ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। সাবেক নির্বাচন কমিশনার। নিরাপত্তা বিশ্লেষক। গবেষণা করছেন নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে। নির্বাচন কমিশন গঠন, নির্বাচন ব্যবস্থা ও রাজনীতি নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরেন মতামত। নির্বাচন ব্যবস্থার যে ক্ষতি হয়েছে, এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে বিপদ আরও ভয়াবহ হবে বলে মত দেন তিনি।জাগো নিউজ : অনেকেই মনে করেন আইনি দুর্বলতার কারণেই ইসি প্রতিকূল পরিবেশ কাটিয়ে উঠতে পারে না। আপনার বিশ্লেষণ কি? সাখাওয়াত হোসেন : যারা আইনের দুর্বলতার কথা বলেন, তারা সঠিক জানেন বলে মনে হয় না। আইনের দুবর্লতা বলতে কিছু নেই। তবে কমিশনের আইনকে শক্তিশালী করার প্রয়োজন রয়েছে। জাগো নিউজ : তার মানে সফলতা ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্ভর করছে? সাখাওয়াত হোসেন : অবশ্যই। আমাকে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিলেন। আমার ওপর হামলা হচ্ছে এবং আমি চুপ করে বসে আছি। এজন্য তো অস্ত্রের দোষ হতে পারে না। জাগো নিউজ : সংকট উত্তরণে নতু ইসির উদ্দেশে কী বলবেন? সাখাওয়াত হোসেন : নতুন কমিশনাররা সবাই বিজ্ঞ বলে মনে করি। সবাই প্রশাসনে সম্পৃক্ত ছিলেন। আমি মনে করি, তাদের প্রথম কাজ হবে রিভিউ করা। একেবারেই স্বল্পতম সময়ের ব্যবধানে নির্বাচনের দুটি মডেল কমিশনের সামনে আছে। মানুষ শামসুল হুদা ও রকিব কমিশনের স্মৃতি এখনও ভোলেনি। নতুন কমিশন কোনটি গঠন করবে, সেটাই দেখার বিষয়। এর আগে পর্যালোচনা করা জরুরি। তবে শুধু ভালোগুলো পর্যালোচনা করলে হবে না। কী খারাপ হলো, তা আমলে নেয়াই হচ্ছে সহজ পথ। জাগো নিউজ : এর পরের চ্যালেঞ্জ কী? সাখাওয়াত হোসেন : ভাবমূর্তি দাঁড় করানোই নতুন কমিশনের বড় চ্যালেঞ্জ। ক্ষমতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, সততা এবং নিরপেক্ষতার প্রশ্নে জনমনের আস্থা অর্জনে যা করার তাই করবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তাদের এখনই স্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জাগো নিউজ : বাহ্যিক চ্যালেঞ্জের কথা বললেন। অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ নিয়ে কী বলবেন? সাখাওয়াত হোসেন : অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ অবশ্যই অনেক বড়। কিন্তু বাহ্যিক বিষয়গুলো আমলে না নিলে তো ভেতরের বিষয়ে ধারণা পাবেন না। আপনি দৃশ্যমান কিছু দেখাতে পেরেই হয়তো ভেতরের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সুবিধা পাবেন। নইলে তারা এগোতে পারবে না। জাগো নিউজ : এত সময় মিলবে? সাখাওয়াত হোসেন : নতুন কমিশনের হাতে সময় একেবারেই কম। যদি সফলতার ধারাবাহিকতা থাকত, তাহলে এ কমিশনকে এতো চ্যালেঞ্জ নিতে হতো না। নির্বাচন ব্যবস্থাপনার চরম ক্ষতি করে গেছে রকিব কমিশন। ভেঙে পড়া কাঠামোকে দাঁড় করানোই নতুন কমিশনের চ্যালেঞ্জ। জাগো নিউজ : কমিশন নিয়ে প্রত্যাশা অনেক। শেষ বিচারে প্রাপ্তি কী হতে পারে? সাখাওয়াত হোসেন : প্রত্যাশা রাখতে তো অসুবিধা নেই। আমরা উন্নত বিশ্বের নির্বাচন ব্যবস্থাও প্রত্যাশা করতে পারি। কথা হচ্ছে, সেখানে পৌঁছার জন্য সঠিক পথে আছি কিনা? বাধাগুলো অতিক্রম করার মধ্য দিয়েই প্রাপ্তির কাছে যেতে হয়। আমি মনে করি না এই মুহূর্তে সেই পথ তৈরি হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিকভাবে আমরা নজরে রয়েছি। আমরা বিশ্ব ব্যবস্থারও অংশ। এ ব্যবস্থাকে অস্বীকারের সুযোগ নেই। জাগো নিউজ : আগের নির্বাচনে সরকার তো অস্বীকার করলই। স্থিতিশীল অবস্থাও রয়েছে দেশের ভেতর-বাহির। সাখাওয়াত হোসেন : সরকার স্থিতিশীল অবস্থায় আছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। বড় কোনো রাজনৈতিক বাধা ফেস করছে না বলেই সমস্যা ঘনীভূত হচ্ছে। রাজনৈতিক বাধা অতিক্রম করলেই সরকার বুঝতে পারতো, সমস্যাগুলো কোথায়? সবই তো এক নীতিতে চলছে। এক দৃষ্টিতে দেখলে সমস্যা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা যায় না। জাগো নিউজ : এভাবে চলতে পারাও তো বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। দেশ তো এগিয়ে যাচ্ছে? সাখাওয়াত হোসেন : দেশ এগিয়ে যাবেই। মানুষ থেমে থাকে না। দৌড় প্রতিযোগিতায় সবাই এগিয়ে যায়। কেউ পেছায় না। প্রশ্ন হচ্ছে কতটুকু এগোলো। যুদ্ধের মধ্যেও সমাজ এগিয়ে যায়। নেপাল, ভুটানের মতো দেশও এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের তো বসে থাকার সুযোগ নেই। জাগো নিউজ : বিশ্ব ব্যবস্থার কথা বলছিলেন। গত নির্বাচনে তো আন্তর্জাতিক চাপ সরকারের কাছে ধোপে টেকেনি? সাখাওয়াত হোসেন : এভাবে কতবার? একবারও ধোপে টিকবে না, তা তো হতে পারে না। বারবার একই সংকট সৃষ্টি হলে তো যারা বিশ্বব্যবস্থার অংশীদার তাদের কাছেও তো বিকল্প পথ আছে। আমরা তো মূলত সরবরাহকারী। রাজনীতি ঘিরে অস্থিরতা থাকলে সমাজে নানা সংকট জন্ম দেয়। গুলশান, শোলাকিয়ার সংকট তো আমরা দেখলাম। জাগো নিউজ : কিন্তু আপাতত বৈশ্বিক চাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না? সাখাওয়াত হোসেন : চাপের আপনি-আমি কী বুঝবো? যারা সরকার পরিচালনা করছেন, চাপের হিসাব তাদের কাছে। কিছু নজির তো আমরা দেখতে পাচ্ছি। জাগো নিউজ : যেমন? সাখাওয়াত হোসেন : প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি আর ওই ধরনের নির্বাচন দেখতে চান না। জাগো নিউজ : এর মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী কী বোঝাতে চাইছেন? সাখাওয়াত হোসেন : অবশ্যই এমন মন্তব্যের পেছনে বিশেষ কারণ আছে। পাবলিকলি প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি কথারই বিশেষ অর্থ থাকে। তার এ মন্তব্যের পেছনে অবশ্যই বিশেষ কারণ আছে। তিনিই বেশি বিশ্ব নেতাদের ফেস করেন। তাদের পক্ষ থেকে যদি বারবার নির্বাচনের প্রসঙ্গ তোলা হয় তবে সেটা ঐতিহ্যবাহী একটি দলের জন্য সুখের কথা নয়। একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এমন প্রশ্ন বারবার হজম করা সহজ নয়। একই প্রশ্নে বারবার সমালোচিত হওয়া এক সময় খারাপ লাগতেই পারে। প্রধানমন্ত্রী তো চাননি ১৫৪ এমপিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করতে হবে। জাগো নিউজ : নির্বাচন কমিশন এমন ঝুঁকি নেবে কেন? সাখাওয়াত হোসেন : আমিও তো নির্বাচন কমিশনার ছিলাম। আমি তো কিছুটা জানি। জাগো নিউজ : আপনার সময় আর রকিব কমিশনের সময় পরিস্থিতি কি এক ছিল? সাখাওয়াত হোসেন : আমি মনে করি না, প্রধানমন্ত্রী সরাসরি এমন নির্দেশনা দিয়েছেন। জাগো নিউজ : পরিবেশ তৈরি হলে বলার আর প্রয়োজন থাকে? সাখাওয়াত হোসেন : পরিবেশ তৈরির পেছনে কমিশনেরও দায় আছে। রিটার্নিং অফিসার শত দোষ করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। শিডিউল ঘোষণা করাই তো কমিশনের একমাত্র কাজ নয়। সরকার তো বলেনি, সহিংসতা করো। সহিংসতা বন্ধ করা তো কমিশনের দায়িত্ব। আমরা এ দায়িত্ব দেখতে পাইনি। রকিব কমিশন সহিংসতার বিরুদ্ধে স্পষ্ট করে কোনো কথা বলেনি। বলতে পারতো আমরা এভাবে বাধার সম্মুখীন হচ্ছি। আমরা ব্যবস্থা নিতে পারছি না। তাহলে মানুষ বুঝতে পারতো। স্বীকার করবেন না আবার দায়ও নেবেন না, তা তো হতে পারে না। কমিশন তো মুয়াজ্জিন না। আজান দিয়েই শেষ। কে নামাজে এলো তা তার দেখার বিষয় না। আপনার সাংবিধানিক দায়িত্বে বিশাল ক্ষমতা রয়েছে। সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে আপনার অনেক পথ আছে। জাগো নিউজ : আগামী নির্বাচন নিয়ে কী প্রত্যাশা করছেন? সাখাওয়াত হোসেন : আমি মনে করি, আগামী নির্বাচন রকিব কমিশনের মতো হবে না। সংঘাতপূর্ণ হলেও ততোটা হবে না। জাগো নিউজ : ভরসা পান? সাখাওয়াত হোসেন : আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে চাইলেও তাদের সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়েই আসতে হবে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। আর সে বিকল্প না এলে কারো জন্যই মঙ্গল হবে না। সরকার উন্নয়ন করছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে সর্বক্ষেত্রে। এমন সফলতায় এতটুকু খুঁত বারবার রাখবে কেন? রাজনীতিতে সংকট থাকলে কেউ ভালো থাকতে পারে না। এএসএস/এএইচ/জেআইএম
Advertisement