ব্যবস্থাপনা খাতে আইন লঙ্ঘন করে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে জীবন বীমা কোম্পানিগুলো। বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কড়াকড়ি এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তের উদ্যোগ নেয়ার পরও এ অবৈধ ব্যয় বন্ধ হচ্ছে না।২০১৬ সালে দেশে ব্যবসা করা ৩২টি জীবন বীমা কোম্পানির মধ্যে মাত্র ৭টির ব্যয় আইনি সীমার মধ্যে রয়েছে। নতুন ব্যবসা শুরু করা এলআইসি বাংলাদেশের কার্যক্রম এক বছর পূর্ণ না হওয়ায় কোম্পানিটির ব্যয় সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। বাকি ২৪টি কোম্পানি ব্যবস্থাপনা খাতে আইন লঙ্ঘন করে ২৪১ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে।তবে ব্যবস্থাপনা খাতে কোম্পানিগুলোর অবৈধ ব্যয়ের পরিমাণ ২০১৬ সালে আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কম হয়েছে। ২০১৫ সালে মাত্র তিনটি কোম্পানির ব্যয় আইনি সীমার মধ্যে ছিল। বাকি ২৮টি কোম্পানি আইনি সীমা থেকে ৩০৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করে। অর্থাৎ ২০১৬ সালে আগের বছরের তুলনায় ব্যবস্থাপনা খাতে অবৈধ ব্যয় কমেছে ৬৪ কোটি টাকা।কোম্পানিগুলোর এমন বেপরোয়া অবৈধ ব্যয়ের কারণে পলিসিহোল্ডার ও শেয়ারহোল্ডাররা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কারণ, আইনি সীমার অতিরিক্ত যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তার ৯০ শতাংশই প্রতিষ্ঠানের পলিসিহোল্ডারদের প্রাপ্য। বাকি ১০ শতাংশের ভাগিদার শেয়ারহোল্ডাররা।জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে পলিসিহোল্ডার এবং শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গত বছর সব কোম্পানিকে শুনানিতে ডাকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। শুনানিতে ভবিষ্যতে ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করা হলে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে কোম্পানিগুলোকে হুঁশিয়ার করা হয়। সেই সঙ্গে অতীতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়েছে তা ক্রমান্বয়ে সমন্বয় করতে নির্দেশ দেয়া হয়।বছরটিতে আইডিআরএ’র তৈরি প্রতিবেদনে উঠে আসে ১৭টি জীবন বীমা কোম্পানি ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা খাতে ১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত খরচ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে করা অতিরিক্ত ব্যয়ের পিছনে কী ধরনের দুর্নীতি হয়েছে তা খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের জুনে দুদকের উপ-পরিচালক মো. জালাল উদ্দিনের নেতৃত্বে দুই সদস্যের অনুসন্ধানী টিম গঠন করা হয়। টিমের অপর সদস্য হলেন সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন। এখনো দুদকের অনুসন্ধান চলমান।দুদক ও আইডিআরএ’র এমন উদ্যোগের পরও ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরেনি কোম্পানিগুলো। অতীতের অতিরিক্ত ব্যয় সমন্বয় করা তো দূরের কথা, ২০১৬ সালে ব্যয়ের লাগাম নির্ধারিত সীমায়ও ধরে রাখতে পারেনি ২৪টি কোম্পানি।তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬ সালে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মধ্যে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করার শীর্ষে রয়েছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ। প্রতিষ্ঠানটি আইন লঙ্ঘন করে ৪৫ কোটি ৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। ২০১৫ সালেও ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয়ের ক্ষেত্রে এই কোম্পানিটি শীর্ষে ছিল। ওই বছর আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যয় করা হয় ৫৯ কোটি ১০ লাখ টাকা।মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মালিকানাধীন এ প্রতিষ্ঠানটি আইনি সীমার অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ১৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ২০১৫ সালে এ ব্যয় ছিল ২৯ কোটি ৩ লাখ টাকা।এরপরই রয়েছে সানফ্লাওয়ার লাইফ। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালে আইনি সীমার অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ১৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা। ২০১৫ সালে এ ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ১৯ কোটি ৬ লাখ টাকা।ব্যবস্থাপনা খাতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের বিষয়ে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. হেমায়েত উল্লাহ ও সানলাইফের সিইও মো. সোলাইমান হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি মোবাইলে মেসেস দিয়েও এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।এ দুই কোম্পানি ছাড়াও ২০১৬ সালে প্রগ্রেসিভ লাইফ ১২ কোটি ৫২ লাখ, গোল্ডেন লাইফ ১০ কোটি ৯৬ লাখ, সন্ধানী লাইফ ৮ কোটি ৬৬ লাখ, পদ্মা ইসলামী লাইফ ৮ কোটি ৪৩ লাখ, পপুলার লাইফ ৩ কোটি ৯১ লাখ, মেঘনা লাইফ ২ কোটি ৭৪ লাখ, হোমল্যান্ড লাইফ ৪ কোটি ৩২ লাখ, বায়রা লাইফ ৫ কোটি ৩ লাখ টাকা আইনি সীমার অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। নতুন অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে ট্রাস্ট লাইফ ৫ কোটি ৯ লাখ টাকা, সোনালী লাইফ ৪ কোটি ৯৪ লাখ, জেনিথ লাইফ ৫ কোটি ১৯ লাখ, বেস্ট লাইফ ৪ কোটি ৫২ লাখ, যমুনা লাইফ ২ কোটি ৯৩ লাখ, মার্কেন্টাইল লাইফ ২ কোটি ৮০ লাখ, প্রটেকটিভ লাইফ ৫ কোটি ৪৫ লাখ, চার্টার্ড লাইফ ২ কোটি ৯৮ লাখ, ডায়মন্ড লাইফ ১ কোট ৩৯ লাখ, আলফা লাইফ ২ কোটি ১৪ লাখ, এনআরবি গ্লোবাল ২ কোটি ৫০ লাখ এবং স্বদেশ লাইফ ২ কোটি ২০ লাখ টাকা আইনি সীমার অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। আর একমাত্র সরকারি জীবন বীমা প্রতিষ্ঠান জীবন বীমা কর্পোরেশন আইনি সীমা লঙ্ঘন করে ২০১৬ সালে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ৬৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। এই প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালে ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করে ৪২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।অন্যদিকে ব্যয় নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে- মেটলাইফ, ন্যাশনাল লাইফ, ডেল্টা লাইফ, প্রাইম ইসলামী লাইফ, রূপালী লাইফ, প্রগতী লাইফ এবং নতুন ব্যবসা শুরু করা গার্ডিয়ান লাইফ।আইডিআরএ সদস্য ও মুখপাত্র জুবের আহমেদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করলে পলিসিহোল্ডার ও শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতিরিক্ত ব্যয় করা কোম্পানিগুলোকে গত বছর শুনানিতে ডেকে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে পরবর্তী বছরে অতিরিক্ত ব্যয় সমন্বয় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এরপরও এবার যেসব কোম্পানি ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে তাদের শুনানিতে ডাকা হবে এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ১৯৫৮ সালের আইন দিয়ে এখনো ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ করা হচ্ছে। বর্তমানে সব ধরনের খরচ বাড়লেও এ আইন আর পরিবর্তন করা হয়নি। এতো পুরনো আইনের শর্ত মেনে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আর আইডিআরএ অতীতের ব্যয় সমন্বয়ের যে নির্দেশ দিয়েছে তার কোনো ভিত্তি নেই। আইডিআরএ এমন নির্দেশ দিতে পারে না। আইডিআরএ’র উচিত আগে আইন সংশোধন করা, এরপর ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেশি হলো না কম হলো তা খতিয়ে দেখা।সন্ধানী লাইফের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং বিআইএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট আহসানুল ইসলাম টিটু জাগো নিউজকে বলেন, জীবন বীমা কোম্পানিগুলো ব্যয়ের প্রধান খাত হলো কমিশন। প্রথম বর্ষ ব্যবসার প্রায় ৫০ শতাংশই কমিশনে চলে যায়। কমিশনের পর ডেভেলপমেন্টে পুরনো কোম্পানির ২০ শতাংশ এবং নতুন কোম্পানির প্রায় ৩৫ শতাংশ খরচ হয়। প্রধান কার্যালয়ের বেতন খাতে খরচ হয় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় হয় আরও ১০ শতাংশ। বিনোদন ও চাঁদার পিছনে যায় ১০ শতাংশ।তিনি বলেন, এ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ভাগ করে লিমিট (সীমা বেঁধে দেয়া) করে দিতে হবে। প্রথমে লিমিট করতে হবে কমিশনের বিষয়টি। আইডিআরএ বীমা কোম্পানির সাংগঠনিক কাঠামো পাঁচ টায়ারে নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং প্রথম তিন টায়ারের কমিশনও নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু পরবর্তী টায়ারগুলোতে কি হারে কমিশন দেয়া হবে তা নির্ধারণ করা হয়নি।আহসানুল ইসলাম টিটু আরো বলেন, ‘আইডিআরএ যদি এ কমিশন হার নির্ধারণ করতো তাহলে অটোমেটিক ব্যয় ১০ শতাংশ কমে যেত। তাহলে দায়টা কার? আইডিআরএ কেন এ কমিশন হার নির্ধারণ করে দিচ্ছে না? আমি মনে করি, কমিশন, বাড়িভাড়া ও প্রধান কার্যালয়ের খরচ যদি নিয়মের মধ্যে বেঁধে দেয়া যায় তাহলে খরচ আইনি সীমার মধ্যে রাখা সম্ভব।’ জীবন বীমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ করা হয় ১৯৫৮ সালের বীমা বিধির ৩৯ ধারা অনুযায়ী। এ ধারা অনুযায়ী বীমা ব্যবসার অনুমতি পাওয়ার পর একটি কোম্পানি তিন বছর পর্যন্ত প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের সাড়ে ৯৭ শতাংশ এবং নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের সাড়ে ২২ শতাংশ পর্যন্ত খরচ করতে পারে; যা চার থেকে ছয় বছর পর্যন্ত সাড়ে ৯৬ ও ২০ শতাংশ এবং সাত বছর থেকে ১০ বছর পর্যন্ত ৯৫ ও ১৯ শতাংশ। আর ব্যবসায়িক কার্যক্রম ১০ বছর অতিক্রম করলে ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ৯০ শতাংশ এবং নবায়নের ১৯ শতাংশ।তবে কোনো কোম্পানির প্রিমিয়াম আয় ১০ কোটি বা তার বেশি হলে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ৯০ শতাংশ এবং নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ১৫ শতাংশের বেশি খরচ করতে পারবে না।এমএএস/এনএফ/এমএস
Advertisement