মতামত

হায় প্রেম, হায় ভালোবাসা

ক’দিন আগেই ছিল ভ্যালেনটাইন’স ডে। বাংলায় যেটাকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বলা হয়। সেদিন এবং তার আগে বেশ কয়েকদিন ধরে মিডিয়ায় যথেষ্ট মাতামাতি হয়েছে ভালোবাসা নিয়ে। সবগুলো টিভি চ্যানেলে, পত্রিকায় ভালোবাসা দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠান, বিশেষ সংখ্যা, সাজ সজ্জা, উপহার নিয়ে বিস্তারিত প্রচার চলেছে। ফেসবুকে এর পক্ষে বিপক্ষেও প্রচুর মন্তব্য চোখে পড়েছে। যারা পক্ষে তাদের কথায় যেমন যুক্তি আছে, আবেগ আছে তেমনি যারা বিপক্ষে তাদেরও হাতে আছে যুক্তি ও আবেগ।আমি পক্ষে বিপক্ষে আজ কোনো কথাই বলবো না। ভালোবাসা মানুষের মহত্তম অর্জন। সেটার বিপক্ষে বলার কিছুই নাই। দিবসের নামে ভালোবাসার বাণিজ্যিকীকরণের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা বলা চলে। সেগুলো নিয়েও কিছু বলবো না। আজ আমি শুধু দুয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করব। প্রতিটিই একশ ভাগ সত্য। প্রথম ঘটনাটি উনিশশ’ বিশের দশকে। কলকাতা শহর। এই শহরে এক ধনী মুসলমানের বাড়িতে জায়গির থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তো এক সুদর্শন তরুণ। সেই বাড়ির গৃহকর্তার ১৪ বছরের সুন্দরী মেয়েটি তাকে ভালোবাসে। তরুণটিও। দুজনে মনে মনে স্বপ্নজাল বোনে। তাদের বিয়েও মোটামুটি ঠিকঠাক হয়ে যায়। কিন্তু আচমকা দুই পরিবারের মধ্যে সামান্য কারণে বাকবিতণ্ডা হয়ে ভেঙে যায় বিয়ে। ছেলেটি বাড়ি থেকে বিতাড়িত। মেয়ের বাবা এক সপ্তাহের মধ্যে অন্যত্র বিয়ে দেন কন্যার। পেশায় দেশজুড়ে খ্যাতি পেলেও ছেলেটি অবিবাহিত ছিল সারাজীবন। মেয়েটি কখনও সুখি হতে পারেনি দাম্পত্যে। তারপর ৭০ বছর বয়সে সেই প্রেমিকের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মৃত্যু হয় বৃদ্ধার। মৃত্যুর মধ্য দিয়েই হয়তো মিলিত হয় তারা।বিশ শতকের আশির দশকের একটি ঘটনা। ঢাকা। খালার বাসায় থেকে লেখাপড়া করে একটি তরুণ। খালাতো বোনের সঙ্গে প্রেমও। ছেলেটির বিদেশ যাবার সুযোগ আসে। যাওয়ার আগে এক বন্ধুর বাড়িতে কাজী ডেকে বিয়ে করে তারা। ছেলেটি প্রতিষ্ঠিত হলে তবে বাড়িতে জানিয়ে বউ করে ঘরে নিবে এমন প্রতিশ্রুতিতে তারা পরস্পরের হয়ে যায়। ছেলেটি বিদেশে যায়। মেয়েটির বিয়ের প্রস্তাব আসে বেশ কয়েকটি। কিন্তু নানা অজুহাতে সেগুলো ফিরিয়ে দেয় সে। বাবা মারা যান।বাবা মারা যাওয়ার পর বড়ভাই এবার বোনকে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগে। মেয়েটি বাধ্য হয়ে সব খুলে বলে। এবার পরিবারের পক্ষ থেকে প্রবাসী ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ছেলেটি সব অস্বীকার করে। বলে বিয়ে হয়নি। একজন কাজী সেজেছিল। যা হোক। এবার মেয়েটির বিয়ের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ততোদিনে সাতাশ পেরিয়ে যাওয়া, সাদামাটা চেহারার এবং মধ্যবিত্ত ঘরের বাপমরা মেয়েটির আর বিয়ে হয়নি। বিশেষ করে তার বিয়ের ঘটনাটি এমন বদনাম ছড়ায় যে আর পাত্র পাওয়া যায় না। এখন মেয়েটি ভায়ের বাড়িতে বিনে মাইনের রাঁধুনি। ছেলেটি সুখে আছে বিদেশি স্ত্রী নিয়ে।  গত তিন মাসের পত্রিকার খবর। মোবাইল ফোনে একজনের সঙ্গে প্রেম। তারপর সেই প্রেমিকার আহ্বানে সাড়া দিয়ে অপহরণের শিকার হয় এক তরুণ। শেষ পর্যন্ত বাড়িতে ফেরে তার মৃতদেহ। আরেক কিশোর কোচিংয়ে যাবার পথে এক কিশোরীর সঙ্গে প্রেমে জড়ায়। শেষ পর্যন্ত লাশ হয়ে বাড়ি ফেরে বাবা মায়ের আদরের  ছেলেটি। প্রেমিকের হাত ধরে বাড়ি ছাড়ে এক তরুণী। প্রেমিক ও তার বন্ধুদের গণধর্ষণের শিকার হওয়া তার লাশ পাওয়া যায় বাড়ি থেকে অল্প দূরে। ভালোবেসে বিয়ে করা স্বামীর হাতে জীবন হারানো অসংখ্য মেয়ের কান্না শুনতে পাই আমি। শুনতে পাই প্রেমিকার সঙ্গে ঘনিষ্ট সময়ের ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে অট্টহাসি হাসা মানব-হায়েনার আস্ফালন। সত্যিকারের ভালোবাসা কি তবে এখন নেই? থাকবে না কেন। আজও আছে। বাঁশি আজও বাজে। বাজে নূপুরও। তবে হাজার হাজার মিথ্যে বাঁশির আওয়াজের মধ্যে সঠিক সুরটি চিনে নেওয়া বেশ মুশকিল। তেমনি মুশকিল শত নূপুরের ধ্বনি থেকে সঠিক তালের ধ্বনি চিনে নেয়া। ভুল মানুষকে ভালোবেসে জীবন ধ্বংস করে ফেলা অনেক কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। অনেকের কথা শুনেছি। অনেকের ঘটনা পড়েছি পত্রিকায়। অধিকাংশ সময়ই ভুল করে ভুল জলে নেমে পড়া মানুষের আর ফেরার পথ থাকে না। আর এখন ভার্চুয়াল প্রেমের জগতে অ্যাকচুয়াল প্রেম খুঁজে পাওয়া, চিনে নেয়া সবটাই কঠিন। কোন প্রেম সঠিক আর কোনটা ভুল কে বলে দিবে? গুরুদেবের ভাষায়, ‘দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?’ তবে সময়ের কষ্টি পাথরেই প্রমাণ হয়ে যায় ভালোবাসার আসল-নকল। যে প্রেম গড়তে দুইদিন, ভাঙতে একদিন সেগুলো আদপে প্রেমই নয়। আর যে প্রেম জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে পৌঁছে যায় একক উচ্চতায় সেটিই প্রকৃত প্রেম। সেটাই মানবজীবনের মহত্তম সত্য। আর সেই উচ্চ শৃংগের আশেপাশেই আছে অতল খাদ। সে খাদ মিথ্যের, সে প্রেম ভ্রান্তির, সে প্রেম স্বার্থের। সে ভালোবাসার সুন্দর মুখোশ পরে থাকে বটে, কিন্তু মুখোশ সরালে দেখা যায় তার কুৎসিত রূপ। কোনটা মুখ আর কোনটা মুখোশ সেটাও বলে দেয় সময়। কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষকে তাই বলতে চাই, সম্পর্কে জড়ানোর আগে একটু ভাবনা, একটু সতর্কতা দরকার। ভীষণ দরকার। ভালোবেসে ঝাঁপ দিন চোখ বন্ধ করে তাতে আপত্তি জানাচ্ছি না। কিন্তু ঝাঁপ দেয়ার আগে চোখটা খুলে একটু দেখে নিন কোথায় ঝাঁপ দিচ্ছেন। লেখক : কবি, সাংবাদিক। shantamariavalia@gmail.comএইচআর/এমএস

Advertisement