তখন মধ্য দুপুর; ঘড়িতে পৌনে ২টা। শীত চলে যাওয়া ও বসন্তের আগমনী সময়ের মাঝামাঝি দুপুর বেশ মধুর। কড়া রোদ চোখের দৃষ্টি ঝাপসা করে যায় বটে, রোদের তাপ বেশ মিষ্টি লাগে। এমনই এক সোনা ঝরা দুপুরে একদল বিনোদন সাংবাদিক গতকাল শুক্রবার (১০ ফেব্রুয়ারি) গিয়েছিলাম মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে। ঝিটকা পেরিয়ে চমৎকার এক ইউনিয়ন। সবুজ শ্যামল; যেমন অপার্থিব হয় গ্রাম বাংলার সৌন্দর্য তেমনি রূপবতী। গাড়ি থেকে নেমেই চোখে পড়লো বেশ দূরে ফসলি ক্ষেতের মাঝখানে ছোট্ট টিলার উপর শত শত মানুষের জটলা। চারদিক থেকে ছুটে আসছে আরো অসংখ্য মানুষ। নারী আর কিশোরির সংখ্যাই বেশি। সেজেগুজে, বোরকা পরে দূর-দূরান্ত থেকেও এসেছিলেন অনেকে। উদ্দেশ্য ‘পোড়ামন’ ছবির সফল জুটি সাইমন-মাহির শুটিং দেখা।মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে চলছে মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের চলচ্চিত্র ‘জান্নাত’র দৃশ্যধারণ। ছবিটিতে জুটি হয়ে কাজ করছেন ঢালিউডের সফল ও আলোচিত জুটি সাইমন-মাহি। আলাদা করে দুজনেরই গ্রহণযোগ্যতা তুঙ্গে। বিশেষ করে জাকির হোসেন রাজুর পরিচালনায় ‘পোড়ামন’ ছবি দিয়ে সাইমন-মাহি গ্রাম বাংলার দর্শকদের মনে প্রেমের দারুণ এক জনপ্রিয় জুটি হয়ে আছেন। তাই মুখে মুখে প্রিয় জুটির শুটিংয়ের খবর শুনে সবাই ছুটে এসেছিলেন দুপুরের খাওয়া সকালে মিটিয়ে। অনেকে আবার না খেয়েই রোদ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছিলেন সাইমন-মাহির রোমান্স।সাংবাদিক দল দেখেই ছুটে এলেন পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মানিক। সবার সঙ্গে কুশলবিনিময় করলেন। এলেন নায়ক ও নায়িকা। বেশ খানিকক্ষণ চললো কুশল ও আড্ডা পর্ব। চার পাশে চোখ রেখে দেখা গেল বাহারি সব সাজসজ্জায় রঙিন শত শত দর্শক। আছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। সবার চোখে মুখে ‘সিনেমার নায়ক-নায়িকা’ দেখার মুগ্ধতা। তবে যে কথা বললেই নয়, শুটিং স্পটের অনেক অভিজ্ঞতা আছে অম্ল-মধুর। অনেকবারই দেখেছি বেপরোয়া দর্শককে সামলাতে হিমশিম খান পরিচালক। ঘটে যায় অনেক বাজে ঘটনাও। তবে দুটি স্পটে প্রায় চার ঘণ্টা কাটানোর পর হরিরামপুরের মানুষের প্রশংসা শুরুতেই না করলে অন্যায় হয়। কী চমৎকার একটা শৃঙ্খলা বজায় রেখে তারা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে শুটিং দেখছিলেন। উঠতি কিছু যুবক নায়ক সাইমনকে একা পেয়ে সেলফির আব্দার করলেও নায়িকা বিরক্ত হতে পারেন ভেবে তার কাছ ঘেঁষতে দেখা যায়নি কাউকে। ছবি তুলেছেন দূরে দাঁড়িয়ে। আর শুটিংয়ে কারো কিছু প্রয়োজন পড়লেই স্থানীয় মানুষগুলো ছুটে যাচ্ছে সেটির জোগার করতে। গ্রামের সহজ-সরল এ মানুষগুলোর সহযোগিতা, ভালোবাসা নিশ্চয়ই মনে রাখবে ‘জান্নাত’। গতকাল শুক্রবার ছিল একটি গানের শুটিং। পরিচালক মানিক জানান, ‘এই গানটির দৃশ্যায়ন শেষ হলে দুটি গানের শুটিং শেষ হবে। এখন চলছে ‘মন যদি ভেঙে যায় লাগে না জোড়া’ শিরোনামের গানের শুটিং। সুর-সংগীতের পাশাপাশি এতে কণ্ঠও দিয়েছেন আরেফিন রুমি।’গানের দৃশ্যায়নে দেখা গেল ফসলি মাঠের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে সরু রাস্তা। তার বুকের ওপর দিয়ে সাইকেলে মাহিকে নিয়ে চলেছেন সাইমন। টানা দেড় ঘণ্টা চললো শুটিং। শুটিং প্যাকআপ করে শুরু হলো নতুন স্পটের দিকে যাত্রা। সেটিও হরিরামপুরেই। গ্রামের নাম গুনেরপুটি। পৌঁছাতে প্রায় ১০ মিনিট লাগলো। যেতে যেত কথা হলো ছবির নায়ক সাইমনের সঙ্গে। জানালেন, ‘খুবই চমৎকার একটি গল্প ‘জান্নাত’র। কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে এ ছবিটি আমার এবং মাহির ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধ করে দেবে। এর গানগুলোও বেশ চমৎকার। গানের দৃশ্যায়নগুলোও হচ্ছে গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য মিলিয়ে। কাজ করে মজা পাচ্ছি। পরিচালক খুব গুছিয়ে কাজ করছেন।’পৌঁছাতে ১০ মিনিট লাগলো। নেমেই দেখা গেল নয়নাভিরাম এক দৃশ্য। বহু প্রাচীন এক বট গাছ। দেখলেই গা ছমছম করে। পাশেই একটা আধা ভাঙা মন্দির। এখানেই হবে শুটিং। বটগাছের ডালে ঝুলানো হয়েছে একটি দোলনা। বটগাছের পাশেই বড়ই গাছ। পাকা পাকা বরইয়ে ভর্তি। নায়ককে দেখা গেল বড়ই পাড়ায় ব্যস্ত। তাকে ঘিরে আছেন অগুনতি মানুষ। নায়ক গাছ থেকে বড়েই পেরে খেতে পারে এই ব্যাপারটা মনে হয় উৎসুক দর্শকের মাথাতেই ছিলো না। বেশ মজা করেই তারা সেই দৃশ্য উপভোগ করছিলেন। অন্যদিকে নায়িকা মাহির মেকাপ চলছে। তার সঙ্গে ছবির বিষয়ে আলাপ হলো সেখানেই। মাহি বললেন, ‘এখন গানের মধ্যে স্বপ্নের একটি দৃশ্যের শুটিং। আমি স্বপ্ন দেখে দোলনায় দুলছি। পাশে আমার প্রেমিক সাইমন।’মাহি আরও বললেন, ‘এখন পর্যন্ত অনেকগুলো ছবিতে কাজ করেছি। অনেক বড় বাজেটের ছবিতে নামি নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করেছি। কিন্ত আমি অকপটে বলতে চাই, মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের পরিচালনায় কাজ না করলে একটা আফসোস হয়তো আমার থেকেই যেত। এত গোছানো, পরিচ্ছন্ন, নিখুঁত নির্মাণের চেষ্টা আমি আর কোনো পরিচালকের মধ্যে পাইনি। মানিক ভাই এতোটাই সহযোগি আর ভদ্র মানুষ, সবসময়ই আমি প্রেসারে থাকি এই ভেবে যে আমার কোনো আচরণ বা কাজে তিনি কষ্ট পাচ্ছেন কি না। তার টিমের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কী না। আমি চিরদিন ‘জান্নাত’ ছবির শুটিংয়ের কথা মনে রাখবো। আর নায়ক হিসেবে সাইমন আমার বরাবরই পছন্দের সহযোগী। ওর সঙ্গে কাজ করতে খুব মজা পাই। আশা করছি, এই ছবির মাধ্যমে অতীতের সব সাফল্য ও জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে নতুন মাহিকে দেখবেন দর্শক।’ নায়িকা যখন নিজের নির্মিতব্য ছবি, সেই ছবির পরিচালক, নায়ক ও শুটিং ইউনিট নিয়ে এতোটা সন্তুষ্ট আর আশাবাদী থাকেন তখন ম্যাজিক্যাল কিছু একটা প্রত্যাশা করাই যায়।সেই রেশ পাওয়া গেল পরিচালকের কণ্ঠেও। তিনি বললেন, ‘সাইমনের সঙ্গে আমি আগেও কাজ করেছি। হিরো হিসেবে ও সবসময়ই পরিচালক ও শুটিং ইউনিটে খুব জনপ্রিয়। কোনো রকম ভোগান্তি নেই। নিজের কাজের প্রতি মনেযোগী এবং শ্রদ্ধাশীল। তবে মাহির সঙ্গে প্রথমবার। অনেক উৎকণ্ঠা যে ছিলো না তা নয়। ইন্ডাস্ট্রির শীর্ষ নায়িকা। কিন্তু কাজ করতে এসে দেখলাম কাজের প্রতি ও শতভাগ পেশাদার। নিজের চরিত্রটি সহজেই বুঝে নিতে পারে। অল্পতেই ধরে নিতে পারে পরিচালক কেমনটা প্রত্যাশা করছে তার কাছে। এই ছবি দিয়ে নতুন মাহির পরিচয় ঘটবে বলে আমিও প্রত্যাশী। পাশাপাশি ‘পোড়ামন’ ছবির পর আবারও জনপ্রিয়তার তালিকার শীর্ষে থাকবে সাইমন-মাহি জুটি।’তিনি জানালেন, ‘এখানে টানা ১৫ দিন আরও কাজ করবো। তারপর ঢাকায় ফিরে যাবো। এক সপ্তাহ বিশ্রাম নিয়ে আবার নতুন করে শুরু হবে জান্নাতের কাজ। দ্বিতীয় লটেই সব দৃশ্যায়ণ শেষ হয়ে যাবে। দুটি গান বাকী থাকবে। সেগুলোর শুটিং শেষ করে চলতি বছরেই ছবিটি মুক্তি দেয়ার ইচ্ছে আমার।’ডাক পড়লো শুটিংয়ের। পরিচালক ছুটে গেলেন। নায়ক-নায়িকাকে শট বুঝিয়ে দিয়ে মনিটরের সামনে বসলেন। রেকর্ডারে বেজে উঠলো গান। সাইমন-মাহিকে কোলে তোলে নিয়ে ঠোঁট মেলাচ্ছেন। চারদিকে দর্শকের মুখে লজ্জামাখা হাসি। পর্দাতে হজম হলেও, চোখের সামনে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাদের নায়কের কোলে নায়িকাকে দেখতে। একটানা দৃশ্যধারণ চললো সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। দিনের আলো কমে আসতেই ওইদিনের মতো শুটিং শেষ ঘোষণা করলেন পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মানিক। স্থানীয় মানুষদের উচ্ছ্বাসের ভিড় কাটিয়ে সন্ধ্যের আবছা অন্ধকারে সবাই যাত্রা করলেন আবাসস্থলের দিকে। মাঝখানে থেকে ছুটছে সাংবাদিকদের গাড়িও। সাংবাদিকদের সময় দিতে নায়ক সাইমন ছিলেন এই গাড়িতে। গাড়ি ছুটছে। থামতে হচ্ছে যানজটের সুবাদে। তখনই রাস্তার পাশে দাঁড়ানো মানুষ নায়ককে চিনতে পেরে চিৎকার করে উঠছেন- ‘পোড়ামনের সাইমন’। এই খ্যাতি কেমন উপভোগ করেন জানতে চাইলে সাইমন বলেন, ‘এটুকুই তো অর্জন। বেশ ভালো লাগে। তবে ‘পোড়ামনের সাইমন’ হয়েই থেকে যেতে চাই না। ‘জান্নাত’ যেন নতুন পরিচয় নিয়ে আসে।’ নায়কের জন্য আমাদেরও শুভকামনা থাকলো। খ্যাতির পর খ্যাতি আসুক তার। শুটিং হাউজে ফিরে দিনভর কাজে ডুবে থাকা একদল ক্ষুধার্ত মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মধ্য সন্ধ্যাতেই সারলাম দুপুরের খাবার। রাজকীয় কোনো আয়োজন নেই। শুটিং স্পটে যা হয়; তাই। সাদা ভাত, মাছ, মাংস, ডাল। কিন্তু ‘জান্নাত’ ছবির পরিচালক ও নায়কের অদ্ভূত আন্তরিকতার স্পর্শে অতি সাধারণ খাবারটুকুই ‘রাজভোগ’র তৃপ্তি দিলো। এখানকার আনুষ্ঠানিকতা শেষে নায়িকা মাহি ও তার স্বামী অপুর অতিথি হতে হলো। মোয়া আর চায়ের আপ্যায়নে শেষ বেলার আতিথ্য যেন ষোলকলা পূর্ণ করে গেল। তবুও ফুরায় দিন! আসে বিদায়ের পালা। সব কিছু গুছিয়ে ঢাকায় ফেরার যাত্রা। গাড়ি ছুটছে বন, বাজার পেরিয়ে। পেছনে পড়ে রইলো হরিরামপুর। পড়ে রইলো একটা দিনের অনেকটা সময় কাটানো নানা স্মৃতি ও গল্প। কেবল মনে নিয়ে ফিরলাম ‘জান্নাত’ ছবির সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোর ভালোবাসার ও মায়া। মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের পরিচালনায় সাইমন-মাহি জুটির নতুন এই ছবিটির সাফল্যের জন্য শুভকামনা; যেখানে মিশে থাকবে মানিকগঞ্জের মাটি ও মানুষের ঘ্রাণ। এলএ
Advertisement