খেলাধুলা

উজ্জ্বল পারফরম্যান্স আর ভালো ফলের আক্ষেপ ঘুচবে কবে?

মাঝে এমন হয়েছিল। তবে সেটা সীমিত ওভারের ক্রিকেট মানে ওয়ানডে- টি-টোয়েন্টি দুই ফরম্যাটে। যেখানে টাইগাররা একটা পর্যায় বেশ ভালো করতেন। ব্যাট ও বলে পারফরম্যান্স হতো উজ্জ্বল। তাতে করে তৈরি হতো সম্ভাবনা। জয়ের সুঘ্রাণ এসে লাগতো নাকে। মনে হতো জয় হাতছানি দিচ্ছে। এই বুঝি জয়ের নাগাল পাওয়া যাবে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। শেষ অবধি আর জয়ের দেখা মিলতো না। সময়টা ২০১২ সালের এশিয়া কাপের ফাইনাল থেকে ২০১৪-এর বিশ্ব টি-টোয়েন্টি আসরের আগে। ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি মিলে ৪ থেকে ৫ ম্যাচে অমন হয়েছে। ২০১২ সালের ২২ মার্চ শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের সাথে ২৫ হাজার দর্শক সমর্থক ও ভক্তের গগনবিদারী শেষ ওভারে তিন উইকেট হাতে রেখে ছয় বলে ৯ রান করতে না পারার দুঃখ। শেষ বলে বাউন্ডারি প্রয়োজন পড়লেও লেগ বাই থেকে এক রানের বেশি নেয়া সম্ভব হয়নি। এরপর ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ের সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া। মাত্র ৬৭ রানে লঙ্কানদের ৭ উইকেটের পতন ঘটিয়েও জিততে না পারা। নয় নম্বরে নামা পেসার থিসারা পেরেরার ৫৪ বলে ৮০ রানের হার না মানা ইনিংসে সর্বনাশ। সেখান থেকে শেষ তিন উইকেটে আরও ১১৩ রান যোগ করে ১৮০ রানের ছোট্ট পুঁজি নিয়েও ১৩ রানের জয় লঙ্কানদের। সেবার শ্রীলঙ্কার সাথে ঘরের মাঠে দুই ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজেও জিততে পারতো মাশরাফির দল। প্রতি খেলায় টাইগাররা হেরেছিল শেষ বলে। প্রথমবার ব্যাটিংয়ে থেকে। পরেরবার বোলিংয়ে। প্রথমবার শেষ বলে ৩ দরকার থাকা অবস্থায় ২ রানে হার। আর পরের বার শেষ বলে চার খেয়ে ৩ উইকেটের দুঃখজনক পরাজয়। একইভাবে ২০১৪ সালের ১ মার্চ ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের সাথে অপ্রত্যাশিত হার। ৯০ রানে আফগানদের ইনিংসের অর্ধেকটার পতন ঘটিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। ওই অবস্থা থেকে আফগানরা ২৫৪ রানের লড়িয়ে পুঁজি গড়ে তোলে। পরবর্তীতে ৩২ রানের হার বাংলাদেশের। এখন যেন আবার সে অবস্থা হয়েছে। নিউজিল্যান্ড সফরের পুরো সময় ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি আর টেস্টের কোনো এক সময় বেশ ভালো খেলেছেন টাইগাররা। মনে হয়েছে আজ কিছু একটা হবে। তারপর ঠিক একটি পর্যায়ে গিয়ে সে সম্ভাবনার প্রদীপ গেছে নিভে। ভারতের সাথে সবে শেষ হওয়া একমাত্র টেস্টে ঠিক অতো ভালো অবস্থা তৈরি করা সম্ভব না হলেও শুরু কিন্তু খারাপ হয়নি। দুই ইনিংসেই ভারতের উদ্বোধনী জুটি ভেঙেছিল অল্প সময় ও সংগ্রহে। টেস্টের প্রথম ওভারেই ব্রেক থ্রু মিলেছিল। কিন্তু হায়; তা কাজে লাগেনি একটুও। টেস্টের ৪ নম্বর ডেলিভারিতে ওপেনার  লোকেশ রাহুল ফিরে গেলেও শুরুর ধাক্কা সামলে উঠে শেষ পর্যন্ত ৬৮৭ রানের হিমালয় সমান স্কোর গড়েছে বিরাট কোহলির দল। গুণে গুণে তিন-চারটি ক্যাচ মিস, দুই ব্যাটসম্যান পিচের মাঝখানে  দাঁড়িয়ে পড়ার পরও রান আউট করতে না পারা এবং স্ট্যাম্পিংয়ের সহজ সুযোগ হাতছাড়ার মাশুল ভারতের ওই পাহাড় সমান রান।  বাংলাদেশের দুই ইনিংসে যে-ই না কোনো একটা জুটি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা জেগেছে, ঠিক তখনই তা ভেঙে গেছে। আর তাইতো ২০৮ রানের বড় পরাজয়। একটু মন দিয়ে খেয়াল করুন, দেখবেন হায়দরাবাদে যা হয়েছে, বাংলাদেশ যেমন খেলেছে তার চেয়ে অন্তত ৩০% ভালো খেলার সুযোগ ও সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগাতে না পারার কারণেই লড়াই জমেনি। না হয়, ভারতের মাটিতে প্রথম টেস্ট ম্যাচটি স্মরণীয় হয়ে থাকতো মুশফিক বাহিনীর লড়িয়ে পারফরম্যান্সে। একটা হাড্ডহাড্ডি লড়াই দেখতো ক্রিকেট বিশ্ব। কিন্তু তা আর হলো কই? লক্ষ্য করুন, অধিনায়ক বিরাট কোহলির ডাবল সেঞ্চুরি (২০৪) মুরালি বিজয়ের (১০৮) শতরান আর তেচেশ্বর পুজারা (৮৩) ও অাজিঙ্কা রাহানে (৮২) আশির ঘরে পা রাখলেও ভারতের ইনিংস শেষ হয়ে যেতে পারতো সাড়ে পাঁচশো`র আশপাশে। শেষ পর্যন্ত ৬৮৭’তে পৌঁছেছে ঋদ্ধিমান সাহার সেঞ্চুরি ও রবীন্দ্র জাদেজার আক্রমণাত্মক অর্ধশতকে। কিপার ঋদ্ধি ও বাঁহাতি স্পিনার রবীন্দ্র জাদেজা সপ্তম উইকেটে জুড়ে দিয়েছেন অবিচ্ছিন্ন ১১৮ রান। ঋদ্ধিমান ৪ রানে নিশ্চিত স্টাম্পিংয়ের হাত থেকে বেঁচে গিয়ে করেছেন ১০৬। বাঁ-হাতি স্পিনার তাইজুলের বলে ঋদ্ধিকে স্টাম্পিং করার সুবর্ণ সুযোগ হারিয়েছেন মুশফিক। মানে ভারতের কিপারের ১০২-ই বোনাস। একইভাবে রবীন্দ্র জাদেজা ৬০ রানের অপরাজিত ইনিংসটিও নিশ্ছিদ্র নয়। অফস্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজের বলে ডিআরএসে ০ রানে লেগবিফোর উইকেটের ফাঁদে পড়া থেকে বেঁচে যাওয়া জাদেজা ওই মিরাজের বলেই ৪০ রানে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু তামিম তা ধরতে ব্যর্থ হলে জাদেজা তেড়েফুড়ে আরও ২০ টি রান যোগ করেন। এভাবেই ফিল্ডারদের চরম ব্যর্থতায় ভারত সোয়াশো রান বেশি পেয়েছে। একবার ভাবুন তো, ৬৮৭ রান করা দল যদি ১২৫ রান কম করতো তাহলে কি বাংলাদেশ আর ২০৮ রানের বড় ব্যবধানে হারতো? সবচেয়ে বড় কথা- ভারতকে সাড়ে পাঁচশো’র মধ্যে বেঁধে রাখতে পারলে বাংলাদেশ আর প্রথম ইনিংসে ২৯৯ রানের বদলে পিছিয়ে থাকতো না। ব্যবধান কমে দেড়শোর আশপাশে থাকতো। সেটাই শেষ নয়। আরও ভালো পরিণতি হওয়ার সুযোগ ছিল ব্যাটিংয়েও। এইতো গত মাসে ওয়েলিংটনে নিউজিল্যান্ডের সাথে ৩৫৯ রানের রেকর্ড জুটি গড়া সাকিব-মুশফিকের সামনেও এসেছিল আবারো বড়সড় পার্টনারশিপ গড়ার সুযোগ। কিন্তু সাকিবের অতি আক্রমণাত্মক মেজাজ ও অযথা অপ্রয়োজনীয় তুলে খেলার ইচ্ছাতেই সে সম্ভাবনাময় জুটির অপমৃত্যু হয়েছে। না হয় সে জুটি ১০৭ রানে থেমেছে, তা ৩০০ + না হোক দু‘শোতে গিয়ে ঠেকতে পারতো। সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটার ফিরিস্ত আছে আরও। দ্বিতীয় ইনিংসে যে দুজনার ব্যাটে ছিল আশার আলো, সেই মাহমুদউল্লাহ আর মুশফিকুর রহীম হেঁটেছেন ভুল পথে। প্রথম ইনিংসে যিনি ছিলেন, ধৈর্যের প্রতিমূর্তি, যার ইনিংসের পরতে পরতে মনোযোগ-মনোসংযোগ আর দায়িত্ববোধ মাখানো ছিল, সেই সংগ্রামী শতক উপহার দেয়া মুশফিক আজ সকালে হাঁটলেন ভুল পথে। উইকেটে সেট হয়ে যাওয়ার পর অযথা অফস্পিনার রবিচন্দন অশ্বিনকে লং অফের ওপর দিয়ে ছক্কা হাঁকাতে গেলেন। যেকোনো ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণে অফস্পিনে লং অফ ও একস্ট্রা কভারের ওপর দিয়ে তুলে মারা মানেই বাড়তি ঝুঁকি। ক্রিকেটীয় ভাষায় স্পিনের বিপক্ষে শট। পরিনতি হয়েছে করুণ ; সীমানার কাছাকাছি ক্যাচ তুলে ফিরে আসা। ওতে যে মুশফিকের নিজের ইনিংসটির অপমৃত্যু ঘটেছে তা নয়, দলের সম্ভাবনার প্রদীপও তখনই সলতে হয়ে গেছে। একই পথে হাঁটলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও। সেই নিউজিল্যান্ড সফর থেকে রান খরায় ভুগছেন। রান করা যেন ভুলেই গেছেন। আজ বেশ কটি ইনিংস পর তার ব্যাট কথা বলছিল। পঞ্চাশ পেরিয়ে ষাটের ঘরে পৌঁছেই করলেন বড় ভুল। তার পুল খেলার অভ্যাস আছে। তা জেনে বুঝে লং লেগকে একটু বাঁ-দিকে টেনে খাট লেন্থ থেকে ঠুকে দিলেন ইশান্ত শর্মা। ওটা যে সাজানো ফাঁদ, তা বোধ করি মাথায় আসেনি। মাহমুদউল্লাহ পুল খেলে ফেললেন। বাতাসে ভেসে বল চলে গেল সীমানার কাছে। ওত পেতে থাকা ভুবনেশ্বরের হাতে।  যে হার হতে পারতো আরও লড়িয়ে। যে হারের সাতকাহনে লেখা থাকতে পারতো দৃঢ় সংকল্প আর কঠিন সংগ্রামের কাহিনী- তার সাদামাঠা পরিসমাপ্তি হলো। এই যে বারবার ভালো করার সুযোগ হাতছাড়া। সেটাকে কি ভাগ্য বিড়ম্বনা? নাকি সামর্থ্যে ঘাটতি। বারবার একটা পর্যায়ে থেমে যাওয়া কিন্তু সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতার নির্দেশক। এ সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা যে খুব জরুরি। এআরবি/এনইউ/পিআর

Advertisement