মতামত

বাংলা ভাষার ভবিষ্যত : ভাবনা-দুর্ভাবনা

ফেব্রুয়ারি মাস এলে মনে প্রশ্ন জাগে বাংলাভাষার ভবিষ্যত কি?বাংলা বিপন্ন ভাষা নয়। পৃথিবী থেকে প্রতি পনের দিনে একটি করে ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বাংলার সে ভয় নেই, কারণ বাংলাভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা সব মিলে ত্রিশ কোটির বেশি। জনসংখ্যার বিচারে পৃথিবীর পঞ্চম কি ষষ্ঠ ভাষা বাংলা। আমরা জানি ভাষা নদীর মত বহতা, তার পরিবর্তন রূপান্তর ঘটে, গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে সচল ভাষা সমৃদ্ধি অর্জন করে চলে। এইখানে বোধহয় একটু থেমে ভাবতে হয়, বাংলা বিপন্ন না হলেও আজকের দিনে একটি বর্ধিষ্ণু ভাষা কিনা। নাকি বাংলাভাষা একটি ক্ষয়ের পর্ব অতিক্রম করছে? এমন প্রশ্ন মনে উদয় হওয়ার কারণ আছে। বাংলা এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একমাত্র ভাষা হলেও, এমনকি এদেশ প্রায় একভাষী একটি রাষ্ট্র হলেও (একরকম ভাবার কারণ অন্যান্য ভাষী ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহকে নানা বাস্তব কারণে বাংলা শিখতে ও চর্চা করতে হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয়।) কী রাষ্ট্র পরিচালনায় কী সমাজজীবনে বাংলার কদর কমতির দিকে। মোটা দাগে বলা যায় রাষ্ট্রে ও সমাজে যারা ক্ষমতাবান অর্থাৎ দেশের যারা শাসক শ্রেণি তারা বাংলার চর্চা ত্যাগ করে ইংরেজিমুখি হচ্ছেন। তারা যদি বাংলা চর্চা অব্যাহত রেখে পাশাপাশি ইংরেজিও রপ্ত করতেন তাহলে বাংলা ভাষার ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু তা ঘটছে না। বাংলা এই শ্রেণির মানুষের কথ্য ভাষায় সীমিত হয়ে পড়ছে। এই কথ্য বাংলা একদিকে আঞ্চলিকতায় পীড়িত অন্যদিকে ইংরেজি শব্দের যথা বা অপপ্রয়োগে ভারাক্রান্ত। এরকম ভাষার আদর্শ নমূনা শোনা যাবে হালে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এফএম ব্যান্ডের রেডিওগুলোতে। এ ভাষাই চলছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, হালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, সংখ্যায় বাড়তে থাকা ইংরেজিমাধ্যম স্কুলগুলোতে, শহরের অভিজাত পাড়ায়। অন্যত্র ‘পিছিয়ে থাকা’  তরুণ সমাজ এ ভাষাটা অনুকরণ করছে এদেরই সমাজের ‘এগিয়ে থাকা’ মানুষ বলে বিভ্রান্ত হয়ে। সারা বিশ্বে যে ভাষাটি দাপটে বিরাজ করছে ও অন্য অনেক ভাষাকে কোণঠাসা করে এগিয়ে চলেছে সেটি ইংরেজি। জাতিসংঘ অনেক ভাষাকে স্বীকৃতি দিলেও তার কাজকর্মের মূল ভাষা ইংরেজি। বর্তমান বাস্তবতায় ইংরেজি কেবল প্রধান আন্তর্জাতিক ভাষা নয়, এ হল এ বিশ্বের লিংগুয়া ফ্রাংকা  যোগাযোগের ভাষা। ফলে ইংরেজি  চর্চার ঝোঁক সারা বিশ্বে সর্বত্র বেড়েছে। সম্ভবত ভাষা হিসেবে ইংরেজির কিছু টেকনিক্যাল সুবিধাও আছে। মাত্র ছাব্বিশটি বর্ণ এর বাহন আর অন্যদিকে বাক্যের বৈচিত্র ও শব্দের বিকল্পের প্রাচুর্য তাকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নমনীয়তা দিয়েছে। ব্যাপক প্রচলনের কারণে ভাষাগত সংস্কার বা রক্ষণশীলতা তার নেই। এই ঔদার্যের সুযোগে বিভিন্ন স্থানীয় ভাষার ওপর ভর করে এ ভাষারই প্রভাব বলয় বেড়ে চলেছে। হিন্দিতে শোনা যায় সংবাদের মত আনুষ্ঠানিক পাঠ্যে দেদার ইংরেজি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। এ কৌশলই অনুকরণ করছে আমাদের এফএম রেডিওর জকিরা হ্যাঁ  বেতারের ঘোড়সওয়াররা। দেশে একটা দল, সম্ভবত ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, মনে করছেন বাংলাদেশের বাংলা হবে এখানকার আঞ্চলিক ভাষার ভিত্তিতে সৃষ্ট বাংলা। এটা ভাষাবিজ্ঞানের দিক থেকে একটা প্রমাদপূর্ণ ভাবনা বলেই মনে হয়। প্রথমত, বাংলাদেশের প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষাগুলো উপভাষার একটিমাত্র ধারায় সীমাবদ্ধ নয়, কয়েকটি ধারায় বিভক্ত। আমরা দেখি নোয়াখালির আঞ্চলিকভাষী মানুষ রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা বুঝতেই পারবেন না এবং একইভাবে এর উল্টোটি সত্যি। অর্থাৎ আঞ্চলিক ভাষাভিত্তিক ভাষা তৈরি করতে চাইলে একটা ভাষাগত নৈরাজ্য দেখা দিতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, যে বাংলাভাষাটি এতকাল প্রমিত বাংলা ভাষা হিসেবে প্রচলিত হয়ে আসছে সেটি যেমন একটি বিশেষ অঞ্চলের  মানুষের মুখের ভাষা অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া-শান্তিপুরের ভাষা  তেমনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চলের ভাষাটিকেই প্রমিত ভাষার ভিত্তি ধরা যাবে না কেন? এই ভাষা হিসেবে যেটি টিভি নাটকে বা কারও কারও লেখায় ব্যবহৃত হচ্ছে তা আদতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুকাল ব্যবহৃত ক্যাম্পাসের খিচুড়ি ভাষা। একটা কথা মনে রাখা দরকার, কথ্য উপভাষাগুলো অল্প স্থানিক দূরত্বেই কিছু কিছু রূপ পাল্টায়। ফলে কথ্য উপভাষাকে প্রমিতকরণের সমস্যা থেকেই যাবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল ভাষা তো কেবল কথা বলা বা মৌখিক সংযোগের বাহন নয়, নয় কেবল নাটক-গল্প রচনার মাধ্যম কিংবা নয় এফএম রেডিও বা টিভিতে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান উপস্থাপনের বাহন। চিন্তামূলক, দার্শনিক, মননশীল লেখা, বিজ্ঞান ও নানান তত্ত্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ নানান আনুষ্ঠানিক ভাববিনিময়, ভাব প্রকাশের মাধ্যম। তাই ভাষার অনানুষ্ঠানিক বা  ইনফর্মাল (যা মুখের ভাষায় প্রকাশ পায়) রূপের পাশাপাশি প্রমিত বা ফর্মাল (লিখিত ব্যাকরণসিদ্ধ রূপ) রূপেরও প্রকাশ ঘটতে থাকে। বাংলার শ্রেষ্ঠ মনীষীরাই তাঁদের চিন্তা ও ভাব প্রকাশের মাধ্যমে ধীরে ধীরে এই প্রমিত বাংলাভাষাটির রূপ দিয়েছেন। প্রমিত ভাষাও কোন অজড় অনড় স্থায়ী বিষয় নয়। আমরা দুশত বছরের বাংলা গদ্যের নমূনা পাঠ করলেই দেখব কিভাবে ভাষা জড়তা কাটিয়ে বেগবান হয়ে উঠেছে, তৎসম শব্দের শৃঙ্খল ভেঙে সহজ আটপৌরে হয়ে উঠেছে। ভাষা এভাবে বদলাচ্ছেই, নিজের নিয়মে, সৃজনশীল-মননশীল ব্যবহারকারীদের চিন্তাশীল সযত্ন প্রয়াসের মাধ্যমে। এ পরিবর্তন প্রায় অধিকাংশ ব্যবহারকারীর অজ্ঞাতে মসৃণভাবেই ঘটে থাকে। ভাষার ক্ষেত্রে জবরদস্তি চলে না। এটি যেমন বাংলাভাষীর ওপর উর্দুভাষা চাপিয়ে দেওয়ার রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হবে না, তেমনি ঘটবে না কারও খেয়ালখুশির আবদারের মাধ্যমে। আবার কারও অতি রক্ষণশীল আচরণ এক সময় তাঁকেই তামাদির পর্যায়ে ফেলে হাস্যকর করে তুলতে পারে। এ মুহূর্তে মনে হয় বাংলা ভাষা অস্তিত্বের সংকটে না পড়লেও, অর্থাৎ পৃথিবীর একটি বিপন্ন ভাষায় পরিণত না হলেও, তার ভবিষ্যত নিয়ে উৎকণ্ঠার কারণ ঘটেছে। দুটি দিক থেকে বিপদ তৈরি হচ্ছে বলে মনে হয়। একদিকে ক্ষমতাবান শাসক শ্রেণীর বাংলা চর্চা পরিত্যাগ ও প্রায় একক ভাষা হিসেবে ইংরেজি চর্চা ও ব্যবহারের ঝোঁক বৃদ্ধি। আরেকদিকে বাংলা ভাষা চর্চাকারীদের ভিতরেই একটা অংশ তৈরি হচ্ছেন যারা স্বাধীন দেশ হিসেবে (কিংবা অন্তরের মুসলিম জাত্যভিমানের তাগিদে) আমাদের ভাষাস্বাতন্ত্র্য দাঁড় করাতে চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রমিত বাংলা থেকে এদেশীয় আঞ্চলিক ভাষা-নির্ভর ‘আমাদের প্রমিত’ বাংলা তৈরির চেষ্টা করছেন। তাঁদের এ চেষ্টা ফলবান হলে বস্তুত যথার্থ প্রমিত বাংলার অভাবে ভাষাগত নৈরাজ্য ও দুর্বলতার সৃষ্টি হবে। মানবসংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য হল, মানুষ সবকিছুতেই একটা প্রমিতকরণে (standardization)পৌঁছাতে চায় সেটা খাবার, পোশাক থেকে শুরু করে ভাষা-সঙ্গীত, নৃত্য সর্বত্রই পরিদৃষ্ট হয়। আর এভাবে একটি অঞ্চলের মানুষ কোন কালে উচ্চতর সংস্কৃতি ও সভ্যতার জন্ম দিতে থাকে। উপমহাদেশের রাগসঙ্গীতের সূচনা হয়েছে নানান আঞ্চলিক গান, স্বর, সুর থেকে উপাদান আহরণ করে অত্যন্ত মেধাবী ও সৃজনশীল কলাকারদের হাতে। তার সাথে পারস্য থেকে আগত সঙ্গীতকারদের মেধা ও সৃজনশীলতা যুক্ত হয়ে এ সঙ্গীত কালে কালে তার শুদ্ধ প্রমিত রূপটি ধারণ করেছে। এটা মানবের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রার অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য। আমার ভাষা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে কিনা সেটি মূল বিষয় নয়, মূল ভাবনার বিষয় হল আমার বাহনটি আমাদের সর্বরকমের ভাবনা-চিন্তাকে বহন করার ক্ষমতাসম্পন্ন জীবন্ত ভাষা থাকছে কিনা। তবে যারা বাংলার এই পূর্ব-পশ্চিমের বিভাজন নিয়ে দুশ্চিন্তিত তাঁদের আশ্বস্ত করে বলতে পারি যে দীর্ঘ রাষ্ট্রীয় বিভাজন এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও আঞ্চলিক ভাষার স্বাতন্ত্র্যের কারণে এ দুদেশের সৃজনশীল রচনায় পার্থক্য সহজেই ধরা পড়বে। হয়ত বৃহত্তর কালিক ব্যবধানে মননশীল রচনার ভাষাতেও পার্থক্য ধরা পড়তে পারে। কিন্তু সেটা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত  হওয়ার কিছু নেই। এখন যেটি মূল দুশ্চিন্তার বিষয় তা হল বাংলা ভাষা কতটা সচল, কতটা গতিশীল ও জীবন্ত আজ? এ ভাষা কি একটি বর্ধিষ্ণু নাকি ক্ষয়িষ্ণু ভাষা এখানে এখন? আমি ভয়ে ভয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি, স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জিত হওয়া সত্ত্বেও, বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া সত্ত্বেও, আজ বাংলা একটি ক্ষয়িষ্ণু ভাষায় পরিণত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ইংরেজি ও হিন্দির আগ্রাসনে এর দুরবস্থা, আর এখানে ইংরেজি ও আমাদের সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তির ফলে পরিণতি একই হচ্ছে। ফলে মাতৃভাষাকে ক্ষয়িষ্ণু হতে দিয়ে কেবল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবে বাহবা নিতে গেলে কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে মাসব্যাপী উন্মাদনার সৃষ্টি করলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। মাতৃভাষা ভালোভাবে শিখে চর্চা অব্যাহত রেখেও যে ইংরেজি ভালোই শেখা যায় সে বিশ্বাস কিভাবে অর্জন করব? সেটি কি বিদ্যাসাগর থেকে বুদ্ধদেব বসু, হুমায়ুন কবির থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও কর্ম থেকে আমরা বুঝতে পারব না? বাংলা ভাষার ক্ষয় বন্ধ করতে হলে ভাষার মর্যাদা তো আমাদের অন্তরের মধ্যে তৈরি হতে হবে, ভাষার প্রতি ভালোবাসা হতে হবে খাঁটি। বছরব্যাপী সন্তানের ইংরেজি জ্ঞানের বহর পরখ করে কাটিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলার জন্যে ভাবাবেগ ছড়ালে কোন লাভ হবে না। শুনেছি কোন কোন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে মাতৃভাষা বাংলায় কথা বললে ছাত্রদের জরিমানা গুণতে হয়। আইন করে এই ধৃষ্টতা বন্ধ করে ভাষা বিকাশের কাজটা শুরু করা যায়।লেখক : কবি, সাংবাদিক, সমাজচিন্তাবিদ। এইচআর/পিআর

Advertisement