বিরাট কোহলি ব্যতিক্রম। তার মেধা-প্রজ্ঞা অসাধারণ। এক বছরের কম সময়ে চার চারটি টেস্ট ডাবল হান্ড্রেডই বলে দেয় ব্যাটসম্যান বিরাট আসলে কত বড়। এই রান মেশিনকে এখনই শচীন টেন্ডুলকারের সাথে তুলনা করা হয়। কাজেই তার মানের কারো থাকার প্রশ্নই ওঠে না। বিরাট কোহলির সঙ্গে তামিম, মুশফিক ও সাকিবের তুলনা হবে বাতুলতার সামিল। আচ্ছা, বিরাটকে বাদ দিয়েই ধরা যাক। হায়দরাবাদে ভারতের হয়ে যে বাকি ১০ ক্রিকেটার খেলেছেন, তাদের সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মৌলিক পার্থক্যের জায়গা কোনটি? তা খুঁজতে বেরিয়ে এসেছে এক কঠিন সত্য। মেধা-প্রজ্ঞা ও সামর্থ্যে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যে খুব পিছিয়ে; তা নয়। সাকিব, মুশফিক ও তামিম, মাহমুদউল্লাহ, মিরাজ ও তাসকিনরা আসলে পিছিয়ে অন্য জায়গায়। তাদের দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট চর্চা ও অনুশীলনটাই কম। বছরের বেশি সময় সীমিত ওভারের ক্রিকেট খেলা, অনুশীলনের সিংহভাগ ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টির প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকা। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট কম খেলা তথা দীর্ঘ পরিসরের ম্যাচ প্র্যাকটিসের অভাব প্রবল। আর সে কারণেই বোলাররা কোন লাইন ও লেন্থে বল করবেন? ব্যাটসম্যানরা কোন সেশনে কার বিরুদ্ধে কি অ্যাপ্রোচে ব্যাট করবেন? তা ঠাউরে উঠতে সমস্যা হচ্ছে। ভারতের সাথে হায়দরাবাদে একমাত্র টেস্টেও বোঝা গেছে, বাংয়লাদেশের ক্রিকেটারদের দীর্ঘ পরিসরের ম্যাচ খেলার টেম্পার্টমেন্ট, ধৈর্য, মনোযোগ-মনোসংযোগ এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী বল ও ব্যাট করার অভিজ্ঞতা কম। দেশের ক্রিকেটের তিন কুশলী ও অভিজ্ঞ যোদ্ধা মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, খালেদ মাহমুদ সুজন ও সারোয়ার ইমরান জাগো নিউজের সাথে আলাপে এমন মতামতই ব্যক্ত করেছেন। জাতীয় দলের দুই সাবেক অধিনায়ক মিনাহজুল অবেদিন নান্নু ও খালেদ মাহমুদ সুজনের সঙ্গে সাবেক জাতীয় কোচ সারোয়ার ইমরানও মনে করেন, দীর্ঘ পরিসরের ম্যাচ কম খেলার কারণেই বাংলাদেশের ব্যাটিং ও বোলিং প্রত্যাশিত মানে পৌছাচ্ছে না। তাদের তিনজনের কথা, ‘টেস্টে এখনো অনেক কিছু শেখার বাকি আছে।’ তারা কিছু জায়গায় তিনজনই একমত, যেমন দীর্ঘ পরিসরের খেলার নানা সুক্ষ্ম কৌশল আত্মস্থ করা না থাকলে জায়গামতো গিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন; যেহেতু বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের একটা বড় অংশ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেন কম, তাই কোন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে কী করতে হবে? এখনো তা পুরোপুরি জানা নেই। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু একটা কৌশলগত বিষয় তুলে ধরে বলেন, ‘ হায়দরাবাদে ‘এসজি ’ বলে খেলা হয়েছে। ভারতীয়রা সারা বছর ওই এসজি বলে খেলে। এসজিই বলের চরিত্রই হলো ৩০ ওভার পর্যন্ত সাইন বা ঔজ্জ্বল্য বেশি থাকে। তারপরও ঔজ্জ্বল্য কমে যাওয়ার পাশাপাশি বল নরমও হয়ে যায়। এগুলো আমাদের পেসারদের অজানা। সেটা ওই এসজি বলে চার দিনের ম্যাচ খেলে খেলেই জানতে হবে। ওই বল পুরনো ও নরম হওয়ার পর কোন লাইন ও লেন্থে বল করতে হবে, সেটা আদ্যে কতটা সুইং করবে- তা না জানা থাকলে কখনই ভালো বোলিং হবে না।’ দেশের প্রথম টেস্ট কোচ ও অভিজ্ঞ দ্রোণাচার্য সারোয়ার ইমরান মনে করেন, টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে বেশি বেশি দীর্ঘ পরিসরের ম্যাচ খেলতেই হবে। তার সোজা সাপটা কথা, চার দিনের ম্যাচ না খেলে কারো টেস্টে ভালো খেলার সম্ভব নাই। ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট হচ্ছে দীর্ঘ পরিসরের খেলার সব রকম কৌশল শেখা ও জানার আদর্শ জায়গা। এখানে খেলে খেলেই নিজেকে তৈরি করতে হবে। কখনও ছাড়তে হবে, কখন সমীহ করতে হবে- এসব জানতে এবং আত্মস্থ করতে গেলে বেশি করে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলতে হবে। হায়দরাবাদ টেস্টের প্রসঙ্গ টেনে সারোয়ার ইমরান বলেন, ‘প্রথম ইনিংসে আমাদের পেসাররা অনেক বেশি খাটো লেন্থে বল ফেলেছে। তাই সাফল্য ধরা দেয়নি। দ্বিতীয় ইনিংসে তাসকিন ওপরে ওপরে বল করে সাফল্য পেয়েছে। একইভাবে বছরের বেশির ভাগ সময় ওয়ানডে এং টি-টোয়েন্টি খেলার কারণে ছাড়ার প্রবণতা খুব কম। অথচ টেস্টে ভালো বলকে সমীহ দেখাতেই হবে। আর যে ডেলিভারি বিপদের কারণ হতে পারে তা দেখে উইকেট কভার করে ছেড়ে দেয়ার মানসিকতা দরকার। বেশি করে চার দিনের ম্যাচ না খেললে সে অভ্যাস জন্মাবে না।’অন্যদিকে জাতীয় দলের ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজনও জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের আরও বেশি করে অন্তত বছরের আট-দশটি দীর্ঘ পরিসরের ম্যাচ খেলার তাগিদ দিয়েছেন। তার কথা, ‘কোন শর্ট কার্ট পথ নেই। দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট খেলে খেলেই হাত পাকাতে হবে। ভারতের ব্যাটসম্যানরা রঞ্জি, দুলিপ ও ইরানী ট্রফি খেলে খেলে নিজেকে ঘসে মেজে তৈরি করে ফেলেন। আমাদের ক্রিকেটাররা তুলনামূলক অনেক কম চার দিনের ম্যাচ খেলে।’ এ ক্ষেত্রে ক্রিকেটারদের প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলার ইচ্ছে কম বলে অভিযোগ থাকলেও খালেদ মাহমুদ সুজন তা মানতে নারাজ। তার কথা, ‘ঠিক তা নয়। আসলে আন্তর্জাতিক সফর সূচির সাথে তাল মেলাতে গিয়েই আমাদের জাতীয় ক্রিকেটারদের জাতীয় লিগ ও বিসিএল খেলা কম হয়।’ খালেদ বলেন, ‘আমাদের আবহাওয়া এমন যে সারা বছর ক্রিকেট চর্চা কঠিন। দেখা যায় এমন এক সময় দীর্ঘ পরিসরের আসর বসছে, যখন জাতীয় দল দেশের বাইরে কোনো সিরিজ বা আসরে ব্যস্ত। তাই জাতীয় ক্রিকেটারদের দীর্ঘ পরিসরের ম্যাচ খেলার সুযোগও কম হয়। তবে এ ধারা পাল্টাতে হবে। যে করেই হোক জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা যাতে অন্তত আট থেকে দশটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলতে পারে সে ব্যবস্থা করা খুব জরুরি।’ খালেদ মাহমুদ সুজন একই সাথে দীর্ঘ পরিসরের আসরে উইকেট ভালো করার জোর তাগিদও অনুভব করছেন। তার দাবি, ‘স্পোর্টিং! পিচ তৈরি করতে হবে আরও বেশি করে। চার দিনের ম্যাচগুলো স্পোর্টিং উইকেটে হলে ক্রিকেটারদের লাভ হবে। তারা নিজেদের সব রকম পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারবে।’এরআরবি/এনইউ/বিএ
Advertisement