বিনোদন

শিল্প হয়েও বাণিজ্য মেলায় নেই ঢাকাই চলচ্চিত্র!

দীর্ঘ পাঁচ দশক পর চলচ্চিত্র পরিবেশক-প্রযোজক, পরিচালক-শিল্পীদের দাবির মুখে ২০১০ সালে চলচ্চিত্রকে শিল্প খাত হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া এই ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ শিল্পের মর্যাদা পায়। বেশ কিছু রদবদলও আসে চলচ্চিত্রের নিয়ম-রীতিতে। তবে গেল কয়েক বছরে তুুমুল সমালোচিত যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণ, দক্ষ শিল্পী সংকট, মানহীন-নকল গল্পে ছবি নির্মাণ, পরিচালকদের অজ্ঞতা, বাজেট সীমাবদ্ধতা, কারিগরি দুর্বলতা, পাইরেসিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে কমে গেছে ঢাকাই চলচ্চিত্র শিল্পের উৎপাদনশীলতা। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হল।তবুও টনক নড়ছে না এ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের। সর্বত্রই দিন বদলে দেয়ার আলোচনা, গোলটেবিল বৈঠক। কাজের কাজ কোথাও তেমন চোখে পড়ে না। ইতিবাচক তেমন কোনো পরিকল্পনাও লক্ষ করা যায় না চলচ্চিত্র শিল্প কারখানা খ্যাত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার। এসব কারণেই ঢাকাই ছবির উন্নয়নে এফডিসির আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় বারবার। তথ্য মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে কেন জানি উদাসীন!সেই উদাসীনতার প্রমাণ মেলে শিল্প ঘোষণার পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় চলচ্চিত্র শিল্পের অংশগ্রহণ না করায়। অথচ এই মেলায় দেশের বৃহৎ সব শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ থাকে। পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনপ্রিয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকেও দেখা যায় এ মেলায় স্টল নিয়ে নিজেদের পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের প্রচারের পসরা সাজিয়ে বসেন। কিন্তু দেশের সম্ভাবনাময় শিল্প হওয়া সত্ত্বেও বাণিজ্য মেলায় কোনো অংশগ্রহণ নেই ঢাকাই চলচ্চিত্রের। বিষয়টি নিয়ে কোনো রকম পরিকল্পনা বা ভাবনাও লক্ষ করা গেল না এফডিসি কর্তৃপক্ষের। এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন কুমার ঘোষ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসলে এ বিষয়ে তেমন কোনো পরিকল্পনা নেয়া হয়নি। আজ (২৮ জানুয়ারি, শনিবার) সরকারি ছুটি। আগামীকাল (রোববার, ২৯ জানুয়ারি) অফিসে আসুন। বিস্তারিত কথা বলবো।’এদিকে এ বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজনের। তাদের মধ্যে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য নাসিরুদ্দিন দিলু জাগো নিউজকে বলেন, ‘খুবই চমৎকার একটি বিষয় লক্ষ করেছেন আপনারা। এজন্য আপনাদের ধন্যবাদ। চলচ্চিত্র সাংবাদিকতায় এরকম অনুসন্ধানী ভাবনা খুব প্রয়োজন। বাণিজ্য মেলায় যে ঢাকাই চলচ্চিত্রের একটি স্টল থাকা প্রয়োজন এটাই কেউ ভাবে না!’তিনি আরো বলেন, ‘শিল্প হওয়ার পরও বাণিজ্য মেলায় চলচ্চিত্রের অংশগ্রহণ না করাটা অবশ্যই হতাশাজনক। এর দায় এফডিসির ওপরই বর্তায়। উচিত ছিল একটি স্টল নিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রকে রিপ্রেজেন্ট করা। সেখানে ছবি প্রদর্শন করতে হবে এমন কিছু নয়। বিভিন্ন যুগের সিনেমার পোস্টার, স্টিল ছবি, পুরনো দিনের ছবির ক্যাসেট, ক্যামেরার রিল, বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোর চিত্রনাট্যসহ পরিচালক-শিল্পীদের নানা তথ্য, বিভিন্ন তারকার ছবি ও তাদের সম্পর্কে নানা তথ্যের বইয়ের উপস্থাপনা। এতে শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্রের অন্যরকম মর্যাদা তৈরি হতো। বিদেশিরাও আমাদের চলচ্চিত্র সম্পর্কে আগ্রহী হতেন। আন্তর্জাতিকভাবে চলচ্চিত্রের বিকাশ হতো। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যৌথভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যেত। আমাদের তারকাদেরও দেশের বাইরে প্রসার ঘটতে পারতো। এটা খুবই ইতিবাচক হতো বলে আমি মনে করি। কিন্তু এই ভাবনাটাই আসেনি কারো মাথায়। আমি আগামীকালই বিষয়টি নিয়ে চলচ্চিত্র প্রযোজক নেতা, সেন্সর বোর্ডের নেতা ও এফডিসির কর্তাদের সামনে উপস্থাপন করবো। আর যাতে মিস না হয়, আগামী বছর থেকেই যেন বাণিজ্য মেলায় আমরা অংশ নিতে পারি সেই ব্যাপারেও আলোচনা করবো।’বাণিজ্য মেলায় চলচ্চিত্রের অংশগ্রহণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা মেলার আয়োজকদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি বা কোনো রকম জটিলতা থাকতে পারে কি না জানতে চাইলে এই চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‌‌‘এমনটি হবার কোনো যুক্তি তো দেখছি না। দেশের অন্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের বেলাতে যেসব নিয়মকানুন আছে মেলায় অংশ নেয়ার চলচ্চিত্রের বেলাতে আলাদা কিছু হবার কথা নয়। এর জন্য চলচ্চিত্র শিল্পকে বাণিজ্য মেলার কর্তৃপক্ষের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করে আবেদন করতে হবে। যেহেতু এই বিষয়টি আলোচনা এসেছে, এখন ধীরে ধীরে সব তথ্য ও নিয়মি-রীতি জানা যাবে।’বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির নবনির্বাচিত কমিটির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন, ‘বাণিজ্য মেলায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মতো ব্যবস্থা নেই। যদি সরকার আমাদের চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মতো স্থান নির্ধারণ করে দেন তবে অবশ্যই আমরা বাণিজ্য মেলায় অংশ নেব। আর আমাদের চলচ্চিত্র বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত, এসব সমস্যা আগে সমাধান হোক, তারপর এই উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সেখানে আমরা স্টল দিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দিক মানুষকে জানাতে পারি।’ পরিচালক সমিতির যুগ্ম মহাসচিব শাহীন সুমন বলেন, ‘এখানে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। সেগুলো আগে দূর করতে পারলে তারপর এই ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তবে এটি নিঃসন্দেহে ভালো একটি উদ্যোগ হবে। অনেকের মধ্যে নানা রকম দায়বদ্ধতা কাজ করবে।’ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির বর্তমান সহ-সভাপতি ওমর সানি বলেন, ‘এটি আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্র সম্পর্কে মানুষকে জানানোর একটি ভালো উপায়। আর শিল্প হলেও এতোদিন কেন বাণিজ্য মেলায় চলচ্চিত্রকে পাওয়া যাচ্ছে না সেটার কারণ হচ্ছে আমাদের নিজেদের মধ্যে সামঞ্জ্যসতার অভাব। এফডিসি জানে না চলচ্চিত্রের মানুষ ও দর্শক কী ভাবছে, পরিচালকরা জানেন না শিল্পী ও দর্শক কী ভাবছে, শিল্পীরা জানেন না এফডিসি, পরিচালক বা অন্য পক্ষগুলো তাদের কাছে কী চাচ্ছে। এসব সমন্বয়ের ব্যাপার। কিন্তু আমাদের মধ্যে এর খুব অভাব। এই যে বাণিজ্য মেলায় আমাদের অংশগ্রহণের বিষয়টা আজ বললেন, এটা আমি এর আগে কারো কাছেই শুনিনি। আমাদেরও ব্যর্থতা আছে। তবে প্রসঙ্গটি যেহেতু উঠে এসেছে, এবার নিশ্চয়ই সবার মনোযোগ থাকবে আগামী বছর যেন বাণিজ্য মেলায় একটা অংশগ্রহণ থাকে। আমি বাণিজ্য মেলায় চলচ্চিত্র শিল্পের উপস্থিতির পক্ষে।’এ প্রসঙ্গে আসন্ন চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী চিত্রনায়ক জায়েদ খান বলেন, ‘শিল্প হিসেবে বাণিজ্য মেলায় অবশ্যই আমাদের অংশ নেয়া উচিত। আমরা যে এই চলচ্চিত্রের উন্নয়নের ব্যাপারে কতোটা উদাসীন সেটা বোঝা যায় এই গ্যাপ থেকে। আশা করি, সামনের দিনগুলোতে বাণিজ্য মেলায় জমকালো উপস্থিতি থাকবে। আমরা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সব সমিতি ও এফডিসির সমন্বয়ে অংশগ্রহণ করবো। প্রয়োজনে তথ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাহায্য নেব।’এ বিষয়টি নিয়ে ইন্ডাস্ট্রির সফল চিত্রনায়ক রিয়াজ বলেন, ‘আমাদের অনেক সমস্যা আছে। সবখানেই সমস্যা থাকে। কিন্তু এত বড় একটি প্লাটফর্মে অংশগ্রহণের ‍সুযোগ থাকার পরও এটি মিস করে যাওয়াটা চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য নেতিবাচকই। আশা করবো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভেবে দেখবেন।’চলচ্চিত্রপ্রেমীদের দাবি, শিগগিরই এই বিষয়টি নিয়ে মনোযোগী হবেন চলচ্চিত্রের শিল্পের কর্তাব্যক্তিরা। তারা মনে করেন, শিল্প হয়েও বাণিজ্য মেলায় চলচ্চিত্রের অংশ না নেয়াটা হতাশার। ওখানে অংশ নিলেই যে সব সফল হয়ে যেত হয়তো তা নয়, তবে ইতিবাচক অনেক কিছুই হতে পারতো। দেশের মানুষের মনে চলচ্চিত্র নিয়ে একটা ইতিবাচক ভাবনা তৈরি হতো।প্রসঙ্গত, শুধু চলচ্চিত্রই নয়, অনেক আগেই সংগীতের বাজার ও বিজ্ঞাপন নির্মাণকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখান থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পায় সরকার। শিল্পের সব সুবিধা ভোগ করেও বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণ দেখা যায় না সংগীত ও বিজ্ঞাপন শিল্পের।এলএ

Advertisement