মতামত

সার্কাসের মঞ্চ

ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে সেদেশের গণমাধ্যমের সাথে তার সম্পর্কটি এক অদ্ভুত অবস্থায় পৌঁছেছে। ট্রাম্প নিজে যেমন নানা কীর্তি করছেন, তেমনি সেখানকার গণমাধ্যমও চাঞ্চল্যকর খবরকেই শুধু খবর করে তুলছে।পুরো বিষয়টি যেন এক ব্যর্থতায় ভরা সার্কাস। তার সম্পর্কে যত নেতিবাচক খবর বের হচ্ছে ততই ট্রাম্প তার ধারণা পোক্ত করছেন যে, গণমাধ্যম শুধু ভুয়া খবরই পরিবেশন করে। আর এতে করে তার অতি প্রতিক্রিয়া গণমাধ্যমকে আরো উস্কে দিচ্ছে ‘অ-খবরের’ পেছেনে ছুটতে। খবর মানেই এখন ট্রাম্পীয় আচরণ। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারের সময় আমেরিকান মূল ধারার মিডিয়া ট্রাম্পকে নিয়ে যেসব খবর ছেপেছে তাতে তার জেতার কথা নয়। কিন্তু তিনি জিতেছেন। আর প্রেসিডেন্ট হয়ে যাওয়ার পর থেকে সেখানকার গণমাধ্যম সিদ্ধান্ত নিয়েই নেমেছে যে, তাকে একজন স্বাভাবিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে চিত্রায়িত করা হবেনা। ন্যায্যতা আর ভারসাম্যের নীতি থেকে দূরে সরে মার্কিন গণমাধ্যম এখন শুধু চটকদার খবর দেয়ায় ব্যস্ত। প্রথম প্রথম কিছুটা প্রাপ্তি যোগ হলেও এখন ফলাফল অন্যরকমই মনে হচ্ছে। চরম ট্রাম্প বিরোধী লোকজনও ভাবতে শুরু করেছে গণমাধ্যম কি পারে এমন ভাবে একজন ব্যক্তি বিরোধী হতে?          হোয়াইট হাউজ করেসপনডেন্ট ডিনার বর্জনের আহ্বান, বিরুদ্ধ মতকে তুলে না ধরা, কিংবা ট্রাম্পের পক্ষের মানুষদের টিভিতে না ডাকা সবই করছে সেখানকার গণমাধ্যম। গত বছরের ৮ নভেম্বর থেকে মার্কিন গণমাধ্যম এক শিশুসুলভ কান্নাকাটি করে চলেছে। কারণটা সবার জানা। তারা নির্বাচনে যা চেয়েছিল তা হয়নি। তাদের প্রার্থী পরাজিত হওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ, হতাশ ও প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেছিল যা এখনো অব্যাহত আছে। একজন প্রার্থীর পরাজয়কে নিজেদের পরাজয় হিসেবে দেখছে এবং তারা ভাবছে তারা কি তবে আমেরিকার সমাজে অপাঙক্তেয় হয়ে পড়লো? ধারণা করা হয়েছিল মূলধারার মার্কিন গণমাধ্যম এই নির্বাচন থেকে শিক্ষা নেবে যে তারা মানুষকে বুঝতে কতটা ভুল করেছে। তারা যাকে চেয়েছে, জণগণ তাকে চায়নি। কিন্তু না, তারা নিজেদের অক্ষমতাকে বিচার না করে নতুন করে পুরোনো কৌশল প্রয়োগ করছে একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে মানুষের কাছে হাস্যকর করে তুলতে। ট্রাম্প প্রশাসনের লোকজন যখন সাংবাদিকদের বিরোধী দল হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তার পর থেকে সাংবাদিকরা যেভাবে প্রতিক্রিয়াধর্মী সাংবাদিকতা করছে তাতে মনে হয় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নেতা নন, ইরান বা উত্তর কোরিয়ার। তারা হয়তো এটা মানতে নারাজ যে, তাদের দেশের অর্ধেক মানুষ এ মানুষটিকে চেয়েছে এবং প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত করেছে। যদি তা-ই হয় তাহলে বলতে হবে এখন যা হচ্ছে তার পুরোটা সাংবাদিকতা নয়, পরাজিতের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। যখন এই মানুষটিকে জনগণের কাছে আরো দায়বদ্ধ করে তোলা প্রয়োজন ছিল তখন, তখন তারা ব্যস্ত হয়েছে তার দায়িত্ব গ্রহণের অনুষ্ঠানের ভিড়ের আকার নিয়ে। এবং এটি করে যেটি হয়েছে, প্রথম দিন থেকেই মুখোমুখি অবস্থানে প্রেসিডেন্ট ও মিডিয়া। একটা কথা মনে রাখা দরকার মিডিয়া যতদিন তাকে আক্রমণ করে যাবে, তার সমর্থকরা ততই তার পক্ষে অবস্থান দৃঢ় করবে।  একটি সুস্থ, কার্যকর, বস্তুনিষ্ট ও ন্যায্য গণমাধ্যমের কাজ হবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তিকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ করা, উপহাস করা নয়। ইতোমধ্যেই মার্কিন নাগরিক সমাজ মনে করতে শুরু করেছে, প্রথম দিকে বারাক ওবামার সাথেও কতটা অসহযোগিতা করেছিল তাদের গণমাধ্যম। ট্রাম্পের সাথে যা করছে এখন তা দেখলে মনে হবে ওবামা প্রশাসন পুরো আট বছর সব ঠিক কাজ করে গেছে, কোন ভুল ছিলনা। কিন্তু বাস্তবতো তা নয়। হলে জনগণ তার প্রার্থী হিলারীকেই নির্বাচিত করতো। ট্রাম্প নিজেও নিয়োজিত আছেন নানা ধরনের বিতর্ক জন্ম দিতে। যেন এক শিশু অতি আহ্লাদিত কোন কিছু পেয়ে। ট্রাম্প ক্ষুদ্র বিষয়কেও অবজ্ঞা করতে জানেন না। তিনি টুইট করেন, প্রতিপক্ষকে খেপিয়ে মজা পান। তিনি টুইটারে সেলিব্রিটিদের আক্রমণ করেন যাদের তিনি পছন্দ করেন না বা যারা তাকে পছন্দ করেনা। তার নিজের একটা ভাবমূর্তি নিজেও দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন যে, তিনি যা ভাবেন তা-ই ঠিক। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আর ব্যবসায়ী ট্রাম্প এক ব্যক্তি নন, এটাও তার বোঝাবুঝির বাইরে। মিডিয়া তাকে ঘা দিলে, পাল্টা ছুঁয়ে দিতে বিলম্ব নেই তার। ওভাল অফিসের যে ভাবগাম্ভীর্য তা থেকে অনেক দূরের মানুষ তিনি। তিনি খোঁচা দিয়ে দেখতে চান প্রতিক্রিয়া কি আসে। মার্কিন গণমাধ্যমও সেই খেলায় ব্যস্ত এখন। দেশটিতে বলাবলি শুরু হয়েছে যে, এই ব্যর্থ সার্কাসের মঞ্চে ট্রাম্প এবং মিডিয়া খারাপ প্রদর্শনীর প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। তারা যে যার স্থানে ঠিক থাকবে হয়তো, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এর মাঝে কত কি হারিয়ে ফেলছে!লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি। এইচআর/এমএস

Advertisement