মতামত

মধুর বসন্ত

ঋতুরাজ বসন্তের আজ প্রথম দিন। প্রকৃতিতে এখন নতুন উন্মাদনা।বাংলা বছরের পরিক্রমায় সব শেষে আসে বসন্ত। বছরের শেষ, ফুলে ফুলে ভরে ওঠা চারদিক, সাথে কোকিলের পাগল করা ডাক- এই বসন্ত কামনা বাসনার অন্ত নেই বলে মনের ভেতরটাকে জাগিয়ে দেয়, সে-ই তো সার্থকতা বসন্তের। এই ঋতুতে বাস মানুষের বাসনার। ফাল্গুন আর চৈত্র মাস মিলে বসন্ত ঋতুর আয়োজন সম্পন্ন হয়। ফাল্গুন একেবারে গ্রামীণ শব্দ থেকে উৎসারিত। এই মাসে গাছের পাতারা টুকরো টুকরো (ফাল) হয়ে ঝরে পড়ে, গাছে গাছে কচি কচি (ফাল) পাতা গজিয়ে ওঠে, গাছে গাছে গুনতি গুনতি (ফাল) ফুল ফোটে যা কিছু দিন পরেই পরিণত হবে সুমিষ্ঠ ফলে। ফাল+গুণ=ফাল্গুন।মানুষের মন উদাস হয় বসন্তে। বাংলার বসন্ত সৃষ্টিশীল করেছে বাংলার মানুষকে, হাতে তুলে দিয়েছে একতারা-দোতারা, কণ্ঠে তুলে দিয়ে গানের সুর। গাছপালা নিধনে সিদ্ধহস্ত মানুষ কমিয়ে দিচ্ছে ফুলের সাজ, আধুনিকতার প্রয়োজনে বলি হচ্ছে সব সাধ-আল্লাদ, ভালবাসার আকুলতা। অথচ এই বসন্তেই ভালবাসা দিবসের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এই ভালবাসার মেকি আয়োজন মানুষের হাতে ঘটে বটে, তবে অন্য প্রাণিকূলের ভালবাসার প্রয়োজনে বাগড়া কেন দেয় মানুষ ? প্রকৃতি উজাড় হলে কোথায় পাব প্রাণিদের? প্রাণিরা না থাকলে ভালবাসার বৈচিত্র্য থাকবে কি? মানুষ ভালবাসতে শিখেছিল প্রকৃতির কাছ থেকে। বসন্ত উধাও হলে মানুষের ভালবাসার হবেটা কি? এসব ভেবে মানুষ নানান এ্যাপস-এ ভালবাসার পসরা সাজায়। ভালবাসার সব রস শুকিয়ে দিয়ে মানুষ কেন ফেরে ভালবাসার খোঁজে, সে শ্লোক বসন্ত ভাঙে কী উপায়ে !শীত পেরিয়ে বসন্ত তখনি আসে, যখন সূর্যের আলো ক্রমশঃ খাড়া ভাবে পড়তে শুরু করে পৃথিবীর বুকে। রোদের তাপ বাড়তে থাকে। ঠাণ্ডায় কাবু প্রকৃতি গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে পারে ঐ উষ্ণতার জোরে। শীতে রোদ কম পেত বলে গাছেরা সালোকসংল্লেষণের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছিল, ঝরে গিয়েছিল কত পাতা। বসন্তে সূর্য আশ্বাস দেয় বলে নতুন পাতা গজায়, যাতে ক্রমশঃ বেড়ে যাওয়া সূর্যের আলো বেশি পাতায় পড়ে আর গাছ বেশি বেশি খাবার তৈরি করতে পারে। কখনো কখনো বসন্তের ভ্যাপসা গরম বৃষ্টি নামিয়ে আনে। শীতে মাটিতে পানি ছিল না, গাছের শেকড় ছিল অভুক্ত, ফলে বসন্তের বৃষ্টির ধারা নাচিয়ে দেয় গাছেদের অব্যক্ত মনটাকেও।জলবায়ুর পরিবর্তনকে। বিশ্ব উত্তপ্ত হচ্ছে, এর ফলে বসন্ত রূপ হারাচ্ছে। এই কষ্ট একা বসন্তের নয়, সব ঋতুরই আজ বেহাল অবস্থা। কে কখন আসছে যাচ্ছে, টের পেতে কষ্ট হয়। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা টের পাওয়া গেলেও শরৎ-হেমন্ত-বসন্তের খোঁজ নেই। সহজে বোঝা যায় না। অতীতের মত সরল নয় ঋতুর আখ্যান। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ বসন্ত ঋতু, সবচেয়ে দুঃখী মানুষ এই ঋতুটির জন্যই। যে প্রেমিক ভালবাসার প্রকাশ ঘটাতে বসন্তের অপেক্ষায় ছিল, সে যদি কিছুতেই টের না পায় বসন্ত এল কি না, জানালা খুলে বসন্তকে না পেয়ে যদি দেখে গ্রীষ্মের খর উত্তাপ, তবে তার প্রেম যে শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে যাবে! এরপরও প্রেমিকের হাতে ফুল, প্রেমিকার পরণে বাসন্তী রঙের শাড়ি দেখে মনে হয়, বসন্তের সমাধিতে এ অর্ঘ্য বুঝি বিফলেই যাবে। আজকাল এসব কেবলি বসন্ত নামক মুমূর্ষু ঋতুটির স্মরণে শোকগাথার মত আনুষ্ঠানিকতা বলে মনে হয়। পৃথিবীর সব কবি আজও বসন্তকে নিয়ে ভাবাবেগের তুবড়ি ছোটাচ্ছেন, এর দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপও করছে না প্রকৃতি। কেন না, সে মরমর। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় কাত হয়ে বসন্ত চিৎপটাং আজ। তাই বসন্তের স্বাভাবিকতাকে ফিরিয়ে আনতে হবে।তবেই আমরা প্রাণখুলে গাইতে পারবো- ‘আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়..।’এইচআর/এমএস

Advertisement