বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে অতএব আরেকটি নির্বাচন কমিশন গঠনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। একটি কথা স্বীকার করে নিয়েই আমাদের এ বিষয়ে কথা বলা প্রয়োজন যে, দেশে নির্বাচন কমিশন গঠনে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। কোনো সরকারই নির্বাচন কমিশন গঠনে কোনো আইনী কাঠামো নির্মাণ করেনি। এর কারণ হচ্ছে, প্রতিটি সরকারই একটি ‘বন্ধু কমিশন’ চায়, নির্বাচন কমিশন নয়- এমনটি যদি ভাবা হয় তাহলে বোধ করি বেশি ভাবা হবে না। কিন্তু এখানে একটি কথা রয়েছে, নির্বাচন কমিশন গঠনে কোনো সুনির্দিষ্ট আইন না থাকা সত্ত্বেও (ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচন কমিশন গঠনে মোটামুটি স্বাধীন, ইচ্ছেমত নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারে, যদিও রাষ্ট্রপতি এই দায়িত্বটি পালন করে থাকেন সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী) এ পর্যন্ত আমরা যতোগুলো নির্বাচন কমিশন দেখি তাতে লক্ষ্যণীয় যে, বিএনপি শাসনামলে যে ক’টি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে সেগুলো গঠনে কোনো আলোচনা কিংবা কমিশন গঠনের আগে একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়নি। ১৯৯৬-এর মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে যে নির্বাচন কমিশন গঠন করে সে সময়ই প্রথম আমরা সার্চ কমিটি বা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রচেষ্টা শুরু করে। নাহলে আমরা কিন্তু এদেশে বিচারপতি এম এ রউফ বা বিচারপতি এম এ আজিজ মার্কা নির্বাচন কমিশন দেখতে পেয়েছি কারো সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা ছাড়াই এবং তারা কী ধরনের নির্বাচন কমিশন হিসেবে এদেশের নির্বাচনে ভূমিকা রেখেছেন তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছুই নেই। নির্বাচনে জয়ী হলেই নির্বাচন কমিশন ভালো আর পরাজিত হলে নির্বাচন কমিশন দলীয়- এই চেতনা এবং এর বহিঃপ্রকাশ এদেশে বার বার লক্ষ্য করা যায়। বিগত ও বর্তমান সরকারের আমলে যখন বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি’র নেতৃত্বে চার দলীয় জোটের প্রার্থীরা বিজয় লাভ করে তখন কিন্তু বিএনপি’র পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে টু-শব্দটি করা হয়নি। কিন্তু যখনই উপজেলাসহ অন্যান্য স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীরা হারতে শুরু করে তখনই প্রথম বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রশ্ন ওঠাতে শুরু করে তারা। এরপর জাতীয় নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে দর কষাকষিতে যখন বনিবনা হয় না কিংবা বলা ভালো যে, বিএনপি-জামায়াত এই নিশ্চয়তা পায় না যে, তারা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারবে তখন তারা নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে। কিন্তু সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করতেই হয় নির্বাচন কমিশনকে। প্রশ্ন হলো, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক দুর্বলতা এতোটাই প্রকট ছিল যে, ৫ জানুয়ারির মতো একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারও এদেশে টিকে যায় এবং বাধ্য হয়েই বাকি বিশ্বকেও সে সরকারকে মেনে নিতে হয়, কারণ একথা সকলেই বুঝেছিল যে, বাংলাদেশ এখন যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে বাংলাদেশকে পরিচালনার জন্য বিকল্প কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি আসলে প্রস্তুতই ছিল না। যদি থাকতো তাহলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে উড়িয়ে দিতে বিদেশি মুরুব্বিদের পাঁচ মাসও লাগতো না। এবং একথাও প্রমাণিত হয়েছে যে, গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করাটা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ছিল আত্মহত্যার শামিল, যার মূল্য এখনও পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোটকে দিতে হচ্ছে। দুঃখের বিষয় হলো, এই যে বাংলাদেশ গত আট বছরে এক লাফে এতোটা এগিয়ে গেলো এতে কিন্তু দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল অর্থাৎ বিএনপি’র কোনো রকম অংশগ্রহণ নেই। তারা কেবল নিজেদের আখের গোছানো নিয়ে এতোদিন টিকে আছে বলে আমরা দেখতে পাই। দেশের সফলতায়তো তারা নেই-ই, সরকারের অগণতান্ত্রিক ও জনবিরোধী সিন্ধান্তের প্রতিবাদে জনগণের পাশেও তারা নেই। কিন্তু যখনই আবার ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে বলে সময় এসেছে তখনই তারা নড়েচড়ে বসেছে। কিন্তু সেটাও কী ভাবে? যখন সরকার একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বার বার তাগিদ দিচ্ছে তখন তারা এটিকে কিভাবে বিতর্কিত করা যায় তা নিশ্চিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। শুরুতেই বলেছি যে, এদেশে নির্বাচন কমিশন গঠন রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। আর রাষ্ট্রপতি মূলতঃ সকল কাজই করে থাকেন প্রধানমন্ত্রীর চাওয়া অনুযায়ী। কিন্তু আগেও দেখা গেছে এবং বর্তমানেও দেখতে পাচ্ছি যে, নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছেন এবং তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটি সার্চ কমিটি গঠন করছেন, যাদের দায়িত্ব আবারও রাজনৈতিক দলসমূহ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের (যেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেন না, কিংবা তারা ভোট দেন না। এদেশে বিশিষ্ট হওয়ার জন্য বোধ করি রাজনৈতিক দলগুলোকে গালাগাল দিতে হবে, নাহলে তাদেরকে আলাদা করে কেন ডাকা হবে সে প্রশ্ন থেকেই যাবে, কারণ রাজনৈতিক দলগুলো থেকেতো নামের তালিকা নেওয়াই হচ্ছে, তাই নয় কি?) দেওয়া তালিকাটি রাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের নির্দেশনা দেবেন। শুরু থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি ঘরানার দলগুলো এই উদ্যোগকে কী করে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় সে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, অথচ তাদের আমলে এমন কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি, যা আগেই উল্লেখ করেছি। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিএনপি আলোচনা করে উৎফুল্ল ভাব দেখিয়েছে যাকে ইতিবাচক মনে হয়েছে, দীর্ঘদিন পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ একটি হাসিখুশির ভাব ফিরে এসেছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছেন ঠিক সেই মুহূর্তে বিএনপি’র পক্ষ থেকে একে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, রাষ্ট্রপতি যাদের নাম অন্তুর্ভুক্ত করেছেন এই সার্চ কমিটিতে তার বিকল্প কোনো নাম বিএনপি’র পক্ষ থেকে উল্লেখও করা হয়নি। কারণ যে কারণে এই কমিটিকে ‘দলীয়’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে, সেই একই কারণে কাউকে খুঁজতে গেলে এদেশে নিরপেক্ষ বলে আসলে কাউকেই পাওয়া সম্ভব নয়। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সেই বক্তব্য এখানে স্মর্তব্য যে, পাগল ও শিশু ছাড়া এদেশে কেউ নিরপেক্ষ নয়। লক্ষ্য করুন, সার্চ কমিটি ইতোমধ্যেই দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে আলোচনা করেছে এবং আরো করবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে সম্ভাব্য নির্বাচন কমিশনারদের তালিকা চেয়েছে। অপরদিকে বিশিষ্ট নাগরিকগণ বলেছেন যে, তারা একটি সাহসী নির্বাচন কমিশন চান যারা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে জাতিকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার বার বলছেন যে, তিনি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চান। তিনি একথাও বলছেন যে, আর কোনো বিতর্কিত নির্বাচন এদেশে অনুষ্ঠিত হোক সেটি তার কাম্য নয়। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে বিতর্কিত বলে মেনে নেন বলেই আমরা ধরে নিতে পারি, যা একটি দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে। কিন্তু যেহেতু আমরা প্রশংসা করায় কৃপণ, সেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির এই উদ্যোগের প্রশংসা করতে নারাজ, বরং কী ভাবে একে বিতর্কিত করা যায় সে পথ খুঁজছি অনবরত। ইতোমধ্যেই আমরা দেখতে পেয়েছি যে, বিদেশিদের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন গঠনের এই উদ্যোগ নিয়ে আলোচনার জন্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চাওয়া হয়েছে। আশ্চর্যজনক ভাবে এখানে জাতিসংঘকে ব্যবহার করা হয়েছে। এবং রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার জন্য যে ‘দল’ গঠন করা হয়েছে তাতে জাতিসংঘ-এর নামে এমন সব দেশের রাষ্ট্রদূতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যারা অতীতেও এদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলিয়ে আসছে। অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে এই নাক গলিয়েদের লম্বা নাককে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে। জাতিসংঘও ব্যর্থ হয়েছিল আলোচনায়। বাংলাদেশ যে আর আগের অবস্থানে নেই, কথায় কথায় যে বাংলাদেশকে নসিহত করার আর সুযোগ সত্যিই নেই সেকথাটি বাংলাদেশের এই তৃতীয় ও শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠনের (যাদের নেতৃত্বে বিদেশিরা থাকলেও দেশি সদস্যরাও রয়েছেন) এখনও বুঝতে পারেনি, বা তাদেরকে বুঝতে দেওয়া হচ্ছে না এখনও। কারণ, তাতে এদেশে যারা এই সংগঠনের সদস্য রয়েছেন (যাদের বেশিরভাগই আসলে এদেশের বিশিষ্ট নাগরিকও বটেন) তাদের আয়-রোজগারে টান পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। ফলে মাথাটি বাংলাদেশের হলেও ব্যথাটি কখনও কখনও বিদেশিদের হয় বলে আবারও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। দুঃখজনক হলো, দেশের সংকট নিরসনে দেশজ দাওয়াই না খুঁজে বিদেশি ঔষধ খোঁজার খায়েশওয়ালাদের তালিকাও এদেশে দীর্ঘ। অতীতে আওয়ামী লীগও এই কাজটি করেছে, তখনও একথা জোর দিয়েই বলেছি যে, দেশের সমস্যা সমাধানে বিদেশিদের কাছে ধর্ণা দেওয়া এই প্রবণতা আত্মঘাতী এ কারণে যে, কেউই বাংলাদেশের মানুষের দিকে তাকিয়ে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান দেবে না, বরং তাদের স্বার্থ রক্ষা করাটাই হবে এখানে মুখ্য। লক্ষ্যণীয় যে, আওয়ামী লীগ দৃশ্যতঃ বিদেশ-নির্ভর প্রবণতা থেকে সরে এসেছে, ভবিষ্যতে কখনও বিরোধী রাজনীতিতে গেলে কি করবে সেটা বলতে পারবো না। অপরদিকে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপি’র বিদেশি-নির্ভরতা এখন এতোটাই নিন্মস্তরে গিয়ে নেমেছে যে, চাইলেই যে কোনো দেশের কাছে বাংলাদেশকে ইজারা দিতে দলটি দ্বিতীয়বার ভাববে বলে মনে হয় না। একথা তাই আবারও বলতে হচ্ছে যে, এই বিদেশি-নির্ভরতা দেশ ও জাতির জন্য সত্যিই ভয়ঙ্কর। কিন্তু দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের একটি এই প্রবণতা ত্যাগ করলে কাজ হবে না, দল-মত নির্বিশেষে সকলকে এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, নাহলে আমাদের মাথা নিয়ে ওদের ব্যথা হবেই এবং সে ব্যথা প্রশমনের অজুহাতে ওরা মাথাটি নিয়ে ফুটবল খেলারও সুযোগটি পেয়ে যাবে অনায়াসেই। ঢাকা, ৩১ জানুয়ারি, মঙ্গলবার ২০১৭লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.comএইচআর/এমএস
Advertisement