খেলাধুলা

হারলেও আত্মসমর্পণ করেননি মুশফিকরা

খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার অনেক্ষণ পর, এমনকি পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরও মনসুর আলি খান পাতৌদি স্ট্যান্ডের এক কোণে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা পতপত করে উড়ছিল। হায়দরাবাদের রাজীব গান্ধী স্টেডিয়ামে তার কিছুক্ষণ আগেই ২০৮ রানের ব্যবধানে পরাজয় ঘটে গেছে বাংলাদেশের; কিন্তু এই পরাজয়ে গ্লানি নেই। টেস্ট র‌্যাংকিংয়ের এক নম্বর দলের বিপক্ষে পঞ্চম দিন দ্বিতীয় সেশনের শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছে বাংলাদেশ। আরেকটু অভিজ্ঞতা থাকলে হয়তো টেস্ট ম্যাচটা বাঁচিয়েও ফেলতে পারতেন মুশফিকরা। তা না হলেও, শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করতে পারাটাও কম নয়। লাল সবুজের পতাকা সেই মাহাত্ম্যই সম্ভবত ঘোষণা করে যাচ্ছিল। যদিও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে আরও সলিড একটা লড়াই প্রত্যাশা করেছিলেন সমর্থকরা।পঞ্চম দিনের খেলা শুরুর আগেই সঙ্গে এক টিভি সাক্ষাৎকারে ভারতের সাবেক অধিনায়ক কপিল দেব বলেছিলেন, বাংলাদেশ বড় জোর ৫০ ওভার খেলবে। এর বেশি খেলতে পারবে না। ভিভিএস লক্ষ্মণ বলেছিলেন, ২ সেশনেই শেষ হয়ে যাবে বাংলাদেশের ইনিংস। আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় ব্যাটসম্যান চেতেশ্বর পুজারা বলেছিলেন, ২ সেশনেই শেষ করতে চাই আমরা। আর বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং কোচ থিলান সামারাভিরা দিয়েছিলেন লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি। কপিল দেবের কথাও সত্যি হলো না, থিলান সামারভিরার প্রতিশ্রুতিরও প্রতিফলন হলো না। চেতেশ্বর পুজারা কিংবা ভিভিএস লক্ষ্মণেরই কথা সত্যি হলো। দ্বিতীয় সেশনের একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে ২৫০ রানে অলআউট বাংলাদেশ। ২০৮ রানে ম্যাচ জিতে নিয়েছে ভারত। তবে হেরে গেলেও ১০০ ওভারের বেশি খেলেছেন টাইগাররা। তবে একই সঙ্গে টানা ৬ষ্ঠ টেস্ট সিরিজ জিতে নিলো ভারত। ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কার মাটিতে টেস্ট সিরিজ জয়ের পর থেকে টানা জিতেই যাচ্ছে ভারতীয়রা।শেষ দিনে বিরাট কোহলিদের বিজয় দেখতে খুব বেশি দর্শক উপস্থিত হননি। বিশেষ করে চতুর্থ দিনের তুলনায়। চতুর্থ দিন গ্যালারিতে দর্শক উপস্থিত হয়েছিলেন প্রায় ২৪ হাজার। আর শেষ দিন উপস্থিত হলেন মাত্র ১০ হাজার। হয়তো সপ্তাহের প্রথম কর্মব্যস্ত দিন হওয়ার কারণে হয়তো, খুব বেশি দর্শক উপস্থিত হতে পারেননি মাঠে। কিংবা হায়দরাবাদের দর্শকরা বুঝে গিয়েছিলেন, নিশ্চিত জয় পেতে যাচ্ছে ভারত। আগের দিন যে অশ্বিন-জাদেজার হাতে উইকেট হারিয়েছেন বাংলাদেশের তিন টপ অর্ডার। ভারতীয় দর্শকরা যেন জানেই, শেষ দিন এই দুই স্পিনারের সামনে খুব বেশিক্ষণ টিকতে পারবেন না বাংলাদেশের বাকি সাত ব্যাটসম্যান।ভাবনাটা তাদের ঠিকই ছিল। শেষ পর্যন্ত সেটাই ঘটেছে। তবে বিরাট কোহলিরা জানেন, এই জয়টা পেতে তাদের কতটা ঘাম ঝরাতে হয়েছে। টেস্টের প্রথম দুদিন হয়তো বাংলাদেশের নখদন্তহীন বোলিংয়ের বিপক্ষে ঘাম ঝরানো ছাড়াই সেঞ্চুরি এবং ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলেছিলেন কোহলি; কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর নামতেই রাজীব গান্ধীতে যে কাঠফাটা রোদের তীব্রতা তৈরি হয়, এর মধ্যে বোলিং এবং ফিল্ডিং করা কতটা কষ্টকর, সেটা কোহলি-অশ্বিনরা ছাড়া আর কে বুঝবে!শেষ দিকে মিরাজ-রাব্বি এবং তাইজুল-রাব্বি তো কোহলিদের নাভিশ্বাসই তুলে দিয়েছিলেন। মিরাজ-রাব্বি খেলেছেন ১৪.১ ওভার। আর তাইজুল-রাব্বি খেলেছেন ৭.১ ওভার। তাইজুল জাদেজার বলে ওই পাগলামিটা না করে বসলে তো এই জুটি আরো অনেক লম্বা হতে পারতো। সেটা রানে না হোক, বল এবং সময় ক্ষেপণে। তবুও বাংলাদেশ তো শেষ পর্যন্ত খেলতে পেরেছে ১০০ ওভারের বেশি। সবচেয়ে বড় কথা, দুই ইনিংস মিলিয়ে বাংলাদেশ খেলেছে ২২৮.২ ওভার। এটাই বা কম কিসে! যদিও ভারত খেলেছিল ১৯৫ ওভার। ক্রাইস্টচার্চেও রাব্বি দেখিয়েছিলেন, কিভাবে টেস্টে ব্যাটিং করতে হয়। ৬৩ বলে মাত ২ রান করেছিলেন তিনি; কিন্তু বোল্ট, সান্তনার, সাউদিদের সামনে দাঁত কামড়ে কিভাবে উইকেটে টিকে থাকতে হয় সেটার জ্বলন্ত প্রমাণ যেন রাব্বি। এবারও রাজীব গান্ধীতে একই দৃঢ়তা দেখালে তিনি। ৮৪ মিনিট উইকেটে থেকে ৭০ বল মোকাবেলা করেছেন। রান করেছেন মাত্র ৩টি। শেষ পর্যন্ত রাব্বির উইকেটই নিতে পারলো না ভারতীয় বোলাররা। তিনি থেকে গেলেন অপরাজিত। প্রথম ইনিংসেও অপরাজিত ছিলেন। ১০ বল মোকাবেলা করে যদিও রানের খাতা খুলতে পারেননি।টেস্টে নম্বর ওয়ান দলকে ঘাম ঝরিয়ে জিততে হয়েছে। এটাই বা কম কিসে? মাত্রই তো কিছুদিন আগে নিজেদের মাটিতে ইংল্যান্ডকে নাকানি-চুবানি খাইয়েছে ভারত। তার আগে বিধ্বস্ত করেছে নিউজল্যান্ডকে। তার আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাদেরই মাটিতে বিধ্বস্ত করে এসেছেন কোহলিরা। তার আগে দক্ষিণ আফ্রিকা। নিজেদের মাটিতে এমনই অজেয় ভারত, এই টেস্টেও অজেয় থেকেছে। তবে বিরাট কোহলিকে দীর্ঘদিন মনে রাখতে হবে, অনেক কষ্ট করে জিততে হয়েছে তাকে।প্রথম ইনিংসে ভারতের ৬৮৭ রানে পিষ্ট হয়েই মনোবল হারিয়ে ফেলেনি বাংলাদেশ। একসময় এত বড় রান দেখলে মাঠে নামার আগেই হেরে বসতো টাইগাররা; কিন্তু এবার আর আত্মসমর্পণ করেননি। টেস্ট শুরুর আগে মুশফিক যেমন বলেছিলেন, ৫দিন খেলতে চান। অধিনায়কের সেই আশা পূরণ হয়েছে। তারা পাঁচদিন খেলতে পেরেছেন। কখনও কখনও লড়াইও করেছেন সমানতালে। যদি প্রথম ইনিংসে পাওয়া সুযোগগুলো ঠিকঠাক মতো কাজে লাগাতে পারতো বাংলাদেশ, তাহলে নিশ্চিত এই টেস্টের ফল ভিন্নও হতে পারতো।প্রথম ইনিংসেই ২৯৯ রানের লিড পেয়েছিল ভারত। ইচ্ছা করলে বিরাট কোহলি পারতেন বাংলাদেশকে ফলোঅন করাতে। যদি ফলোঅন করতেই হতো বাংলাদেশকে, তাহলে দ্বিতীয় ইনিংসের হিসেবে তো ইনিংস পরাজয়ই ঘটে বাংলাদেশের। তবে প্রায় ৫ সেশন বোলিং করার পর বিরাট কোহলি তার বোলারদের ওপর আর চাপ সৃষ্টি করতে চাননি। তাদেরকে কিছুটা রিলাক্স দেয়া, উইকেটে আরও কিছু ভাঙ্গন সৃষ্টি করার লক্ষ্যেই দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমেছিল ভারত।মাত্র এক সেশন ব্যাট করেই আবার বাংলাদেশকে ছেড়ে দিয়েছিল ভারত। লক্ষ্য দিল- ৪৫৯ রান। ব্যাট করার সুযোগও দিল ৪ সেশন, ১২৫ ওভার। এই ১২৫ ওভারে ৪৫৯ রান করা খুব সম্ভব। তবে ভারতের মাটি বলে কথা। অশ্বিন আর জাদেজাদের জন্যই যেখানে উইকেট তৈরি করা হয়, সেখানে অন্য কেউ ৪৫৯ রান করে ম্যাচ জয় করে নেবে, তা তো পুরোপুরিই অকল্পনীয় একটি ব্যাপার। চতুর্থ দিন শেষ বিকেলেই সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল। ভারতের দুই স্পিনারের সামনে তিন উইকেট হারিয়ে।শেষ দিন শুধু দেখার বিষয় ছিল কত দূর যেতে পারে বাংলাদেশ, বাকি সাত উইকেট নিয়ে। সাকিব আল হাসান আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ উইকেটে ছিলেন আশার বাতি হয়ে; কিন্তু শেষ দিনের শুরুতেই সেই বাতি নিবিয়ে দিলেন জাদেজা। সাকিব আক্রমণাত্মক খেলতে যাননি। তবুও জাদেজার ঘূর্ণি সামলাতে পারেননি। ২২ রানে আউট হয়ে গেলেন। মাহমুদউল্লাহ কিছুটা সাহস দেখালেন। ১৯ মাস পর টেস্টে হাফ সেঞ্চুরির দেখা পেলেন তিনি। ১৪৯ বল খেলে, ২০০ মিনিট উইকেটে টিকে থেকে করেন ৬৪ রান। বিশেষ করে মুশফিক আর সাব্বিরের সঙ্গে ছোট ছোট দুটি জুটি গড়ে চেষ্টা করেছিলেন বাংলাদেশকে আরও অনেক দূর টেনে নিয়ে যাওয়ার।পারলেন না। ইশান্ত শর্মার বলে ভুবনেশ্বর কুমারের হাতে ক্যাচ দিতে বাধ্য হলেন। মুশফিক ২৩, সাব্বির ২২, মিরাজের ২৩ শেষ আশার প্রদীপ হয়ে মিটি মিটি জ্বলে উঠে আবার নিভে গেছে অশ্বিন-জাদেজার ঘূর্ণির সামনে। এই দুই স্পিনারই ৪টি করে মোট ৮টি উইকেট ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। বাকি দুটি নেন ইশান্ত শর্মা।বাংলাদেশের সমর্থকরা ভেবেছিলেন, অন্তত মুশফিক আরও একটু লড়াকু হবেন। প্রথম ইনিংসে ভুল করেছিলেন সাব্বির। সে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে সেটা কাজে লাগাবেন; কিন্তু পারলেন না। তিনিও রণে ভঙ্গ দিয়ে ফিরে আসলেন। মিরাজের কাছ থেকে বেশি আশা ছিল না; কিন্তু প্রথম ইনিংসে তার ৫১ রানের ইনিংসটা প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেটাও আশা ভঙের বেদনা নিয়ে শেষ হয়ে গেলো। রাব্বির মাটি কামড়ে পড়ে থাকাই ছিল শেষ মুহূর্তের প্রশান্তি। এছাড়া বলতে গেলে কাঙ্ক্ষিত লড়াইটাই ঠিকমতো করতে পারলো না বাংলাদেশ। তবুও শেষ দিন শেষ বিকেল পর্যন্ত টেস্ট টেনে নেয়ার কৃতিত্ব দাবি করতেই পারে মুশফিক অ্যান্ড কোং।সংক্ষিপ্ত স্কোরভারত ১ম ইনিংস: ৬৮৭/৬, ১৬৬ ওভার ডিক্লে, (কোহলি ২০৪, মুরালি বিজয়, ১০৮, ঋদ্ধিমান সাহা ১০৬*, পুজারা ৮৩, রাহানে ৮২, জাদেজা ৬০*, অশ্বিন ৩৪; তাইজুল ৩/১৫৬, মিরাজ ২/১৬৫, তাসকিন ১/১২৭)। দ্বিতীয় ইনিংস : ১৫৯/৪, ডিক্লে, ২৯ ওভার (পুজারা ৫৪*, কোহলি ৫৮, রাহানে ২৮, জাদেজা ১৬*, রাহুল ১০; তাসকিন ২/৪৩, সাকিব ২/৫০)বাংলাদেশ ১ম ইনিংস :  ৩৮৮/১০, ১০৪ ওভার (মুশফিক ১২৭, সাকিব ৮২, মিরাজ ৫১, মাহমুদউল্লাহ ২৮, তামিম ২৪, সৌম্য ১৫, সাব্বির ১৬, তাইজুল ১০; উমেশ যাদব ৩/৮৪, জাদেজা ২/৭০, অশ্বিন ২/৯৮, ইশান্ত শর্মা ১/৬৯, ভুবনেশ্বর কুমার ১/৫২)। বাংলাদেশ ২য় ইনিংস : ২৫০/১০, ১০০.৩ ওভার (মাহমুদউল্লাহ ৬৪, সৌম্য ৪২, মুমিনুল ২৭, সাকিব আল হাসান ২২, মুশফিক ২৩, সাব্বির ২২, মিরাজ ২৩, রাব্বি ৩, তাইজুল ৬, তাসকিন ১; অশ্বিন ৪/৭৩, জাদেজা ৪/৭৮, ইশান্ত শর্মা ২/৪০)।ফল: ভারত ২০৮ রানে জয়ী। ম্যাচ সেরা: বিরাট কোহলি।আইএইচএস/এনইউ/জেআইএম

Advertisement