একজন ছাড়া প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) চার কমিশনার তাদের পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করে বিদায় নিলেন বুধবার। গত পাঁচ বছরে এ কমিশন অনেকগুলো নির্বাচন সম্পন্ন করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দশম জাতীয় সংসদ ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, দলীয় প্রতীকে প্রথম সিটি নির্বাচন, প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচন, বিলুপ্ত ছিটমহলে ভোটার তালিকা তৈরি, উপজেলা নির্বাচন ও স্মার্টকার্ড বিতরণ কর্মসূচি। বিদায়ী নির্বাচন কমিশন বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই সম্পন্ন করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ কমিশনের অধীনে নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন। কিন্তু বিদায়ের আগে সেসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ইসি দাবি করেছে, সংকট থেকে উত্তরণে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। এছাড়া উপজেলা নির্বাচনে ভয়াবহ সহিংসতার জন্য তারা আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন।প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বে এ পর্যন্ত ১১ জন আর তাদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ছিলেন ২৩ জন। সমালোচনার ঝড়টা শুরু হয় বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই সম্পন্ন করা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে। আর দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভোটকেন্দ্রগুলোতে স্মরণকালের ভয়াবহ তাণ্ডব চলে। ভোটার থেকে শুরু করে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা এমনকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও হতাহত হন। দেশে বোমাবাজি, অগ্নিসংযোগের মতো নৃশংস তাণ্ডব শুরু হয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন নবম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বর্জন করে।প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর ৩০০টি নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ১৫৩টি এলাকায় সংসদ সদস্যরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। অপর ১৪৭টি আসনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। উত্তপ্ত ও সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে ১৪৭টি নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হয়। ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স ছিনতাই এবং বিভিন্ন সহিংস ঘটনার কারণে কিছু ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনবর্তমান কমিশনের অধীনে সারাদেশে ৪২৯৪টি ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন ও বিভিন্ন পদে ১৩৭৩টি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবারই প্রথম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ছয় ধাপে অনুষ্ঠিত এ ভোটের তফসিল ঘোষণার পর থেকে শেষ ধাপের ভোটগ্রহণ পর্যন্ত সহিংসতায় নিহত হয় শতাধিক ব্যক্তি। আহত হয় কয়েক হাজার, যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে। ইউপি নির্বাচনের ইতিহাসে ১৯৮৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে সবচেয়ে খারাপ বলে আখ্যায়িত করা হতো। ওই নির্বাচনে মারা যায় ৮০ জন ও আহত হয় পাঁচ হাজারের বেশি।সবচেয়ে প্রাণঘাতী এ নির্বাচনে নিহতের পাশাপাশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২২০ জন নির্বাচিত হওয়ারও রেকর্ড গড়েছে। এর আগে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে ১০০ জন চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। অবশ্য এসব বিষয় তুলে না ধরে সফলভাবে নির্বাচন শেষ করার বিষয়টিই রাষ্ট্রপতিকে জানাবে ইসি। দলীয় প্রতীকে প্রথম সিটি নির্বাচনের ভোটনারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো দলভিত্তিক সিটি নির্বাচনের যাত্রা শুরু করে ইসি। সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হওয়া এ নির্বাচনের মাধ্যমেই কমিশন প্রথমবারের মতো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসা পায়। এ নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে ইসির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচন বিএনপি-জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ছাড়াই গত ২৮ ডিসেম্বর তিন পার্বত্য জেলা বাদে ৬১ জেলা পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন করে ইসি। এ নির্বাচনে জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার ও জেলা নির্বাচন অফিসাররা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কোথাও কোথাও উপজেলা নির্বাচন অফিসারকেও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা করা হয়। প্রতিটি জেলায় স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের (স্থানীয় সরকারের চার ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৬০ হাজারের ওপর ভোটার) ভোটেই জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য নির্বাচিত হন। প্রতিটি জেলায় চেয়ারম্যান ছাড়া ১৫ জন সাধারণ ও ৫ জন সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নির্বাচিত হন। বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর ভোটাধিকার প্রয়োগ২০১৬ সালের আরেকটি আলোচিত বিষয় হলো ছয় দশক পর বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর ভোটাধিকার প্রয়োগ। ৩১ অক্টোবর ২২টি ছিটমহলবাসী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। গত বছর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নানা বঞ্চনার অবসান হয় ছিটবাসীদের। বাংলাদেশের ৫১টির বিনিময়ে ভূখণ্ডের মধ্যে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের বাসিন্দারা পায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। এর আগে ১০ থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ অংশে বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকার কাজ শুরু হয়। স্মার্ডকার্ড বিতরণ কার্যক্রম নাগরিকদের হাতে উন্নতমানের জাতীয় পরিচয়পত্র (স্মার্টকার্ড) তুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে গত বছর স্মার্টকার্ড যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। বছরের শেষ দিকে (২ অক্টোবর) স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩ অক্টোবর থেকে আইরিশের প্রতিচ্ছবি এবং দশ আঙুলের ছাপ নিয়ে ঢাকা এবং কুড়িগ্রামের বিলুপ্ত ছিটমহলে স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রম শুরু করে ইসি। বর্তমানে ঢাকা সিটির বিভিন্ন ওয়ার্ডে এটি বিতরণের কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে ২০১৭ সালের মধ্যে দেশের সব নাগরিকের হাতে এটি তুলে দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। উপজেলা নির্বাচনসারাদেশে ৪৮৪টি উপজেলার সাধারণ নির্বাচন এবং ১০টি উপজেলার উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। উপজেলা পরিষদ গঠনের ইতিহাসে এবারই প্রথম উপজেলা পরিষদের সংরক্ষিত আসনে মহিলা সদস্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিদায়ী ইসি সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, বিদায়ী ইসি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। অনেক বিতর্কিত কাজে জড়িয়ে পড়েছেন তারা।এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কলঙ্ক তাড়া করবে বিদায়ী ইসিকে। তবে এজন্য শুধু তাদের দায়ী করলে চলবে না। সবার সহযোগিতায় একটি প্রতিষ্ঠান ভালোভাবে কাজ করতে পারে।বিদায়ী কমিশন সেই সহযোগিতা পায়নি। এইচএস/ওআর/আরআইপি
Advertisement