রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার বাসিন্দা এলেনা। বাবার স্নেহবঞ্চিত মেয়েটি মায়ের আদরে গড়া। মা এলাকায় গৃহকর্মীর কাজ করে। মেয়েটির বয়স যখন আট কি নয়, তখন তাকেও একটি বাসায় কাজে দেয়া হয়। ফুটফুটে এলেনার দিন ভালোই যাচ্ছিলো। বছর তিনেক পরে তার মা সিদ্ধান্ত নিলেন এলেনাকে বিয়ে দেবেন। বর হিসেবে যাকে নির্বাচন করা হয়েছে, সে ভ্যানচালক। প্রায় ১২ বছর বয়সী এলেনা যে বাসায় কাজ করতো সে বাসার লোকজন বিয়েতে আপত্তি জানালেও তার মা সেটা শুনতে নারাজ। বিয়ে হলো এলেনার। কিন্তু সংসার টিকলো না। মাত্র দু’বছরের মাথায় এলেনা স্বামী পরিত্যক্তা। এখন সে মায়ের সঙ্গে থাকে। এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়, আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার জীবনের যে গতি ছিলো সেটিও এখন শ্লথ।এলেনার মতো হাজার হাজার মেয়ে প্রতিদিন বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। হাজারো এলেনার স্বপ্ন পুড়ে ছাই হচ্ছে দারিদ্র্যতা আর অভিভাবকদের অদূরদর্শিতার কারণে। বছরে লাখো এলেনা শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র বাল্যবিয়ের কারণে। অথচ বাল্যবিয়ে রোধে দেশে আইন আছে, সরকারের প্রচেষ্টারও অন্ত নেই। তবুও এর বিস্তার ঠেকানো যাচ্ছে না। সমাজের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণিতে বাল্যবিয়ের মতো ঘটনা কম-বেশি ঘটছে। তবে বস্তিগুলোতে এর বিস্তার প্রকট আকারে।একাধিক পর্যবেক্ষণে জানা যায়, রাজধানীর বস্তিতে বসবাসকারী কন্যা শিশুদের শতকরা ৮০ ভাগ বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। বালকদের মধ্যে এ হার শতকরা ৪৬ ভাগ। দারিদ্র্য, কুসংস্কার, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, যৌন হয়রানি, কন্যাশিশুর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব এবং সর্বোপরি অভিভাবকের অদূরদর্শীতার কারণে কন্যাশিশুরা বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে বলে পর্যালোচনায় উঠে এসেছে। অপরিণত বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে এসব কন্যাশিশুরা যৌনমিলনজনিত ও ফিস্টুলাসহ শারীরিকভাবে নানা সমস্যার শিকার হয়। অনেকে মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।বাল্যবিয়েকে জনসংখ্যার সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাল্যবিয়ে রোধ করা না গেলে সামাজিক ক্ষত শুধু বেড়েই যাবে। এর ফলে জাতি মেধাবী ও সামর্থ্য ভবিষ্যত নাগরিক বঞ্চিত হবে। আর মাতৃমৃত্যু বা কন্যাশিশুর জীবনহানি ঘটবে। অভিভাকদের খামখেয়ালিপনা ও অজ্ঞতা, সামাজিক প্রেক্ষাপট, সতীত্ব সম্পর্কে অস্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মীয় মনোভাব, ভূয়া জন্মনিবন্ধনের মাধ্যমে বয়স বাড়িয়ে বিয়ে, কাজির দুর্নীতিসহ নানা কারণে সমাজের পিছিয়ে পড়া নাগরিক সমাজে বাল্যবিয়ে চলছে সবার অলক্ষ্যে।বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, বস্তিতে বসবাসকারী কন্যাশিশুর ভালো পাত্র বলে ধারণার কারণে ৫২ ভাগ, দারিদ্র্যতার কারণে ২০ ভাগ এবং যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কারণে ১৯ ভাগ বাল্যবিয়ের প্রধান কারণ।ইউনিসেফের বিশ্ব শিশু পরিস্থিতি ২০১১-এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে প্রতি তিনজনের মধ্যে দু’জন কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়। শতকরা ৬৬ ভাগ মেয়ের ১৮ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। এর মধ্যে ১৫ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ কন্যাশিশু গর্ভবতী হয় অথবা মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করে।জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন ২০১৩-এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিবছর দেশে ১০ থেকে ১২ লাখ বিয়ে হয়। এর মধ্যে প্রতিবছর ১ লাখ ৭০ হাজার (প্রায় ১৭ শতাংশ) মেয়ে ১৫ বছর হওয়ার আগে বিয়ের শিকার হয়। দেশের শতকরা ৬০ ভাগের বেশী মেয়ে ১৮ বছর বয়সের আগে গর্ভধারণ করে। এর এক-তৃতীয়াংশ মায়ের বয়স ১৫ বছরের নীচে।পরিসংখ্যান অনুসারে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে, কৈশোরে গর্ভধারণ এবং মাতৃমৃত্যু হয়। ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস (বিবিএস) এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বাংলাদেশের জন্য বাল্যবিয়ে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।বাল্যবিয়ে রোধকল্পে সরকার একাধিক আইন করলেও কাঙ্খিত হারে তার সুফল মিলছে না। নির্দিষ্ট সময়ের আগে কন্যাশিশুর বিয়ে হলে বর-কনে, অভিভাবক, কাজীসহ সংশ্লিষ্টদের একাধিক ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ ধরনের শান্তির নজির খুব একটা নেই। আর সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জনগোষ্ঠীর বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান না থাকার কারণেও এ ধরনের ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না।একাধিক পর্যালোচনায় জানা যায়, নারীর প্রতি সহিংসতা ও পারিবারিক নির্যাতনকে উসকে দেয় বাল্যবিয়ে। বিশেষ করে শারীরিক অপরিপক্কতার কারণে শিশুকন্যাটি বিয়ের পরে স্বাস্থ্যগত নানা জটিল সমস্যার শিকার হয়। মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় সবাই। ফলে জীবন বিকাশে নানা জটিলতা দেখা দেয়। -বাসসআরএস/আরআই
Advertisement