ভালো-মন্দের বিবেচনাবোধ তৈরির আগেই অনেক শিশু বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পরিবার থেকে। অনেকে পারিবারিক কলহ ও অশান্তির কারণেও বিচ্ছিন্ন হয়। এরপর জীবিকার তাড়নায় তাদের জড়াতে হয় নানা কাজে। হাতে অর্থ আসতে শুরু হলে শুরু হয় অবক্ষয়ও। স্বাভাবিক জীবনের পরিবর্তে এসব শিশু মাদক গ্রহণ শুরু করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গবেষণা অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১৫ বছরের নিচে মোট ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ শিশু মাদকের ভয়াল ছোবলের শিকার। কেন এই অবক্ষয়? তা নিয়ে জাগো নিউজে থাকছে চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ তৃতীয় পর্বে থাকছে জীবন সংগ্রামের জন্য ঢাকায় এসে মাদকের অন্ধকারে পা বাড়ানো শাহীন ও আকাশের গল্প।রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে যে পথশিশুদের আনাগোনা তাদেরই একজন শাহীন। পারিবারিক অশান্তির জেরে মাদকের পথে পা বাড়াতে হয়েছে এই শিশুটিকে। শাহীনের বাবা খুরশীদ আলম তার মামার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন। সময় মতো টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় শাহীনদের ঘর ভেঙে দেয়া হয়। দিনের পর দিন ফেরারি হয়ে ঘুরে বেড়ায় শাহীন, বাবা-মা ও তিন ভাই-বোন। কয়েক মাস এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির ফলেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাদকের অন্ধকারে পা বাড়ায় শাহীন।জাগো নিউজের সঙ্গে দীর্ঘ ২ ঘণ্টা কথা হয় শাহীনের। প্রথমেই তার কাছে জানতে চাওয়া হয় বয়স। কয়েকবার চিন্তা করেও নিজের বয়স বলতে পারেনি সে। সদরঘাটের অন্য শিশুরা সঠিক বয়স না জানলেও আন্দাজ করে একটি সংখ্যা অন্তত বলে। কিন্তু শাহীনের ক্ষেত্রে বিষয়টা ছিল একটু ভিন্ন।• প্রথম পর্ব: মায়ের ওপর বাবার নিপীড়ন ভুলতে মাদক নেয় মেহেদীমাদকের অন্ধকার পথে পা বাড়ানোর কারণ জানতে চাইলে শাহীন বলে, শেরপুরে জন্ম নিয়েছিলাম। বাবা কৃষক ছিলেন। তিনি আমাদের পাঁচজনের সংসার চালাতেন। মাঝে মাঝে টাকার অভাব থাকলেও কোনো মতে চলতাম আমরা। শেরপুর ছাড়ার পরিকল্পনা কখনোই ছিল না। কিন্তু মামা যখন বাড়ি ভেঙে দেয়, তখন আমরা মরার ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাই। সবাই মিলে ঢাকায় আসার কিছুদিন পর বাবা মারা যান। মা যাত্রাবাড়ী একটি বাড়িতে কাজ করে আমাদের চার ভাইবোনকে খাওতো। সংসার খুব কষ্টে চলতো। আমরা ঠিকমতো খেতে পারতাম না। তাই কাজের সন্ধানে সদরঘাট আসি। এখানে এসে কাজ করতে করতে এখানেই বন্ধুদের সঙ্গে থাকি, তাদের সঙ্গে খাই। রাতে বন্ধুদের সঙ্গেই গাঁজা খেয়ে নেশা করি।গত তিন মাসে সাত রকমের মাদকদ্রব্য নিয়েছে শাহীন। গুনে গুনে এগুলোর নামও বলেছে সে।সদরঘাটে কথা হয় আকাশ নামের আরেক মাদকাসক্ত পথশিশুর সঙ্গে। আকাশের এ পথে আসার কারণ জানতে চাইলে সে জানায়, বাবা চাইতো আমি কাজ করে তাকে টাকা দেই। টাকা না দিতে পারলে সে মারধর করতো। তাই সদরঘাটে এসে কাজ করি। বন্ধুদের সঙ্গে গাঁজা খাই।আকাশ নিয়মিত গাঁজা খায়। নেশা উঠলে যাত্রীদের পকেট কাটা শুরু করে সে। এ বিষয়ে সে জাগো নিউজকে বলে, একবার এক বিদেশির পকেট কেটে মানিব্যাগ থেকে ১২০ ডলার পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার মালিক প্রতারণা করে ১৪০ টাকা দিয়ে বিদায় করে দেয়।আকাশসহ সদরঘাটের ১৫ পথশিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল এখানে খুব সহজেই মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়। অনেকে শিশুদের কাছে মাদক পৌঁছে দেয়। আকাশ জানায়, সন্ধ্যার পর থেকে কমলাপুর, টিটিপাড়া ও গুলিস্তানে গাঁজাসহ সব ধরনের মাদক পাওয়া যায়। আমরা অনেক সময় কিনতে যাই, অনেক সময় তারা নিজেরা এসেও দিয়ে যায়। সবাই জানে কিন্তু কেউই কিছু বলে না।জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, একটি গোষ্ঠী সদরঘাটের শিশুদের দিয়ে ভিক্ষাসহ নানা ধরনের কাজ করায়। শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দেয় না তারা। স্কুলে যেতেও বাধা দেয়। এই গোষ্ঠীর কেউ কেউ বিভিন্ন মেয়াদের সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের সরদার ছিলেন। যথেষ্ট ‘প্রভাবশালী’ তাদের কেউ কেউ।• দ্বিতীয় পর্ব: বন্ধুর হাত ধরেই মাদকের কবলে শিশুরাএই ‘প্রভাবশালীদের’ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) নজরুল ইসলাম সিকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিশুদের হাতে যারা এসব মাদক পৌঁছে দিচ্ছে তাদের ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের একটি তালিকা তৈরি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে।’এ বিষয়ে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. এম এ আজিজ জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশে মাদকসংক্রান্ত যেসব আইন আছে তার যথাযথ প্রয়োগ ও যুগোপযোগী করতে হবে। এসব বিষয়ে সরকারের যে ধরনের প্রচার-প্রচারণার দরকার তা নিয়মিত করলে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব।এআর/এসএম/এনএফ/এমএস
Advertisement