বাংলাদেশে বিশেষত বাংলা ভাষায় উপন্যাস ঠিক জমছে না। বলার মতো কোনো উপন্যাসের নামও করা যাচ্ছে না ইদানিং। লেখক পরিচয়ে সফল হলেও ঔপন্যাসিক হিসেবে অত বড় নন যদিও তবু হুমায়ূন আহমেদ মরে যাওয়ার পর উপন্যাসের লেখক যেন নেই। হাসান আজিজুল হক গল্পে বেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও তার উপন্যাস জোরদার কিছু হচ্ছে না। ইমদাদুল হক মিলনও লিখছেন না বলতে গেলে। আনিসুল হক যা লিখছেন তা উপন্যাসের চেয়ে লেখাই হচ্ছে বেশি। এছাড়া চুল পেকেছে এমন কিছু লেখকের নাম হয়তো করা যায়, কিন্তু ‘পেশাদার ঔপন্যাসিকের’ অভাব বাংলাদেশে দেখা দিয়েছে। এদের চেয়ে বয়সে তরুণ, কিন্তু চেষ্টা করছেন নানাভাবে এমন কেউ কেউ আছেন। উপন্যাস নিয়ে ভাবছেন এমন কমবয়স্ক লেখকও আছেন আমাদের। তবে প্রডাকশন নেই। কেন এমনটা হচ্ছে, উপন্যাস মার খাচ্ছে কোথায়?মৃন্ময় মিজানের ‘ভাঙনের নেই পারাপার’ উপন্যাসটি পড়তে পড়তে আমার এসব কথা মনে হচ্ছিল। তার উপন্যাসের আলোচনার উছিলায় বাংলাদেশের উপন্যাসের বয়ানটা একটু সেরে নেয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছি না। প্রথমত আমার মনে হয়েছে কলেবর নিয়ে। উপন্যাসের কলেবর কেমন হতে পারে সে বিষয়ে একটা আইডিয়া এস্তেমাল করেছেন আমাদের সময়ের বুদ্ধিজীবী সলিমুল্লাহ খান। তার ভাষায়, ‘যুগের হাওয়া অনুসারে মনে হয় যে সকল আখ্যানভাগে পাত্রপাত্রী ঘটনা-দুর্ঘটনা এমনকি ছক পর্যন্ত থাকে তাহাতেও উপন্যাস হয় না। হইতে হইলে সেই আখ্যানের দৌড় ৬০,০০০ কি ৭০,০০০ হইতে ২০০,০০০ (বাংলা বলিলে দুই লক্ষ) শব্দ পর্যন্ত গড়াইতে হইবে।’ (আহমদ ছফা সঞ্জিবনী, পৃ : ১৮০)।বলাবাহুল্য এই কথা সলিমুল্লাহ খানের নিজের নহে। ইংরেজ লেখক জন অ্যান্থনি বোডেন কাডন এর। তিনি এ ডিকশনারি অব লিটারারি টার্মস এ উপন্যাসের এমন সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করেছেন। বিজাতীয় উপন্যাসগুলোর ব্যাপ্তি এত দূরই দেখা যায়। এমনকি পাওলো কোয়েলহো, হারুকি মুরাকামিদের মতো বাজার চলতি উপন্যাসও চল্লিশ অথবা এর কাছাকাছি শব্দের হয়ে থাকে। মিলান কুন্ডেরার মতটি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মনে হবে। তিনি বলেছেন, “একটা দুর্গকে কল্পনা করুন যেটি এত বড় যে একঝলক তাকে দেখা যায় না।... একটা বইয়ের সমাপ্তিতে পৌঁছে তাকে গোড়াটাও মনে রাখতে হবে। নতুবা উপন্যাস তার আকার হারিয়ে ফেলবে, তার ‘স্থাপত্যগত স্বচ্ছতা’ মেঘাচ্ছন্ন হবে। ” (অনুবাদ : সঞ্জীবন সরকার)।বাংলার প্রথম ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের শব্দ সংখ্যাও নেহায়েত কডেন এর সংজ্ঞার কাছাকাছিই আছে। কিন্তু বিপত্তি বেঁধেছে স্বাধীন বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকদের আমলে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের দুটি উপন্যাসের ব্যাপ্তিই বড়। এছাড়া নাম করা যায় এমন কেউ কেউ ঠিক মাপের উপন্যাস লিখেছেন। তবে বেশিরভাগই ‘ঈদ সংখ্যার আকারে’ উপন্যাস চালিয়ে দিয়েছেন। এতে বিপত্তি বেঁধেছে ভয়াবহ। উপন্যাসের ধারণা পাল্টে গেছে। উপন্যাস পশ্চিমা মাল। এর শারীরিক গঠন মেনে চলাই সমীচীন। একে ছেঁটে ছোট করলে বিকৃতি ঘটবে। তা-ই ঘটেছে। উপন্যাস হয়ে উঠছে না বাংলায়। এজন্য ইলিয়াস ছাড়া যাদের নাম নিয়েছিলাম শুরুতে তাদের সবার দায় আছে। নভেলা নামে একটি শাখা চালু থাকার পরও গুরুত্ব কমে যাওয়ার ভয়ে তারা আট কি দশ-বারো হাজার শব্দের কাহিনিকেও উপন্যাস বলে চালিয়ে দিচ্ছেন দিব্যি!সলিমুল্লাহ খানই খুঁজে বের করেছেন যে, ‘দক্ষিণ আমেরিকার বীর লেখক হর্হে লুইস বোর্হেস নিজের লেখাকে কদাচ উপন্যাস বলিয়াছেন। তাঁহার শব্দ ফিকচিয়োনেস (Ficciones) বা কাহিনি। চিনের মহাপুরুষ লু সুন শুদ্ধ গল্প আকারেই নিজের কাহিনি ছড়াইয়াছেন। এমনকি তাঁহার আকিয়ুর সাচ্চাহাকিনী গল্প আকারেই প্রসিদ্ধ হয়েছে।’ (ঐ, পৃ: ১৮০)। বাংলায় কী ঘটেছে তা জানাচ্ছেন ইন্ডিয়ান বাংলার দেবেশ রায়। তার মতে, বাংলাদেশে কাহিনি গদ্যের দুই আরম্ভক্ষণ ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮) এবং দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫)। তিনি লিখেছেন, ‘এই ধরনের বিবরণের অভ্যাস গড়ে উঠেছিল প্রায় চল্লিশ বছর ধরে, লেখার অভ্যাসও তৈরি হয়েছে এই সময় জুড়ে অথচ যখন সেই গদ্য-বিবরণে একটি আখ্যান বেশ সম্পূর্ণ ও বড় আকারে উপন্যাস বা গল্প হয়ে উঠতে শুরু করল হুতোম ও আলালে, তখনই বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’র (১৮৬৫) প্রথম লাইনের অশ্বারোহীর পদাঘাতে এই ধরনের গদ্য কাহিনির সেই নানা চেষ্টা অবান্তর উপকরণের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল উপন্যাসের ইতিহাসেরও প্রায় বাইরে।’ (উপন্যাস নিয়ে, পৃ:১৪)কিন্তু এই দুই গদ্যরীতির প্রধান পার্থক্যটা কী? সেটা হলো উপন্যাসে বসবাসরত চরিত্রসমূহে। কাহিনি গদ্যে টেকচাঁদ ঠাকুর কিংবা কালীপ্রসন্ন সিংহ লেখক হিসেবে রাজত্ব করেছেন। তারাই বিবরণ দিয়েছে। একটি কোনো সুনির্দিষ্ট চরিত্রের বিকাশ সেখানে দেখা যায়নি। উপন্যাসে বঙ্কিম তা করলেন। তিনি চরিত্রের বিকাশ ঘটালেন। উপন্যাসের মধ্যে চরিত্রের নিজস্ব বিকাশ সাধনের বিষয়টি এর একটি গুণ। আমাদের এখানে মূলত উপন্যাসের চরিত্র তৈরি হচ্ছে না। লেখক নানাভাবে সেখানে হাজির থাকছেন। সমাজ, রাজনীতি চাপিয়ে দিচ্ছেন চরিত্রের ঘাড়ে। নীতি-নৈতিকতায় তারা পর্যবসিত। অন্যদিকে রুশ বিপ্লব-পরবর্তী সমাজ বদলের সাহিত্যও আছর করেছে আমাদের এদিকে। ফলে দুই দিক থেকেই বিচ্ছেদ ঘটেছে। দেবেশের মতে, আলাল ও হুতোম ঘরানা থেকে শতাধিক বছর আগে, আর আমার মতে, বঙ্কিমের ইংরেজদের কাছ থেকে ধার করা উপন্যাসের ধরন থেকে এ বাংলায় বিচ্ছেদ ঘটেছে দুই বা তিন দশক আগে।কাকে বলব উপন্যাস, এ বিষয়টিই এখানে পরিষ্কার নয়। মিনাল কুন্ডেরা একবার বলেছিলেন, ‘উপন্যাস লেখকের স্বীকারোক্তি নয়; বরং তা ফাঁদে পরিণত হওয়া পৃথিবীতে মানুষের জীবনের এক অনুসন্ধান।’ ফাঁদ মানে এখানে জীবনযাপন। স্থানীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে টিকে থাকা। আর সেই টিকে থাকা জীবনকে সার্চ করা উপন্যাসের কাজ। এটা বেটার ভাষ্য উপন্যাসকে বুঝবার ক্ষেত্রে। উপন্যাসে বহুস্বরের কথা বলেছেন মিখাইল বাখতিন। এই বহুস্বর বিষয়টি হলো উপন্যাসের মধ্যে অনেক কিছু থাকা। সেটা শুধু চরিত্রেরই থাকা নয়। অনেক গল্প, ইতিহাস, ঘটনা, বিবরণ থাকা। আমাদের সময়ে এনজিও প্রকল্পের আওতায় অনেক উপন্যাস লেখা হয়েছে। এই মনোভঙ্গি থেকে অনেকে উপন্যাস লিখেছেন। ‘অপর’ জাতিগোষ্ঠীর জীবন, বিশ্বাস এসবের প্রতি লেখকদের দরদের বেশি উপন্যাস হয় উঠতে পারেনি সেসব। উপন্যাস উত্তম হয় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে। দূর সম্পর্ক থেকে উপন্যাস সাংবাদিকতায় পর্যবসিত হয়। বাংলাদেশে সমাজ, সংসার, রাজনীতি, নৈতিকতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা- ইত্যকার বিষয়াদি আগে থেকেই উপন্যাসকে লিখিয়ে নিচ্ছে। লেখক এবং উপন্যাসের বাইরে এসব শর্ত উপন্যাসের নিয়ামক হয়ে উঠছে। ফলে উপন্যাসের মান হচ্ছে খারাপ।মৃন্ময় মিজানের লেখা ‘ভাঙনের নেই পারাপার’ উপন্যাসটির বিষয়ে এবারে আলাপ করা যাক। এতক্ষণ ভালো উপন্যাসের স্বভাব বিষয়ে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করলাম। এবার সেই ছাঁচে ভাঙনের নেই পারপারকে ফেলে একে বিচার করা যেতে পারে। এই ‘উপন্যাসের’ শুরু একটি বাস দুর্ঘটনা দিয়ে। লেখক তার উপন্যাসে কিছু ‘সাব হেড’ অথবা পরিচ্ছেদ আলাদা আলাদা করেছেন। শুরুর পরিচ্ছেদের নাম ‘পারলৌকিক বাসযাত্রা’। এখানে ‘আমি’ মূল চরিত্র। সে জানাচ্ছে- ‘ব্রিজের রেলিং ভেঙে বাসটা নদীতে পড়তে শুরু করলে পরিচিত রাস্তায় অপরিচিত দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আমার আত্মা।’ এই আমিটা কে তা উপন্যাস ভেঙে ভেঙে খুঁজে বের করাটা মুশকিলের করে রেখেছেন লেখক।এক রৈখিক কাহিনির বিবরণ তিনি দেননি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চরিত্র, ঘটনা ও সময়ের বিবরণ দিয়েছেন। উপন্যাসের শুরুটাই যেন কাহিনির শেষ। আবার শেষে গিয়ে যে শুরুর দেখা পাওয়া যাবে তা না। তিনি একটা ইল্যুশন তৈরি করেছেন। এক দৃশ্য অন্য দৃশ্যের সঙ্গে গুলিয়ে যাচ্ছে। একে অন্যের সঙ্গে প্রোথিত হয়ে যাচ্ছে। সবাই একই ঘটনা, যন্ত্রণা অথবা তাড়নায় আবদ্ধ যেন। কে যে কে তা ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। একটি ঘটনার কথা লিখতে গিয় লেখক ফিরে যাচ্ছেন অন্য কোনো ঘটনার কাছে। সেখান থেকে আগের জায়গায় ওই পথেই ফিরে আসছেন না। অন্য কোথাও চলে যাচ্ছেন। অন্য পথে আগের জায়গায় ফিরছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এত ঘনঘটায়ও লেখকের পথভুল হয়নি। তিন ঠিক ঠিক যে ঘটনা থেকে চলে গিয়েছিলেন তার কাছে আবার ফিরে এসেছেন। এই সক্ষমতা মৃন্ময় মিজানের রয়েছে।আরো একটি বিষয়ে তিনি বেশ সজাগ। আর তা হলো রাজনীতি। ফিরে ফিরেই তিনি আসছেন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে। যেমন- তাত্ত্বিকরা বলত, বাংলাদেশ গোয়েন্দাদের স্বর্গভূমি। র, সিআইএ, মোসাদ, এমআইসিক্স, কেজিবি, আইএসআই, এমএসএস- সবার হট লিস্টে বাংলাদেশ। মধ্যপ্রাচ্য যেমন যেমন বিশ্বের নাভি, এশিয়ার নাভি বাংলাদেশ।” (পৃ : ১১) ভূ-রাজনৈতিকভাবে দেশকে চিনতে পারা গুরুতর রাজনীতি বিচারই হলো। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান আর সেখানে গ্রাম থেকে উঠে আসা, পরিবার-পরিজনহীন, পরিস্থিতির ক্রমাগত শিকার একটি চরিত্রকে মৃন্ময় গেথে দেন।বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট এবং কোথায় এর সমাধান তাও তিনি এক ঝটকায় বলে ফেলেছেন, বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই গল্পের শিক্ষণীয় দিক কী?’ ও চুপ করে থাকায় বললাম, ‘সমস্যার মূল জায়গায় চিকিৎসা না করে আশপাশে চিকিৎসা করে লাভ নেই, মূল সমস্যা জিইয়ে রাখলে তা একদিন সবকিছুই খেয়ে ফেলবে।’ সে বলল, ‘তোর মতে বাংলাদেশের মূল সমস্যা কোথায়?’ বললাম, ‘রাজনৈতিক নেতৃত্বে।’ প্রশ্ন রাখলো, ‘নেতৃত্ব গড়ে ওঠে কীভাবে?’ বললাম, ‘টাকাই নেতৃত্ব তৈরি করে এখন।’ ‘টাকা আসে কীভাবে?’ ‘অবৈধ পথে।’ ‘অবৈধ পথ নিয়ন্ত্রণ করে কারা?’ ‘রাজনৈতিক নেতৃত্ব।’ (পৃ: ৪৯)তার উপন্যাসে কাহিনি নয়, বিভিন্ন ঘটনার অবিন্যস্ত বিবরণ গাঁথা আছে। উপন্যাসে কাহিনি থাকতে হবে। এটা আবশ্যক। কাহিনি ছাড়া শুধু বিবরণকে উপন্যাস বলা যাচ্ছে না। কারণ এখানে ‘গল্প’ হলো প্রাণ। একটা মূল গল্প শুরু থেকে নাও থাকতে পারে। তবে বিভিন্ন গল্প আগাতে আগাতে এক জায়গায় এসে মিলবে। আমাদের এখানে যেহেতু উপন্যাসের চর্চা কম ফলে অভিজ্ঞতায় এসব নেই। কিন্তু ইউরোপে আছে। এক উপন্যাসে একাধিক গল্প থাকতে পারে। তবে তারা আবার মিলেও যাচ্ছে। কিংবা প্যারালাল গল্পের মধ্যেও থাকতে হবে সাদৃশ্য বা ঐক্য। মৃন্ময় মিজানের উপন্যাসে কাহিনি নেই বলা যাবে না। তবে এত বিশৃঙ্খলা যে কাহিনির সুতা বারে বারে হারিয়ে যাচ্ছে বিবরণের কাছে, রাজনৈতিক বক্তব্যের কাছে এমনকি কখনো কাব্যের কাছে।বাংলাদেশে উপন্যাস জমে না ওঠার একটা কারণ লেখকদের কবিতা করার দোষ। উপন্যাস গদ্যমূলক তাতে কাব্য থাকতে পারে। কিন্তু কবিতা হয়ে ওঠার চিন্তা উপন্যাসকে বেপথু করে। মৃন্ময় মিজান এই দোষে দুষ্ট। তিনি প্রচুর কাব্য করেছেন। বারে বারে ম্যাজিক রিয়ালিজমে হারিয়ে গেছেন। ‘একগুচ্ছ উঠানগঙ্গা ফুল হাতে বসে আছে মধ্যবয়সী নারী। ফুল থেকে ওঠা ধোঁয়ায় গত রাতের ঘ্রাণ। ঘ্রাণে লেগে আছে ইরানি খুশবু অথবা ফরাসি সেন্টের মখমলি কারুকাজ। ধোঁয়ার রং প্রজাপতি রঙিন। আমাদের চোখ ধোঁয়ার শরীরে লাখ লাখ প্রজাপতির বায়বীয় প্রকাশে বিস্ময়ে নির্বাক।’ (পৃ: ৫৪) অথবা আরো আছে এমন, ‘ততক্ষণে তরুণী আকাশে ভাসতে শুরু করেছে। সহকর্মী জানায়, ভাসাভাসির কাজটা নারী এবং তরুণী সংস্করণের অনেক পুরোনো অভ্যাস।’বাংলাদেশের স্থানীয় মিথ, ধর্মীয় বয়ান, বাস্তবতার বিজ্ঞান, জাদুবাস্তবতা, মায়া বিভ্রম অনেক কিছুকে লেখক জড়ো করেছেন। জড়িয়ে ফেলেছেন বললে আরো ভালো শোনায়। তবে তার মুন্সিয়ানা এখানে যে পড়তে পড়তে অযথা মনে হবে না কিছু। মনে হবে না ফেলনা। যেমন আছে- ‘আমাদের জগৎই পৃথিবীর একমাত্র বাস্তবতা নয়। আলমে আরওয়াহ, আলমে বরজাখ, জান্নাত, জাহান্নাম, স্বপ্ন, কল্পনা, স্মৃতি, জিন, জগৎ, ফেরেশতা জগৎ ইত্যাদির মতো শতাধিক বাস্তবতা বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যেই আবিষ্কার করেছেন।’ (পৃ : ৫৫)তার উপন্যাসটি মনোজাগতিক। মাথার ভেতর কল্পনার মধ্যেই বিচরণ করেছে সারাক্ষণ। ফলে সারাউন্ডিংস নেই। ডিটেইলিং নেই। অস্থির ও মতিগ্রস্ত একদল মন যেন ছুটে বেড়াচেছ, হাতড়ে বেড়াচ্ছে। তাদের মাটিতে পা পড়ছে না। অথচ মাটির রোষের শিকার তারা।যে ‘আমি’র কথা শুরুতে বলা হয়েছে সে বাংলাদেশেরই গ্রাম এবং মফস্বল এলাকা থেকে শহরে এসেছে। প্রেম ও প্রতারণায় বড় হয়েছে। রাজনৈতিক সংঘাতে নিঃস্ব হয়েছে। দিশা খুঁজেছে। তাকে জ্বিনে পেয়েছে, যার কারণে সমাজ তাকে মাদরাসায় ভর্তি করেছে। তাকে নারীর প্রেমে পেয়েছে যার কারণে সমাজ তাকে তাড়িয়েছে। এমন অনেক ঘটনা, পরিকল্পনা বাস্তবতায় পর্যুদস্ত আমির কাহিনিগদ্য ‘ভাঙনের নেই পারাপার’। লেখকের অনেক দার্শনিক চমৎকারিত্ব আছে। আমাদের ভূখণ্ডের মিথ ও পুরাণের প্রতি দরদ আছে। ধর্মীয় তত্ত্ব ও তথ্যের দখল আছে। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী শানানো। তার লেখার শক্তি রয়েছে। লেখাকে গুছিয়ে উপস্থাপনের তাকত আছে। পূর্ববঙ্গের ভাষা, রুচি ও মনন তার জানা আছে। তবে উপন্যাস হয়ে উঠবার রাস্তাটায় তিনি বিগড়ে গিয়েছেন তা বলতে হয়। তার উপনাসটিতে চরিত্র খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। অনেকটা কাহিনিগদ্য রীতিতে তা লেখা। বিবরণমূলক। লেখক নানা রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে মূর্ত করতে চেয়েছেন। স্বগোতক্তিতে ভরপুর।উপন্যাসের পূর্ববঙ্গীয়করণ ঘটাতে হবে আসলে ইউরোপীয় অবয়বের ভিতরেই। অর্থাৎ উপন্যাসের শরীরটা থাকবে পশ্চিমা, প্রাণ, ভাষা, স্ফূর্তি থাকবে পূবের, সেই ক্ষমতা মৃন্ময় মিজানের রয়েছে। তাকে তা প্রমাণ করতে হবে। ভাঙনের নেই পারাপার অনেক বেশি এক্সপেরিমেন্টাল। এক্সপেরিমেন্ট এর চিন্তা উপন্যাসের গতিপথকে বিভ্রান্ত করে থাকে। উপন্যাস তখন কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। সহজ, সুন্দর ও নির্ভেজাল উপায়ে মৃন্ময় মিজান আমাদের একটি পূর্ববঙ্গীয় উপন্যাস উপহার দেবেন পরবর্তীতে, সেই প্রত্যাশায় রইলাম।লেখক : ফিকশন রাইটার , সমালোচকএসএইচএস/আরআইপি
Advertisement