মতামত

নারীর ক্ষমতায়ন এবং দূরারোগ্য সিরিয়াল ব্যাধি

সিরিয়াল আজকাল সংসারের মডেল হয়ে গেছে। অমুক চরিত্রের মত জামা, শাড়ি, কানের দুল, তমুক সিরিয়ালের বাড়িতে কালো রঙের বিছানা-বালিশতো রীতিমতো গৃহিনীদের মাথা খারাপ করে ফেলে। দেশে কয়েকবার নামী/বেনামী জামার জন্য আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে। তবে মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে এসব সিরিয়াল সমাজের প্রত্যেকটা স্তরে ভয়াবহ শক্তিশালী পুরুষতন্ত্রের বোমা ফাটিয়ে যাচ্ছে। যার শিকার শুধু সিরিয়ালের দর্শকরাই হচ্ছেন না, আশেপাশের সকলেই হচ্ছেন।একটা সিরিয়ালে দেখলাম, বাড়ির বউ হয়ে টেনিস খেলা যাবে না বিষয়ে শাশুড়িবিবি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। বউমাও মাথা পেতে সে আদেশ গ্রহণ করলেন। তারপর প্রতিদিন বাড়ির সকলের রান্না-বান্না, খাওয়ানো, বাসন পরিষ্কার শেষ করে বিকেলের দিকে টুক করে মাঠে গিয়ে প্র্যাকটিস করে আসেন। স্বামীদেব মায়ের কোন ইচ্ছের বিপক্ষেও যান না, বউয়ের পক্ষেও যান না। আবার মায়ের কথামতো, বউকে নিজের ঘরে রেখেও ঘুমান না! এ নিয়ে বউয়েরও কোন মাথাব্যথা নাই। তবে সারাক্ষণ ভেতরে ভেতরে কান্নাকাটি আর কষ্ট পেতে থাকেন বেচারা বউ।আরেকটা সিরিয়ালে দেখলাম স্বামীদেব অনেক বড় ডাক্তার আর বউ খুব ভাল গান গায়। একইদিন পুরুষজন ডাক্তারিশাস্ত্রে পুরষ্কার পাবেন এবং নারীজনের গানের অনুষ্ঠান। পুরুষ চান, বউ তার গানের অনুষ্ঠান ছেড়ে তার পুরষ্কার-গ্রহণের সময় তার পাশে থাকেন। বউ কী চায় তাতে তার কোন মাথা ব্যথা নেই। কথা কাটাকাটির সময় তিনি গলার রগ ফুলিয়ে বললেন ‘তুমি আমার স্ত্রী, আমার কথামতো চলা তোমার কর্তব্য। এই সংসারের কর্তা আমি। আমি বলছি, তুমি ওখানে গান গাইতে যাবে না। তুমি আমার সাথে যাবে”।বাড়ির বউ, শাশুড়ি, স্বামীসহ বাচ্চাকাচ্চা সকলেই একসঙ্গে বসে এসব সিরিয়াল দেখছেন। সবকিছু মেনে নেয়ার যে চিন্তাভাবনা তা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই চলে আসছে। এর ধ্বংস কোনদিন হয়নি, স্বরূপ বদলেছে শুধু। এসব সিরিয়াল দেখে শাশুড়িরা বউয়ের উপর কর্তৃত্ব ফলানোর নতুন নতুন পথ আবিষ্কার করছেন। বাড়ির বউরা কেউ কেউ শিখছে সর্বংসহা হয়ে সবাইকে আঁকড়ে ধরে ধরে নিজের সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে স্বামীর ঘরই মেয়েদের আসল ঠিকানা বলে সে ঘর কামড়ে পড়ে থাকতে। আর কেউ কেউ শিখছেন কিভাবে অন্যের বাচ্চার উপর অত্যাচার করতে হবে, কার বিরুদ্ধে কথা বলে তার জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলতে হবে, কে কার সাথে ফোনে কথা বলে কি সম্পর্ক স্থাপন করছে ইত্যাদি অতি নোংরা বিষয়।গণমাধ্যম, নাটক, সিরিয়াল, সিনেমা ইত্যাদি সেক্টরকে বলা হয় জাতি গঠনের মাধ্যম। তো কোন জাতি গঠনের মাধ্যম যখন নারীর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে, তাদের ঘরে থাকার সুযোগ নিয়ে, তাদের বাইরে না মেশার সুযোগ নিয়ে বছরের পর বছর এসব নোংরা বার্তা দিতে থাকে তাহলে সে মাধ্যম কী করে জাতি গঠন করবে সেটাই পরিষ্কার নয়। তৃতীয় বিশ্বে যখন নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে এত হাউকাউ হচ্ছে, নারী অধিকার নিয়ে এত এত সংগঠন আর সরকারি-বেসরকারি সংস্থা কাজ করে চলেছে তখন এসব সিরিয়াল বিষফোড়ার মতো নস্যাৎ করে দিচ্ছে সব উন্নয়নের সমূহ সম্ভাবনা। জবরজং সাজ, শাড়ি, গয়নাকে করে তুলছে নারী জীবনের প্রধান উপজীব্য। শেখানো হচ্ছে “তুমি ছেলে” আর “তুমি মেয়ে”। জাজমেন্টাল সুপিরিয়র চরিত্রের “তুমি এ বাড়ির যোগ্য নও” হুঙ্কার এখন শুধু একটা বাক্সের ভেতর বন্দী নয়, হয়ে দাঁড়িয়েছে পারিবারিক শ্লোগানও। এমনিতেই উপমহাদেশসহ কমবেশি সব দেশেই শ্রেণিবৈষম্য তো আছেই কিন্তু প্র্যাকটিসটা সম্ভবত উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোন দেশে আর এতটা প্রকট নয়। নারীরাও কে কতটা সহ্য করে, ষড়যন্ত্র মাটি করে, দেবী দূর্গা হয়ে পরিবারের রক্ষা কবচ হয়ে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারে সেরকমই একটা চাপা প্রতিযোগিতা চলে। কোন পুরুষের কখনো এসব যোগ্য-অযোগ্য অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে হয় না কেন সে প্রশ্ন অবান্তর। বেহায়া, অপয়া, অলুক্ষণে শব্দগুলোর সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহারও এসব কুরুচিপূর্ণ পুরুষতন্ত্র দ্বারাই নারীদের জন্য সুকৌশলে এঁটে দেয়া হচ্ছে। এসব সিরিয়ালে পুরুষরা থাকেন প্যাসিভ রোলে আর বাড়ির এক শ্রেণির মহিলারা থাকেন আরেক শ্রেণির মহিলাদের খোঁচানি দিতে। তারপর বটবৃক্ষের ন্যায় জাঁকিয়ে বসা পুরুষতন্ত্র গলা ভারি করে বলতে পারে “নারীরাই নারীদের প্রধান শত্রু, পুরুষরা তো নারীদের মতো অমন কূটিল আচরণ করেন না কখনো।” সাথে রইল বাচ্চারা। তারাও শিখল, কোনটা অবৈধ সম্পর্ক, কাকে জারজ সন্তান বলে, মেয়েদের কীভাবে অত্যাচার সইতে হয়, মেয়েদের কাজ কী আর ছেলেদের কাজ কী! এসব নির্মাতা আর কাহিনীকারদের জন্য প্রচলিত কোন আইনে শাস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। একটা জাতি, একটা প্রজন্মকে ভুলভাল মেসেজ দেওয়ার জন্য এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নেওয়া যাবে না হয়ত। কিন্তু আজকে কোমলমতি, আগামী দিনের প্রতিনিধিদের এভাবে ভুলপথে, নারী ও পুরুষের ভুল পরিচয়ে পরিচিত করার দায় কে নেবে?  সমান অধিকার আদায়ের যে আন্দোলন, যে বার্তা মানুষের ভেতর তরতরিয়ে বেড়ে ওঠার কথা, এসব সিরিয়ালের অকল্যাণে সেগুলো মাঠে মারা যাচ্ছে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে নারীদের পুরুষের সমান ভাবতে হবে, এসব সিরিয়াল বন্ধ করে সুস্থধারার গল্পের ইম্প্রোভাইজেশন করতে হবে। আর তা নাহলে হাজার বছরের বউ পেটানোর ঐতিহ্য আর নারী নির্যাতনের ঘটনার সাথে সাথে অসুস্থ পুরুষতন্ত্রকে মাথায় নিয়ে কয়েকধাপ এগিয়ে দেয়াই হবে। নারীর ক্ষমতায়ন আর নারীকে সমাজের চোখে শ্রদ্ধেয় প্রতিষ্ঠিত করতে আরো কয়েকশো বছর এমনি এমনি কাটাতে হবে।লেখক : সাংবাদিক। এইচআর/এমএস

Advertisement