এই লেখাটি প্রকাশিত হবে একুশে ফেব্রুয়ারি, তাই এ দিনটি নিয়েই কিছু লিখতে অনুরোধ জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি জাতির জাতীয় জীবনেই কিছু দিন থাকে যেগুলো আসলে সেই জাতির জীবনের মোড় ঘোরানো তারিখ। বাঙালি জাতির জীবনে ২১শে ফেব্রুয়ারি সে রকম একটি দিন। এর কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত না বলেও শুধু একথাটিই বলা যায় যে, বাঙালির নবজন্ম ঘটেছিল এই দিনে। বাঙালি জাতির সত্যিকার বয়স কতো সে হিসেবে কাজ নেই কিন্তু ১৯৫২ সালের এই দিনে একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের যে গোড়াপত্তন হয়েছিল সেকথা অস্বীকার করার কোনো উপায় আছে কি? যদি অস্বীকার করার উপায়ই না থাকে তাহলে এই দিনটিকে কোনো ভাবেই হেলাফেলা করারও নয়, তাই না? সে কারণেই এই বিশেষ দিনকে নিয়ে যতো লেখা হবে ততোই কম বলা হবে, যতো গবেষণা হবে ততোই তা হবে জাতির জন্য মঙ্গলকর। ভারতভাগকে যদি আমরা ধরে নেই এই ভূখণ্ডের সবচেয়ে করুণ ও নিষ্ঠুরতম ঘটনা তাহলে পূর্ব পাকিস্তানে একটি ভাষাভিত্তিক গণজাগরণকে ধরতে হবে এই নিষ্ঠুর ও করুণ গল্পের মাঝে সবচেয়ে ইতিবাচক সূচনা। মনুষ্যত্ত্বের পোড়া ছাইয়ের ওপর যেনো কোনো গোলাপচাষী দীর্ঘকাল চেষ্টা করে একটি মাত্র গোলাপ গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন এবং তাতে একটিমাত্র ফুল ফুটেছে। জিন্নার সেই দম্ভোক্তি, এই ঢাকা শহরের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে, কেবলমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার যে ঘোষণা বাঙালিকে বিক্ষুব্ধ করেছিল তা প্রশমনের জন্য পাকিস্তানি শাসককূল শক্তিপ্রয়োগের পথকে বেছে নিয়েছিল আর যে কোনো শক্তি প্রয়োগের ফলাফলই যে ভালো হয় না, তা পাকিস্তানি শাসককূল ১৯৭১ সাল অবধি পদে পদে বুঝতে পেরেছে। এখনও পাকিস্তান সেই একই পথে হাঁটছে, এখনও সেখানে সেনাবাহিনীর হাতে নিয়ন্ত্রিত মানুষের জীবন, রাজনীতি, সরকার এবং রাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশ এই নিয়ন্ত্রণপ্রবণতা থেকে অনেকটাই দূরে সরে আসতে পেরেছে, যা আসলে ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালেই বাঙালি শিখতে শুরু করেছিল। সবচেয়ে বড় কথা হলো জাতি হিসেবে বাঙালি তার মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই প্রতিবাদী হতে শিখেছিল। এর আগের যে পাকিস্তান আন্দোলন তাতে বাঙালির অংশগ্রহণ ছিল বটে কিন্তু তাতে বাঙালির অংশগ্রহণ বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। মোটা দাগে পাকিস্তানকে কেন্দ্র করেই বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছিল। এর আগে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে বাঙালি হিন্দু যেভাবে অংশ নিয়েছিল কেন বাঙালি মুসলমান ঠিক সেভাবে অংশ নেয়নি তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে তবে একথা মোটেও মিথ্যে নয় যে, ইংরেজদের সঙ্গে মুসলিম ঘনিষ্ঠতা ও হিন্দু-বিচ্ছিন্নতা ভারত-বিভাগকে অনেকটাই উস্কে দিয়েছিল। এর বিপরীতে দাঁড়িয়েও অনেক যুক্তি আছে কিন্তু এই লেখায় সেটা আনার সুযোগ কম। আসলে ওপরের এই কথাগুলো থেকে আমি একথাটিই বলতে চেয়েছি যে, ১৯৪৭ সালে দেশভাগ এখানে দু’টি প্রধান ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের ভেতর যে ভয়ঙ্কর বিভেদের দেয়াল তুলেছিল ১৯৪৮ সালে জিন্না সাহেবের উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা আবার পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলিমকে এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছিল, ‘মাতৃভাষার ওপর আক্রমণ’-এর কারণে তাদেরকে পাকিস্তানি শাসককূলের বিপরীতে দাঁড়ানো আক্রান্ত গোষ্ঠী হিসেবে শক্তিশালী ও একত্রিত করেছিল। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির গুরুত্বটি ঠিক এখানেই। অনেকেই মিউ মিউ করে বিতর্ক তোলার চেষ্টা করেন যে, কই ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে নিহতদের তালিকায়তো কোনো হিন্দু নাম নেই? কিন্তু একথা ভুলে যান যে, পাকিস্তানের সংসদে দাঁড়িয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে সবচেয়ে কড়া যুক্তিটি তুলে ধরেন যিনি, তিনি একজন হিন্দু। প্রশ্ন সেখানে নয়, বিভাজনের পক্ষে যুক্তি খুঁজতে গেলে হাজারো যুক্তি পাওয়া যাবে কিন্তু সম্মিলনের পক্ষে যদি আপনি একটিমাত্র যুক্তিও খুঁজে পান সেটিই হবে এই ভূখণ্ডের জন্য ইতিবাচক ঘটনা। আমরা দেখতে পাই যে, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির পরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সেই ব্রিটিশদের দ্বারা অতি ব্যবহারে জীর্ণ সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে নতুন করে ব্যবহার করতে শুরু করে এবং বার বার এদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করা হয় সে সময় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। এর মূল কারণ হলো এই ভূখণ্ডের একই ভাষায় কথা বলা কিন্তু ধর্মবিশ্বাসে আলাদা দু’টি সম্প্রদায়কে বিভক্ত করা যাতে তাদের পক্ষে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা সুবিধে হয়। কিন্তু বাঙালি তখনও বার বার সম্মিলনের কথা বলেছে, বহুত্ববাদের কথা বলেছে, রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরেছে, শিক্ষা আন্দোলনে বাঙালি হিন্দু বা বাঙালি মুসলমান একত্রেই অংশ নিয়েছে, সেখানে পাকিস্তানিদের করা সাম্প্রদায়িক বিভাজন বা দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টা কোনো কাজেই আসেনি। এই ভূখণ্ডের সৌন্দর্য এখানেই, যে তারা নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাসকে অটুট রেখে মাতৃভাষাকে সামনে রেখে একটি প্রতিবাদে সামিল হতে পারে, তাতে তাদের ধর্মবিশ্বাসের যেমন কোনো ক্ষতি হয় না তেমনই তাদের চিরায়ত ভ্রাতৃত্ববোধেও কোনো সমস্যা দেখা দেয় না। ১৯৭১ সাল অবধি যদি এই সম্পর্ক-চেতনা অটুট না থাকতো তাহলে এদেশ এতো দ্রুত স্বাধীন হতো কিনা তাতে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। আর সে কারণেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি জাতিকে একত্রিত করতে যেমন বাংলাভাষাকে সম্মিলন-সূত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তেমনই তিনি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাষ্ট্রের মূল চরিত্র হিসেবে সাংবিধানিক স্থায়ীত্ব দিয়েছিলেন।কিন্তু বাঙালির দুর্ভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধুর সে প্রচেষ্টা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। কিন্তু সে জন্য তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে, তাকে একা নয়, তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকেই সে জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে। এখন অনেকে বঙ্গবন্ধু-হত্যার পেছনে নানাবিধ কারণ উদ্ঘাটনে ব্যস্ত থাকতে পারেন কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনা ও তাকে রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রতিষ্ঠা করার যে প্রয়াস তা এই ভূখণ্ড তথা আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতাবাদী, ধর্মোন্মাদ, সামরিকতন্ত্রবাদী গোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না বলেই নির্মমভাবে তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। এর সঙ্গে বাকি কারণগুলো যুক্ত হলে এই কারণটি সত্যিকার অর্থেই সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে আমার কাছে।পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে ভয় পেয়েছে কারণ তারা মনে করেছে যে, এই ভাষাই হতে পারে দু’টি প্রধান ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে সম্মিলনের প্রধান প্রপঞ্চ। তাই তারা বার বার আঘাত হানার চেষ্টা করেছে এই ভাষার ওপরই। কিন্তু বাংলাদেশে যখন সামরিকায়ন হলো রাষ্ট্রের তখনও কিন্তু আমরা লক্ষ্য করি যে, বাংলা ভাষাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে বার বার। কখনও ইতিহাস বিকৃতি দিয়ে, কখনও বা একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিকতার ভেতর আঁটকে রেখে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে, বাঙালি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে তাতেও বাংলা ভাষাকে সামনে রেখে কিংবা ভাষা-শহীদ দিবসকে কেন্দ্রে রেখে আন্দোলনগুলো পরিচালিত হয়েছে। এবং তাতে সম্প্রদায়গত বিভেদ কোনো ভাবেই কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং দুই সম্প্রদায়ই নিজেদের ধর্মবিশ্বাসকে পেছনে রেখে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেছে, পাকিস্তানি শাসকের মতো বাংলাদেশে সামরিক শাসক কিংবা সামরিক ছাউনীজাত রাজনৈতিক দল বার বারই সাম্প্রদায়িকতাকে তাদের রাজনীতির মূল অনুঘটক করার চেষ্টা করেছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করেছে (আসলে দাঙ্গা আর স্বাধীন বাংলাদেশে হওয়ার কোনো উপায় ছিল না, এদেশে যা হয়েছে তা হলো সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, সংখ্যালঘুর ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠের আঘাত) কিন্তু একই ভাষায় কথা বলা বাঙালির বড় অংশ এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে অস্বীকার করেছে, প্রতিবাদ করেছে, বিরুদ্ধাচার করেছে। দুঃখজনক সত্য হলো, বাঙালি ক্রমশঃ শক্তিক্ষয় করে এখন, এই মুহূর্তে সাম্প্রদায়িকতা, অস্বচ্ছ রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। আসলে প্রতিবাদ-প্রতিরোধেরওতো একটি সীমা-পরিসীমা আছে, আমার কাছে মনে হয় বাঙালি এই মুহূর্তে ক্লান্ত। তাছাড়া আর কতো, একই অস্ত্র বার বার প্রয়োগে যেমন সেটি ভোঁতা হয়ে যায় তেমনই সেই বাঙালিত্বের শুরু থেকেই বাঙালি জাতিকে সাম্প্রদায়িক আঘাতের সম্মুখীন হতে হয়েছে, ভাষার সঙ্গে ধর্মের আরোপিত বিরোধের জবাব দিতে হয়েছে, ফলে নতুন নতুন প্রজন্ম এসে সেসবের মোকাবিলা করতে করতে এখন বাঙালি একটি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত জাতিতে পরিণত হয়েছে। এখন ঘুরে দাঁড়ানোর নেতৃত্ব যেমন নেই, তেমনই নেতা তৈরি করার মতো জনতাও। যে জনতা একদিন বঙ্গবন্ধুকে তৈরি করেছিল সেই জনতা আজকে শেখ হাসিনার পেছনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে বলিষ্ঠভাবে দাঁড়াতে পারবে কিনা বা পারলেও টিকে থাকতে পারবে কিনা তা নিয়ে আমার রয়েছে ঘোরতর সন্দেহ। তারপরও একুশে ফ্রেব্রুয়ারি এলে আমার বার বার মনে হয়, বাঙালির আর কিছু না থাকুক, মাতৃভাষাটি এখনও অটুট রয়েছে, এবং এই মাতৃভাষাই হতে পারে বাঙালি-ঐক্যের সবচেয়ে বড় অনুঘটক, যার ওপর ভিত্তি করে বাঙালি কেবল বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটিই ফিরিয়ে আনা নয়, সাংবিধানিক ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে আনা নয়, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক করা নয়, অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে যাওয়া নয়, ধনী দেশগুলির মোড়লিপনা মোকাবিলা নয়, জঙ্গীবাদকে প্রতিরোধ করা নয়, বরং এর সবগুলোকেই এই একটিমাত্র উপকরণ দিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করা ও সফলতা অর্জন করতে পারে- আর তা হলো বাঙালির মাতৃভাষা, যা হাজার বছর ধরে নানাবিধ প্রতিকূলতা ঠেলে, বহুবিধ বিবর্তন মোকাবিলা করে এখনও অটুট আছে, টিকে আছে দৃঢ়তায়; খাবার নয়, পোশাক নয়, ধর্ম নয়, নয় কোনো শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি, বাঙালির আসল শক্তি তার মাতৃভাষা। এই সত্য বোঝার জন্য গভীর কোনো পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলার ওপর একটুখানি ভরসা। ঢাকা ২০ ফেব্রুয়ারি, সোমবার ২০১৭লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।এইচআর/পিআর
Advertisement