একুশে বইমেলা

কোনো লেখকই প্রচারবিমুখ নন : মোহাম্মদ নূরুল হক

মোহাম্মদ নূরুল হক সমকালীন বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান কবি ও প্রাবন্ধিক। তাঁর প্রকাশিত কবিতার বই- মাতাল নদীর প্রত্নবিহার (২০০৯), স্বরচিত চাঁদ (২০১১), উপ-বিকল্প সম্পাদকীয় (২০১৬)। প্রবন্ধের বই- সাহিত্যে দশক বিভাজন ও অন্যান্য (২০১০), সমালোচকের দায় (২০১১), অহঙ্কারের সীমানা ও অন্যান্য (২০১২), সমকালীন সাহিত্য চিন্তা (২০১২), সাহিত্যের রাজনীতি (২০১৩) এবং কবিতার সময় ও মনীষার দান (২০১৬)। তাঁর সুসম্পাদিত ছোটকাগজ মেঠোপথ (১৯৯৬ থেকে), চিন্তাসূত্র (১৯৯৬ থেকে), প্রাকপর্ব (২০০০ থেকে ২০০৫) এবং অনুপ্রাস (২০০১-২০০৫)। তিনি পেশাগত জীবনে সংবাদকর্মী। দীর্ঘ গবেষণার ফল হিসেবে এবারের বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে তাঁর ষষ্ঠ প্রবন্ধের বই। এই প্রবন্ধগ্রন্থে কবিতাবিষয়ক গদ্য স্থান পেয়েছে। বইটিতে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতায় সময় ও মনীষার অভিঘাতকে সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন। সম্প্রতি জাগো নিউজের পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে কথা হয় বইমেলা এবং সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাশিল্পী সালাহ উদ্দিন মাহমুদজাগো নিউজ : এবারের নতুন বই সম্পর্কে কিছু বলুন-মোহাম্মদ নূরুল হক : এবার প্রকাশিত হয়েছে আমার ৬ষ্ঠ প্রবন্ধের বই ‘কবিতার সময় ও মনীষার দান’। এটি কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধের বই। এটি মূলত একটি দীর্ঘ প্রবন্ধের বই। কেবল আলোচনার সুবিধার্থে কবিদের নাম ব্যবহার করে উপশিরোনাম দেয়া হয়েছে। আধুনিক বাংলা কবিতায় কিভাবে সময় তার নিজের প্রভাব ফেলেছে, কিভাবে কবিরা সে প্রভাবকে কাটিয়ে উঠে সময়ের সন্তান হয়েও সময়কে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, একইসঙ্গে সৃষ্টি করেছেন প্রভাববিস্তার, তারই আলোচনা রয়েছে এই গ্রন্থে। মাত্র কয়েকজন কবিকে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেও এখানে আধুনিক বাংলা কবিতায় সময় ও মনীষার অভিঘাতকে সংক্ষেপে বর্ণনা করেছি। কখনো কখনো একটি কি দুটি বাক্য তা শনাক্তির চেষ্টাও করেছি। জাগো নিউজ : বইমেলায় আপনার প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা সম্পর্কে কিছু বলুন-মোহাম্মদ নূরুল হক : এভাবে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার হিসাব মিলিয়ে দেখিনি। তবে বইমেলা আমার কাছে প্রাণের মেলা। আমি সারা বছর বাসা টু অফিস, অফিস টু বাসায় থাকায় কোথাও বেড়াতে যাই না, তেমন একটা আড্ডায়ও বসি না। কিন্তু এই বইমেলা এলে সপ্তাহে দুদিন যে করেই হোক মেলায় যাই। পরিচিতজন, প্রিয় লেখকদের সঙ্গে আড্ডা দেই। আমার বড় প্রাপ্তি এটাই। প্রসঙ্গ একটু ভিন্ন হলেও বলতে চাই, বইমেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে একটু পর পর যেভাবে মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়, তা বইমেলার জন্য অশোভন বলে মনে করি। কারণ মাইকের শব্দে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে। বাংলা একাডেমি কি মনে করে যে, মাইকে যেসব বইয়ের নাম ঘোষণা করা হয়, পাঠক তা শুনে বই কিনতে আসে, সেগুলোই কিনবে? তবে, যদি বিশেষ প্রয়োজনে কোনো মানবিক আবেদন থাকে, তাহলে সেটাই কেবল মাইকে ঘোষণা করতে পারে। বাকি সময় মাইক বন্ধ রাখাই শ্রেয় বলে মনে করি।জাগো নিউজ : সমকালীন সাহিত্য নিয়ে আপনার গভীর চিন্তার কথা জানতে চাই-মোহাম্মদ নূরুল হক : সমকালীন সাহিত্য বলতে যদি গত বিশ-বাইশ বছরে আবির্ভূত লেখকদের সৃষ্টিকর্মের কথা বলেন, তাহলে বলব, প্লাবনের মতো কবিতার নামে কিছু একটার উৎপাদন হয়েছে। বিপরীতে ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটকে খরা যাচ্ছে। আর প্রবন্ধ বলতে গেলে হাতেগোনা কয়েকজন লিখছেন। আর যদি সমকালীন সাহিত্য বলতে আপনি এই সময়ে রচিত সাহিত্যের কথা বলেন, তাহলে বলব, সব মিলিয়ে ভালো। এখনও আমাদের অগ্রজ সাহিত্যিকরা রচনা করে যাচ্ছেন, হৃদয়গ্রাহী-মননশীল সব রচনা। আমরা এখনও অগ্রজদের সৃষ্টিকর্মে মুগ্ধ সময় পার করছি।জাগো নিউজ : সমকালীন লেখকদের মধ্যে কাদের লেখা ভালো লাগে?মোহাম্মদ নূরুল হক : এভাবে নাম ধরে ধরে বলা মুশকিল। এছাড়া ঠিক এই মুহূর্তে সবার নাম মনেও পড়বে না। তবে অনেকেরই সাহিত্যকর্মের আমি মুগ্ধপাঠক। পাঠকহিসেবে আমি সর্বভূক। ফলে সব ধরনের লেখকের সব ধরনের সৃষ্টিই আমি মনোযোগ দিয়ে পাঠ করি। আমার ভালো লাগা লেখকের সংখ্যা সুপ্রচুর। এখানে তাদের কারও নাম উল্লেখ করতে চাই না।জাগো নিউজ : সাহিত্য নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?মোহাম্মদ নূরুল হক : আমার লেখালেখির শুরুটা ছোটগল্প দিয়েই। পরে ঝুঁকেছি কবিতায়। তবে, ২০০৭ সালের দিকে প্রবন্ধ লিখতে শুরু করি। অনেক দিন ধরেই পরিকল্পনা করছি একটি উপন্যাস লিখব। নামও ঠিক করে রেখেছি—‘দাস’। এই উপন্যাসে দেখাতে চাই, দাসপ্রথা আগে ছিল, এখনো আছে। নগদ টাকায় কেনাবেচা দাসের জায়গা দখল কলেছে করপোরেট দাসপ্রথা। ব্যতিক্রম শুধু এটুকু। উপন্যাসের তিন চতুর্থাংশ লিখেছিও। গত বছরের শেষদিকে আমার কম্পিউটার নষ্ট হয়ে গেলে, পাণ্ডুলিপিও শেষ। আমাদের এখানে কবিতা নিয়ে প্রচুর গবেষণামূলক কাজ হয়েছে। কথাসাহিত্য নিয়েও অল্পবিস্তর হয়েছে। কিন্তু প্রবন্ধ নিয়ে তেমন কোনো বড় ধরনের গবেষণা বা বিশ্লেষণাত্মক কোনো কাজ হয়নি। স্রেফ প্রবন্ধসাহিত্য নিয়ে একটি বড় ধরনের গবেষণামূলক কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। জাগো নিউজ : সাহিত্যের কোন শাখা আপনাকে বেশি টানে?মোহাম্মদ নূরুল হক : প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প, নাটক, কবিতা—এসবই আমাকে টানে। বিশেষত আমি যখন পাঠক, তখন সব শাখাই আমার কাছে সমান প্রিয়। কিন্তু যখন লিখতে বসি, তখন মূলত দুটি শাখায় কাজ করি। একটি কবিতা, অন্যটি প্রবন্ধ। জাগো নিউজ : লেখালেখির ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা-মোহাম্মদ নূরুল হক : দেখুন, আমি গ্রামের ছেলে। নদীতীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ। আমার প্রেরণা অবারিত সবুজ মাঠ, মাঠের শেষে নুয়ে পড়া আস্ত নীলাকাশ। এছাড়া আমার গ্রামের দক্ষিণদিকে তাকালে অনন্ত যে জলরাশি দেখা যেত, তাই আমাকে লেখালেখির প্রেরণা দিয়েছে। তবে, আলাদাভাবে যদি প্রবন্ধ লেখার প্রেরণার কথা বলি, তাহলে বলতে হবে, কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক আবু হাসান শাহরিয়ারের কথা। আমি সেই ২০০৭ সালের দিকে কেবল কবিতা, গল্প আর রিভিউ লিখি। প্রবন্ধ লেখার কথা কল্পনাও করি না। শাহরিয়ার ভাই আমার লেখা একটি রিভিউ পড়ে বললেন, তুমি প্রবন্ধ লিখছ না কেন? তুমি লিখো। তোমাকে দিয়ে হবে। সেই শুরু। জাগো নিউজ : প্রচারবিমুখ থেকে সাহিত্যচর্চার সার্থকতা কতটুকু?মোহাম্মদ নূরুল হক : প্রকৃতপ্রস্তাবে কোনো লেখকই প্রচারবিমুখ নন। সবাই তার নিজের সৃষ্টিকর্ম তার ভোক্তাশ্রেণী পাঠককে জানাতে চান। আপনার সৃষ্টি যদি পাঠককে জানাতেই চান, তাহলে আপনি প্রচারবিমুখ হন কী করে?  প্রচারবিমুখ কথাটা ভুল অর্থে ব্যবহৃত হয়। আসলে কথাটা হওয়া উচিত প্রচারপটুত্ববিমুখ। অর্থাৎ নিজের প্রচার করা আর প্রচারের জন্য কাঙালপনা করার মধ্যে যে তফাৎ সেটা বুঝতে হবে। আপনি তো আপনার প্রচার করবেনই, না হলে লিখে তা ছাপাতে দেন কেন? কিন্তু প্রচারপটুত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখবেন। এই সরিয়ে রাখার মধ্যেই আপনার ব্যক্তিত্ব, রুচিবোধের প্রমাণ মিলবে। আর সার্থকতাও এখানে যে, কাঙালপনা না করার কারণে আপনাকে অকারণে লজ্জা পেতে হবে না। জাগো নিউজ : আপনার লেখালেখির সাফল্যে অন্যের ঈর্ষা আপনাকে বিব্রত করে কি?মোহাম্মদ নূরুল হক : কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ লেখা মিলিয়ে আমার লেখালেখির বয়স মাত্র একযুগের সামান্য বেশি। এটুকু সময়ে কেউ আমাকে ঈর্ষা করতে পারে, এমনটা আমার মনে হয় না। এছাড়া আমি কোনো জনপ্রিয় লেখকও নই। ফলে আমার সাফল্য-ব্যর্থতা সেভাবে কেউ দেখেও না। যেহেতু সেভাবে দেখে না, সেহেতু আমাকে কেউ ঈর্ষাও করে না। সাহিত্যে আমার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, আমার কোনো শত্রু নেই।  এসইউ/এমএস

Advertisement