ফিচার

জীবনের গল্প লিখে জীবিকা

‘হেলপ মি, আই অ্যাম ভেরি টায়ার্ড মামুন’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের বিপরীত দিকে টিএসসি থেকে শাহবাগগামী রাস্তায় এক মধ্যবয়সী লোক নিচু হয়ে চক হাতে লিখে চলেছেন। ময়লা তেল চিটচিটে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরিহিত লোকটির গায়ে কাপড় নেই। একটি পা হাঁটু পর্যন্ত কাটা। অপরটি কাটা না হলেও অচল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, রিকশাচালক ও পথচারীরা ফুটপাতে থমকে দাঁড়িয়ে হামাগুড়ি ভঙ্গিতে লোকটি রাস্তায় যা লিখছেন তা মনোযোগ সহকারে পড়ে দেখছিলেন। কেউ কেউ আবার লেখাগুলো পড়ে দুই, চার, পাঁচ ও দশ টাকার নোট লোকটির সামনে রাখা প্লাস্টিকের বাটিতে ছুড়ে দেন। বিকেল সোয়া ৩টা। কৌতূহলবশত এ প্রতিবেদক এগিয়ে গিয়ে দেখেন, আনুমানিক চার-পাঁচ ফুট জায়গাজুড়ে দক্ষ কারুশিল্পীর মতো নিপুণ হাতে বাংলা ও ইংরেজিতে জীবনের গল্প লিখেছেন লোকটি। যার সারমর্ম হলো- চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার সময় ট্রেন দুর্ঘটনায় তার পা কাটা পড়ে। তার কর্মক্ষমতা নেই। তিনি বাঁচার মতো বাঁচতে চান। পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে বাঁচার জন্য নগরবাসীর কাছে আর্থিক সাহায্য চান তিনি। একটু লক্ষ্য করে দেখা গেল, অনেকেই আগ্রহ নিয়ে লেখাগুলো পড়ছেন। প্রথমেই ইংরেজিতে লেখা রয়েছে, সিটি ব্রাদার অ্যান্ড সিষ্টার, ষ্ট্যান্ড আপ। এরপর বাংলায় লেখা, সিটি ভাই ও সিটি বোন, একটু থামুন, লন্ডভন্ড মামুন, এক্সিডেন্টে পা দুটি নেই। এরপর আবার ইংরেজিতে লেখা আই অ্যাম ভেরি টায়ার্ড মামুন, প্লিজ স্যার, প্লিজ ব্রাদার, হেলপ মি অ্যান্ড হেলপ মি, সিটি সিষ্টার, প্লিজ হেলপ মি, বাই দি কস অব ট্রেন এক্সিডেন্ট। এরপর আবার বাংলায় লেখা সিটি স্যার, ভাই ও বোনেরা আমি মামুন। বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। পাঁচজনের জীবন নিয়ে একটু সাহায্য বা সহায়তা করুন। প্রতিবন্ধী মামুন। কর্ম করে খাব সেই শক্তিটুকু আমার হারিয়ে গেছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের শিক্ষার্থী নাজমুন নাহার তার বন্ধুকে নিয়ে শাহবাগের দিকে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে লেখাগুলো পড়ে হাতব্যাগ থেকে ১০ টাকা বের করে প্লাস্টিকের বাটিতে ছুড়ে দিলেন। পাশে দাঁড়ানো বন্ধুটিকে বললেন, দেখেছ লোকটির হাতের লেখা কি চমৎকার। লোকটি জীবন ধারণের জন্য কি পথ বেছে নিয়েছে।এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে মামুন মিয়া জানান, তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায়। আনুমানিক ১০ বছর আগে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। পথে ট্রেন থেকে নামার সময় পিছলে পড়ে চাকার নিচে পা দুটি চলে যায়। একটি পা হাঁটু পর্যন্ত কাটা পড়ে। অপরটি না কাটতে হলেও পঙ্গু হয়ে যায়। মামুন মিয়া জানান, পঙ্গু হলেও স্ত্রী ও ছেলেমেয়েসহ পাঁচ সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণ করতে হয়। ট্রেন দুর্ঘটনার পর জীবনের মায়া ছেড়ে দিলেও পরিবারের সদস্যদের দিকে তাকিয়ে জীবন সংগ্রাম শুরু করেন। গত ১০ বছর ধরে নগরীর রাজপথে প্রতিদিন চক দিয়ে জীবনের গল্প লিখে জীবিকা নির্বাহ করে চলছেন।ওআর/আরআইপি

Advertisement