ব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি কাটাতে কয়েক দিনের জন্য বনবাসের প্রস্তুতি। বাংলাদেশ থেকে ঘুরতে আসা এক পরিবারসহ মোট চার পরিবার। চার বেডরুমের বড় পাহাড়ি কটেজ। দুই গাড়িতে বেড়িয়ে পরলাম বনবাসে। রোদেলা দিনে গাড়ি চালিয়ে মিশিগান, ওহাইয়ো এবং কেন্টাকি তিন অঙ্গরাজ্য পেরিয়ে টেনেসি অঙ্গরাজ্যের সীমানায় ওয়েলকাম সেন্টারে পৌঁছাতেই ঝুম বৃষ্টি। একটানা দ্রিমি-দ্রিমি-দ্রাম-দ্রামের প্রতিধ্বনির শব্দ। আকাশে কৃষ্ণকলি মেঘের মিছিলের ফাঁক দিয়ে এক অসাধারণ আলোকচক্র। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো আকাশ জ্বালিয়ে বিদ্যুৎ চমকিয়ে পাহারগুলো ভিজেছে চিড়ে ভেজার মতো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় আমার মতো আরও অনেকেই এসেছেন। আমাদের কটেজটি ছিল পাহাড়ের টিলার ওপর। সারাদিনের হাজার মাইল পথ, পাহাড় পর্বত পেরিয়ে যখন পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের শুরু। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। দুপুরে রেস্টুরেন্টের খাবারে পেট ভরলেও মন ভরেনি। খেতে হবে বাংলা খাবার। পথে কেনা হয়েছিল আলু, পেয়াজ, ডিম আর বাসমতি চাল। রাতের গরম ভাত, আলুভর্তা, ডাল আর ডিম ভাজির অসাধারণ স্বাদ। পেটে ক্ষুধা থাকলে ঝাল লবণ যে কোনো ব্যাপার না তা আবার প্রমাণ করলাম। পেট পুরে খেয়ে সবাই বারান্দায় চেয়ারে গা এলিয়ে গল্পে মশগুল। ততক্ষণে আকাশের সীমান্তে মেঘের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে একফালি চাঁদের আলো। আমরা চায়ের কাপ হাতে ক্লান্ত শরীরে খোশগল্পে। উফ, মন ছুঁয়ে গেল।আমাদের আরেক সহযাত্রী নব দম্পতি রেদোয়ান-ফারিয়া যুগল সব বাচ্চাদের নিয়ে নিচ তলায় নেমে পড়েছে খেলায়। ফুসবল (অনেকটা ফুটবলের মতো) ও বিলিয়ার্ড খেলায় মত্ত একদল, যেন ভুলে গেছে দশ ঘণ্টার জার্নি। স্মোকি মাউন্টেইনে শীত বা গ্রীষ্ম যেকোনো সময়েই কুয়াশায় জড়িয়ে থাকে। ধোঁয়াশা ভরা সকাল পেরিয়ে ভাঙা নরম রোদের ফালি স্মোকি মাউন্টেইনের পাহাড়ি পথের মাটি স্পর্শ করেছে। অদ্ভুত কুয়াশাই এই পাহারের বিশেষত্ব। নামকরণের কারণও তাই। সকালে নাস্তা সেরে দুই গাড়িতে বেরিয়ে পরলাম সবাই। গেটলিনবাগ শহরের রাস্তা পেরিয়ে ঢুকে পরলাম স্মোকি মাউন্টেইনের পাহাড়ি পথে। পথের ধারে আকাশের ঠিকানায় পাহাড়ের ঢেউ। পথের প্রতিটি মোড়ই যেন এক মায়াময় ছবির পোস্টকার্ড। বনপাহাড়, তীরতীরে নদীর বহতা আর ফিনফিনে ঝর্নার ঝরে পড়া। ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখির দল সাঁতার কাটে অবলীলায়। প্রকৃতির মাঝে এক অনবদ্য আয়োজন। ভিজে জমিনে সবুজের আভাস। দুই পাহাড়ের মাঝে রাজার প্রান্তসীমা। না, এখন পলাশের নামগন্ধ নেই, শুধুই সবুজের বাহার। নতুন পাতার সৌরভে আরও নানা বৃক্ষের সমাবেশ। সেই জঙ্গল পেরিয়ে পাথরের মাঝে ছলাৎ ছলাৎ বয়ে আসছে পাগলপারা শীতল জলের ধারা। ধূসর আকাশের বধূ সাজে রাঙানো আকাশকে সঙ্গী করে কাকভোরে পাহাড়দাঁড়ায়। মেঘভাঙা রোদে, আদুরে দুপুরে প্রকৃতি উদার-উদাস। সঙ্গে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে ঢাউস ঢাউস পাথর। শনশনে ভেজা বাতাসে, সবুজ পাতার আন্দোলন।পাহাড়ের বাঁকা পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম স্মোকি মাউন্টেইনের সর্বোচ্চ পয়েন্ট ক্লিংম্যানস ডোম। ৬ হাজার ৬৪৩ ফুট উঁচু চূড়ায়। গাড়ি ক্লিন্সম্যানস ডোমের কাছে পার্ক করতে হয়েছে। তারপর মাইলের মতো হাঁটতে হয়েছে। এতো খাড়া পাহাড়, সবাই প্রায় হাজার ফুট না পেরোতেই বিশ্রাম নিচ্ছেন। বিশ্রামের জন্য কংক্রিটের বেঞ্চ রয়েছে। খাড়া পথ মাড়িয়ে সেই প্রতীক্ষিত সর্বোচ্চ পয়েন্টের অবজারভেশন টাওয়ারে। এখান থেকে ১০০ মাইল পর্যন্ত দেখা যায়। ৩৬০ ডিগ্রিতে প্রায় ৭টি অঙ্গরাজ্য দেখা যায় বলে জনশ্রুত আছে। মেঘের দলকে উপর থেকে দেখার এ এক অন্যন অনুভূতি। যেন ভুলিয়ে দিয়েছে দীর্ঘ খাড়া পথের ক্লান্তি। বেলার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খিদে। ফিরে এলাম গেটলিনবাগ শহরে। আমেরিকান রেস্টুরেন্টে খাবার পর্ব সেরে নিলাম। শহরে পর্যটকদের জন্য সব দোকানপাট। দুএকটা দোকান ঘুরে দেখলাম। একটা গিফট শপে ঢুকে ঘুরাঘুরি করছি- বাইরে তখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। স্থানীয় দোকানিরা জানালেন এখানের আবহাওয়ার অবস্থাও এমনি। এই রোদ এই ঝুম বৃষ্টি। অসাধারণ নিস্বর্গের আভা। শ্রাবণের ধারায় লেকের জল টইটম্বুর, পাহাড়ের কোলে সবুজেরা আরও সবুজ। এ পথের উপচে পড়া সৌন্দর্য অনেকটা এ রকম। বৃষ্টি থামলে ফিরে এলাম আমাদের পাহাড়ি কটেজে। সারা সন্ধ্যা রান্না-আড্ডায় জমেছিলাম আমরা। আমাদের সহযাত্রীদের এক পরিবার এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে। উনাদের কাছ থেকে বাংলাদেশের গল্প শুনছিলাম। গল্পে গল্পে মধ্যরাত তবুও যেন গল্প শেষ হয়নি। সকালে ধীরে স্থিরে উঠে কটেজ পরিষ্কার করে, লাগেজ ব্যাগেজ সব কিছু গাড়িতে তুলে প্রস্তুত। চারপাশে অপরূপ সৌন্দর্যের ছবি তুলে গাড়ি ছাড়লাম কেন্টাকি অঙ্গরাজ্যের পথে। নিয়ে এলাম বিস্ময়ে ভরা সব পাহাড়ি স্মৃতি। জেডএ/আরআইপি
Advertisement