই, এই অনুভূতি অর্জন এরকম হয়তো আরও অনেক কারণ আছে। তবে সেদিন একটা ইন্টারেস্টিং আইডিয়া শুনেছি। ভার্চুয়াল জগতের একটা সম্ভাব্য পজিটিভ ব্যবহার। আমরা (আমরা মানে বাংলাদেশি না, সাধারণ অর্থে মানুষ) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাই পড়ালেখা করতে, চাকরি করতে। এটার একটা বড় কারণ আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, কালচার, মানুষ সম্পর্কে জানতে চাই। ভার্চুয়াল জগতটাকে আমরা সেভাবে ভাবতে পারি এবং ব্যবহার করতে পারি। সে সব দেশে, সে সব জীবনে না যেয়েও আমরা সে সব জীবনের স্বাদ পেতে পারি। কোথায় যেন পড়েছিলাম গানের এফেক্ট মানুষের উপরে খুব বেশি। প্রচণ্ড শীতেও গ্রীষ্মের গান ঠিকঠাক মতো শোনাতে পারলে নাকি গরম লাগানো সম্ভব। স্থানীয় একটি হাসপাতালে শুনেছি বাচ্চাদেরকে গান শুনিয়ে শারীরিক অসুস্থতা পর্যন্ত সারিয়ে তোলার ব্যবস্থা আছে। ভার্চুয়াল জগতকে এসব কাজে লাগানো যায় না? লেখক : ক্যালিফোর্নিয়া প্রবাসী প্রকৌশলী, লেখক।এইচআর/পিআর
Advertisement