বিশেষ প্রতিবেদন

নন্দীপাড়া খালে দুই শতাধিক অবৈধ স্থাপনা

দখল আর দূষণে হারিয়ে যাচ্ছে রাজধানীর খালগুলো। প্রবাহমান শতাধিক খালের মধ্য থেকে এখন এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬টিতে। দখলদারদের কবল থেকে খালগুলো রক্ষা করতে একাধিক উদ্যোগ নেয়া হলেও সুফল আসেনি। ভূমিদস্যুদের বলয়গ্রাসে বিলীন হতে চলেছে নগরীর পানি নিষ্কাশনের এ মাধ্যমগুলো। ফলে বাড়ছে জলাবদ্ধতা। নেমে যাচ্ছে ভূপৃষ্ঠের পানির স্তর। নগরীর খালগুলো নিয়ে জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক শাহেদ শফিকের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।ঝর্ণা বেগম। নন্দীপাড়া খালের পাড়েই কাটিয়েছেন জীবনের ৩৮টি বছর। খালটি ঘিরে তার অনেক স্মৃতি। শৈশবে দুরন্ত সাঁতার, গরু-ছাগলের পাল নিয়ে বেড়ানো, মাছ ধরাসহ কতো কিছু। খালটির হারিয়ে যাওয়া যৌবন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন তিনি। ৫৭ বছর বয়সে এখনও সেসব যেন চোখের সামনেই অকপটে ভেসে ওঠে। কী থেকে কী হয়েছে তাও জানা ঝর্ণা বেগমের।রাজধানীর নন্দীপাড়ার এ খালটি এক সময় খুব খরস্রোতা ছিল। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর এক বছর আগে নন্দীপাড়া খালের উপর দিয়ে সাঁকো পার হতে গিয়ে খালে পড়ে যায় তার চার বছরের নাতনি সুমা আক্তার। প্রবল স্রোতে ভেসে ৫০০ গজ দূরে গিয়ে মাছ ধরার একটি জালে আটকা পড়ে সে। জালের কারণে সেদিন তার নাতনি প্রাণে রক্ষা পায়। সুমা আক্তার এখন দুই মেয়ের জননী।অথচ সেই খালে এখন পানি নেই। নেই আগের মতো প্রবাহ। দখল আর দূষণে হারিয়ে যেতে বসেছে পূর্ব ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এ খালটি। জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের কাছে সেসব স্মৃতি বর্ণনার মাধ্যমে নন্দীপাড়া খালের যৌবনের স্মৃতিচারণ করেন এই বৃদ্ধা।শুধু ঝর্ণা বেগম নন, খালটি নিয়ে তার সমবয়সীদের রয়েছে অনেক স্মৃতি। স্থানীয়রা জানান, ধোলাই খাল থেকে ইংরেজি ওয়াই বর্ণের মতো লালবাগ থেকে পূর্ণ দিকে গেন্ডারিয়া এবং লোহারপুলে উৎপত্তি হয়ে সবুজবাগ ও খিলগাঁও হয়ে রামপুরা খালে মিলিত হয়েছে। বিশাল অংশজুড়ে এর দৈর্ঘ্য হলেও বর্তমানে এর প্রস্থ ৩০ ফুটের কম।২০০৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ২০০৫ সালের ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত খালটির সীমানা নির্ধারণ করা হয়। এরপর ওই বছরের ৪ থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত চলে খালের অবৈধ উচ্ছেদ। ওই সময় খালটির সর্বশেষ অবস্থা চিহ্নিত করে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করলেও পরবর্তীতে আবার বেদখল হতে থাকে।এই নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী খালটি দিয়েই এক সময় নৌকাযোগে ঢাকার পূর্বদিক থেকে আম-কাঁঠাল, শাক-শবজিসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী আনা নেয়া হতো। আর বর্ষায় ঢাকার পানি এ খাল দিয়েই নিষ্কাশন হতো। রামপুরা হয়ে বালুর মাঠের দিকে এগিয়ে যাওয়া নড়াই নদীতে মিলে এ খাল গুদারাঘাটের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু সেই ঘাটের ওপর দিয়ে এখন বয়ে গেছে বড় রাস্তা। তুরাগ আর বালু নদীর সংযোগ হিসেবে এখন আর নেই নড়াই। রামপুরা ব্রিজ থেকে বালু নদীর দক্ষিণ পাড় পর্যন্ত ছোট ছোট নৌকা এখনও চলে ঠিক, কিন্তু পণ্যবাহী বড় নৌকার দেখা মেলে না।নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী (জিরানী) খালটি মতিঝিল সার্কেলের ধলপুর খাল হতে উৎপত্তি হয়ে মান্ডা, রাজারবাগ ও নন্দীপাড়া মৌজার ভেতর দিয়ে নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী সড়কের পাশ দিয়ে নাসিরাবাদ মৌজার নাসিরাবাদ-নন্দীপড়া খালের সঙ্গে ত্রিমোহনী নামক স্থানে মিলিত হয়েছে।ঢাকা জেলা প্রশাসনের ডেমরা সার্কেলাধীন এ খালটি নিয়ে জরিপ করেছে জেলা প্রশাসন। এতে দেখা গেছে, খালের ওপর দিয়েই সরু কালভার্ট নির্মাণ করে রাস্তার সংযোগ করা হয়েছে। বাসাবাড়িতে গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করতে খালের ওপর দিয়ে পানির পাইক ও গ্যাসের পাইপের সংযোগ দেয়া হয়েছে। আশপাশের বাসাবাড়ির স্যুয়ারেজ লাইনগুলো সরাসরি খালের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে।পুরো খালের উত্তর পাশের সড়কজুড়ে দুই শতাধিক অবৈধ দোকান গড়ে উঠেছে। এসব দোকান ও বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা জমে পানির স্বাভাবিক গতি বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া খালের উত্তর পাশের বাসিন্দাদের চলাচলের জন্য আরসিসি, স্টিল, কাঠ ও বাঁশের ৩৫টি ব্রিজ এবং সাঁকো নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ব্রিজ ও সাঁকোর পিলারের সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা জমে খালের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে।অবৈধভাবে গড়ে তোলা দোকানপাটের মধ্যে রয়েছে জেলা পরিষদ মসজিদ কমিটির ব্যানারে ২৬টি, ৩৯টি চা, ১৪টি সবজি, ১৫টি রিকশা গ্যারেজ, ১৭টি মুদি, ৪টি হোটেল, ৭টি ফল, ৫টি মোবাইল, ৫টি পান, ৪টি মোরগ, ৩টি মাংস, ৩টি ফার্নিচার, ৩টি চাল, ১টি টেইলার, ১টি দলিল লেখক, ১টি লাইব্রেরি ও ১টি রুটির দোকান রয়েছে।ঐতিহ্যবাহী এ খাল পাড়ে শুধু দোকান নয়, রয়েছে বহুতল তিনটি ভবনও। এসব অবৈধ স্থাপনার কারণে কোথাও তিল পরিমাণ মাটিও খালি নেই। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, নন্দীপাড়ার এ খালটি দখল করেছে খোদ জেলা প্রশাসনও। প্রতিষ্ঠানটি খাল ও পাশের রাস্তার বিশাল অংশজুড়ে জেলা পরিষদ মার্কেট নির্মাণ করেছে। যে কারণে পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়ে খালটি দিন দিন ভরাট হচ্ছে। অন্যদিকে মার্কেটের মসজিদ কমিটির নামে নির্মাণ করা হয়েছে আরও ২৬টি দোকান।এক সময়ের প্রবাহমান এ খালটির ওপর স্থানীয়দের কয়েকটি সরু কালভার্ট (বাড়ির দরজা) নির্মাণের পাশাপাশি সরকারি দুটি ব্রিজও নির্মাণ করা হয়েছে। নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনীর সু-উচ্চ ব্রিজটিই প্রমাণ করে এ খালটি কতো বড় কিংবা প্রবাহমান ছিল। অথচ এ খালের এখন সব অংশ দখল করে বাড়িঘর ও দোকানপাটের পাশাপাশি ব্রিজের নিচ দিয়ে তৈরি হয়েছে একটি পাকা রাস্তাও।স্থানীয় বাসিন্দা রাজমিস্ত্রি সিরাজুল ইসলামের স্মৃতিতে খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয়, বড় জোর ১০ বছর আগেও তার দাঁড়িয়ে থাকা স্থানটিতে ছিল গভীর পানি। বড় বড় নৌকা ও জাহাজ সেই স্থানটি দিয়েই চলতো। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘চোখের সামনে এখনও সব ভাসছে। কয় বছর আগেও মাঝিরা নৌকা নিয়ে মালামাল আনতেন। বুড়িগঙ্গা ও বালু নদী থেকে নৌকা ও জাহাজ আসতো এ খাল দিয়ে। এখন সব বেদখল। ব্রিজের নিচে রাস্তা! দেখতেও অবাক লাগে।’ তিনি আশা করেন, সরকার দ্রুত খালের হারানো যৌবন ফিরিয়ে আনবে।খালপাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা সারি সারি স্থাপনা, দোকানপাট, আবাসিক ভবনের ময়লা-আবর্জনা এমনকি টয়লেট বর্জ্যের ঠিকানাও এ খাল। ওয়াসার লাইনও এসে মিলেছে এই খালে। যে যার মতো বর্জ্য ফেলায় ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে এ খালটি। আবর্জনার দুর্গন্ধে হাঁটাও দায়।এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, এক সময় ঢাকা শহরে ৬৫টি খাল ছিল। এগুলো দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে স্যুয়ারেজ হতো। এখন খাল আছে ২৬টি। এগুলো নিয়ে ওয়াসা কাজ করে। শিগগিরই খালগুলো উদ্ধারে কাজ শুরু করা হবে।ঢাকা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, আমরা খালটির অবৈধ দখলদারদের তালিকা করেছি। তাদের বলে দেয়া হয়েছে তারা যাতে স্থাপনাগুলো নিজ দায়িত্বে সরিয়ে নেয়। না হলে উচ্ছেদ করা হবে।গত ২২ জানুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাইদ খোকন রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল, বক্স কালভার্ট ও রাস্তা অবৈধ দখলমুক্ত করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় ৬ এবং ৯ ফেব্রুয়ারি নন্দীপাড়া-ত্রিমোহিনী খাল ও হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।এ বিষয়ে ডিএসসিসি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকার জলাবদ্ধতার জন্য অন্যতম কারণ খাল বেদখল। আমরা খাল উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দখলদাররা যেই হোক বা যত বড় ক্ষমতাধর হোক উচ্ছেদ করা হবেই।এমএসএস/বিএ/জেআইএম

Advertisement