জাতীয়

জেলা-উপজেলায় ইসলামি কেন্দ্র হবে : প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মুসলিম দেশগুলোকে রক্তাক্ত করছে। এই জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস উচ্ছেদ করে দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে তিনি ওলামা-মাশায়েখসহ ইসলামী চিন্তাবিদদের আহ্বান জানান। শেখ হাসিনা ওলামা সমাজের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনাদের কথা মানুষ শুনবে, আপনাদের কথা মানুষ মানবে। আমি আহ্বান করেছিলাম, জনগণ এ ব্যাপারে সাড়া দিয়েছেন এবং বেশকিছু কাজও করেছেন। আমি চাই এটা আরও ব্যাপকভাবে প্রচার করা।’‘আমরা চাই আপনারা যদি মানুষকে ভালোভাবে বোঝান তাহলেই আমরা এই দেশ থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ চিরতরে নির্মূল করতে পারব এবং সে বিশ্বাস আমার আছে’ বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, তার সরকার দেশের সব জেলা ও উপজেলায় ইসলামি কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে।বৃহস্পতিবার দুপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়েজিত জাতীয় ইমাম সম্মেলন ও শিশু-কিশোর সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের সনদ ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আজকের দিনে বড় একটি সমস্যা মাদকাশক্তি এবং অপরটি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ। এদের হাত থেকে আমাদের শিশুদের, যুব সমাজ তথা দেশবাসীকে রক্ষা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছেন। কিন্তু সব থেকে বড় শক্তি মানুষের শক্তি। মানুষের ভেতর যদি সচেতনতা থাকে, যদি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তাহলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দেশ থেকে চিরতরে দূর হবে।’ তিনি জঙ্গিবাদকে বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, ‘আমরা সমগ্র বিশ্বকে দেখাতে চাই বাংলাদেশই পারবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে সত্যিকার ইসলাম ধর্মের মূল মর্মবাণী মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। মানুষ যেন সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারে তা নিশ্চিত করতে। আর সেটা বাংলাদেশই করতে পারবে।’ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. বজলুল হক হারুন। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুল জলিল অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। আরও বক্তৃতা করেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক শামিম মো. আফজাল এবং ইমাম ও ওলামায়ে কেরামদের পক্ষে মাওলানা ওবায়দুল্লাহ এরশাদ।অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ২০১৫-১৬ বছরের ৬ জন শ্রেষ্ঠ ইমাম এবং ২০১৪-১৫ সালের ইসলামিক ফাউন্ডেশন আয়োজিত দেশব্যাপী শিশু-কিশোর সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার ও সনদপত্র বিতরণ করেন। অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ আলেম ও ওলামা মাশায়েখ সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।প্রধানমন্ত্রী ইমাম-ওলামায়ে কেরামদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের কাছে আমার আবেদন রয়েছে, ইসলাম শান্তির, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে এটাতো কোরআন শরিফে বলাই আছে। সুরা কাফেরুনে বলা হয়েছে, ‘লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়াদ্বিন।’ নিজের ধর্ম যেমন পালন করতে বলা হয়েছে তেমনি অন্য ধর্মের প্রতিও সম্মান দেখাতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, কিন্তু আমার খুব দুঃখ হয়, যখন দেখি এই ইসলাম ধর্মের নাম করে মানুষকে হত্যা করা হয়। নিরীহ মানুষ হত্যার পর হত্যাকারীরা বলে যে, মানুষ হত্যা করতে পারলেই নাকি তারা বেহেশতে চলে যাবে। এটা বিশ্বাস করাটাও আমি মনে করি গুনাহর কাজ, মহাপাপ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিচারদিনের মালিক। তিনি বিচার করবেন। তাহলে মানুষ হত্যাকারীরা নিজেদের হাতে আইন তুলে নিয়ে কিভাবে আল্লাহর কথা বিশ্বাস করে আর ইসলামে বিশ্বাস করে সেটাই আমার প্রশ্ন। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘যদি আরেকটু খোলামেলা বলি, মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতেই মারামারি, কাটাকাটি ও খুন-খারাপি হচ্ছে। সেখানেই অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু এই অস্ত্রটা তৈরি করে কারা। আর লাভবান হয় কারা। রণক্ষেত্র বানাচ্ছে আমাদের মুসলমানদের জায়গাগুলো, রক্ত যাচ্ছে মুসলমানদের। আর এই অস্ত্র তৈরি করে, অস্ত্র বিক্রি করে কারা লাভবান হচ্ছে। সেটাই আপনারা একটু চিন্তা করে দেখবেন।শেখ হাসিনা বলেন, আমি সব সময় এর বিরুদ্ধে কথা বলি, প্রতিবাদ করি। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, আমাদেরই কিছু লোক ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেও এসব জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ড করে বলেই আমাদের পবিত্র ধর্মটা আজকে মানুষের কাছে হেয় হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের একটাই নিয়ত দেশের মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গল করা, তাদের উন্নত জীবন দেয়া এবং তাদের জীবনের সেই চাহিদাগুলো অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেয়া। অর্থাৎ মানুষ যেন মানুষের মত জীবনযাপন করতে পারে তা নিশ্চিত করা। সেটা শহরেই হোক বা গ্রামেই হোক, তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের জীবনের চাহিদা যেন পূরণ করতে পারি মহান আল্লাহর কাছে সেই দোয়াই চাই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি নামাজের পরে সেই দোয়াই করি, আল্লাহ আমাদের হাত দিয়ে যেন কোন অন্যায় না হয়।মানুষের জন্য যেন ন্যায় করতে পারি। মানুষের ভাগ্য যেন পরিবর্তন করতে পারি। তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা-চিকিৎসার সুযোগ যেন সৃষ্টি করতে পারি।  দেশে চলমান উন্নতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে শান্তি প্রয়োজন। আর এই শান্তি রক্ষা হবে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস দমন করতে পারলে। সরকার দেশের সকল জেলা ও উপজেলায় ইসলামি কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সৌদি সরকারের সহযোগিতায় প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় মডেল মসজিদ কাম ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’প্রতিষ্ঠার কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। এই মসজিদ কমপ্লেক্সে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ভবনসহ মহিলাদের জন্য পৃথক নামায কক্ষ, মুসলিম পর্যটক ও মেহমানদের বিশ্রামাগার থাকবে। এখানে হজযাত্রীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ইসলামী লাইব্রেরি ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত থাকবে।’ আলেম ওলামাদের তত্তাবধানে একটি অর্থনৈতিক জোন করার চিন্তা-ভাবনা সরকারের রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যাতে আয় বাড়ানো যায় এজন্য শুধুমাত্র আলেম-ওলামাগণের তত্তাবধানে পরিচালিত হবে এমন একটি অর্থনৈতিক জোন তৈরি করার চিন্তা-ভাবনা চলছে।’প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে দুস্থ এবং আর্থিক দুর্দশাগ্রস্ত ইমাম-মুয়াজ্জিনদের আর্থিক সুবিধা প্রদান করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ট্রাস্টের সদস্যভুক্ত ইমামদের সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। হালাল খাদ্য ও পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে পর্যবেক্ষণ ও তত্তাবধানের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনুমোদনপ্রাপ্ত একজন করে আলেম নিয়োগদানের বিষয়টি বিবেচনায় আছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এতে আলেম ওলামাদের কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে। বিদেশে বাংলাদেশের হালাল দ্রব্যের চাহিদা এবং গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মসজিদগুলোকে ইসলামী জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২৭ হাজার ৮৩২টি মসজিদ পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে। ৩৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২১ হাজার ৫২০টি মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার ও উন্নয়ন করা হয়েছে।তিনি বলেন, তার সরকার মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্পে ১ হাজার ৫০৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৭৬ হাজার ৬৬০ জন আলেম-ওলামার কর্মসংস্থান হয়েছে। ৯৬ লাখ ১৬ হাজার শিক্ষার্থী মসজিদভিত্তিক শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪ লাখ ৫০ হাজার কুরআনুল করীম বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে এক হাজারেরও বেশি মাদরাসার একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ৮০টি মাদরাসায় অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। আমরা জাতীয় শিক্ষা নীতিতে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করেছি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম ডিজিটালে রূপান্তরিত করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি ডিজিটাল আর্কাইভ করা হয়েছে। দেশের সকল মসজিদ, মাদরাসা, খানকা ও দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের তথ্যসম্বলিত একটি ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার বায়তুল মোকাররম মসজিদে ১৭০ ফুট সুউচ্চ মিনার নির্মাণ করেছে। মসজিদটিতে ৫ হাজার ৬শ’জন মহিলার নামায আদায়ের জন্য মহিলা নামায কক্ষ সম্প্রসারণ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ’এর সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যবৃদ্ধির কাজ চলছে। চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ সম্প্রসারণ এবং আধুনিকীকরণের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।তিনি বলেন, তার সরকার বাংলাদেশে ‘দারুল আরকাম’নামে মসজিদভিত্তিক বিশেষায়িত প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতি জেলায় একটি করে আরবি ভাষা শিক্ষা কোর্স চালুর বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, একটি মানুষও যেন না খেয়ে কষ্ট না পায় সেটা নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য। একটি মানুষও গৃহহারা থাকবে না। প্রতিটি মানুষ রোগে উন্নত চিকিৎসা পাবে। প্রতিটি মানুষ উন্নত জীবন পাবে- সেই চিন্তাচেতনা থেকেই রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছি। ওআর/জেআইএম

Advertisement