বিশেষ প্রতিবেদন

রাজধানীর বর্জ্য পুড়িয়ে পাওয়া যাবে জ্বালানি

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় দৈনিক উৎপাদিত সাড়ে তিন হাজার টন বর্জ্যের মধ্যে কোনো না কোনোভাবে ১৬০০ টন বর্জ্যই থেকে যাচ্ছে। আর দৈনিক দুই হাজার টন করে বর্জ্য সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব ল্যান্ড ফিল মাতুয়াইলে রাখা হচ্ছে। ফলে দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে ওই মাঠটি। আগামী এক বছর পর আর বর্জ্য ফেলার স্থান পাওয়া যাবে না। এ নিয়ে বেকায়দায় সংস্থাটি। ফলে সনাতন পদ্ধতি ছেড়ে এবার নতুন করে বর্জ্য পুড়িয়ে ছাই করার উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। এজন্য ৭৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে।সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানিয়েছে, নগরীর প্রধান প্রধান সড়কসহ অলিগলিতে প্রতিদিন ময়লা-আবর্জনার স্তূপ পড়ে থাকে। এ থেকে মুক্তি পেতে প্রধানমন্ত্রী নিজেই ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনকে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দুই সিটি কর্পোরেশন প্রতিদিনের বর্জ্য পুড়িয়ে ছাই করতে নগরীর বিভিন্ন স্থানে ফায়ার প্লেস নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু কাজ শুরু করতে গিয়ে দেখা যায়, নগরীতে ফায়ার প্লেস নির্মাণ করার মতো কোনো খালি জায়গা নেই। যে পরিমাণ জায়গা পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো ফায়ার প্লেস নির্মাণের উপযোগী নয়। নির্মাণ করা হলেও তাতে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার কিছু কিছু জায়গা এমন যে, সেখানে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস না পাওয়ায় আগুন না জ্বলার সম্ভাবনা রয়েছে।এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির সহকারী প্রকৌশলী (বর্জ্য) আ হ ম আব্দুল্লাহ হারুণ জাগো নিউজকে জানান, সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে আমরা মাতুয়াইলের নিজস্ব স্থানে বড় ধরনের একটি ফায়ার প্লেস নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। এতে দুটি ফায়ার প্লেস থাকবে। একটিতে সাধারণ বর্জ্য এবং অন্যটিতে ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য পোড়ানো হবে। তিনি আরও জানান, সাধারণ বর্জ্য পুড়িয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মূল বর্জ্যে নিয়ে আসা হবে। ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য পোড়ানোর পর যে নির্যাস থাকবে তা দিয়ে কয়লাজাতীয় দ্রব্য উৎপাদন করা হবে। ব্যবহৃত হবে ‘প্রত্যাখ্যান উদ্ভূত জ্বালানি’ হিসেবে। আর এ দ্রব্য (ল্যান্ড ফিল ওয়েসটেজ) দিয়ে জ্বালানির কাজ চলবে, যা বাসাবাড়ি ও ইটভাটায় ময়লার মতো ব্যবহার করা যাবে। এ দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫-৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ হবে। প্রথম অবস্থায় উৎপাদিত এই বিদ্যুৎ সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব স্থাপনাগুলোতে ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে দৈনিক যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে তার দুই-তৃতীয়াংশই থেকে যাচ্ছে। এসব বর্জ্য বৃষ্টির পানি ও স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে বিভিন্ন ডোবা-নালা ও নদীতে মিশে যাচ্ছে। এছাড়া সিটি কর্পোরেশন থেকে সংগৃহীত বর্জ্য যে স্থানে ফেলা হতো, নির্দিষ্ট সে স্থানটিও এখন ভরে গেছে। আগামী বছরের পর ওই ল্যান্ড ফিল্ডে আর স্থান সংকুলান হবে না। চলতি বছর ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থার পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সংস্থাটির আওতায় দৈনিক আবর্জনা হয় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টন। এর মধ্যে দৈনিক অপসারণ হচ্ছে ১ হাজার ৯০০ টন। বাকি ১ হাজার ৬০০ টন বর্জ্য থেকে যাচ্ছে। যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব আবর্জনা ডিএসসিসি এলাকার বিভিন্ন ডোবা-নালা এবং নদী-খালে গিয়ে ভরাট হচ্ছে। একইসঙ্গে এলাকার পরিবেশও মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্র জানায়, সংস্থার নিজস্ব বর্জ্য ল্যান্ড ফিল্ড মাতুয়াইলে প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। নগরীর বিপুল পরিমাণ বর্জ্য কোনোভাবেই সামলানো যাচ্ছে না। তাই নতুন করে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সংস্থাটি। যার নাম দেয়া হয়েছে ‘রিফিউজড ডিরাইভ ফুয়েল’ বা ‘প্রত্যাখ্যান উদ্ভূত জ্বালানি’।প্রকল্পের মাধ্যমে নগরী থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্য আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হবে। সংগ্রহ করা বর্জ্য চলে আসবে মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশে। এতে অর্থের বেশি অপচয় হবে না। বরং বিদ্যুৎ কিংবা কয়লাজাতীয় দ্রব্য উৎপাদন হবে, যা দিয়ে কয়লার চাহিদা মিটবে।বর্তমানে মাতুয়াইল ল্যান্ড ফিল্ড ভরে যাওয়ায় নতুন করে ৮১ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। এর মধ্যে ৫০ একর হবে বর্জ্য ডাম্পিং এবং ৩১ একর বার্ন প্লান্ট বা ফায়ার প্লেসের জন্য। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৪৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫১৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে শুধু জমি অধিগ্রহণের জন্য। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি এখন একনেকের অনুমোদনের অপেক্ষায়। অনুমোদন পেলে দ্রুত কাজ শুরু করবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। প্রাথমিক অবস্থা দেখে অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠানই এতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। বর্জ্য শোধনের নতুন এ প্রকল্পটি দেশে একেবারেই প্রথম। উন্নত বিশ্বে এ প্রকল্পের অনেক চাহিদা রয়েছে। ডিএসসিসি কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পের আওতায় স্থাপন করা ফায়ার প্লেসে আগুনের তাপমাত্রা যদি ১৮০০ সেন্ট্রিগ্রেট হয় তাহলে বর্জ্যের আর উচ্ছিষ্ট থাকবে না। তবে সিটি কর্পোরেশন ৬০০ থেকে ৮০০ সেন্ট্রিগ্রেট তাপমাত্রার প্লান্ট বসাতে চায়। এতে পরিবেশ দূষণের কোনো সম্ভাবনা নেই। অনেকটা ইটভাটার আদলেই প্রকল্পটি সম্পন্ন হবে। দূষিত ধোঁয়া নিঃসরণে র জন্য সুউচ্চ থাকবে একটি চিমনি। কর্মকর্তারা আরও জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর প্রথম অবস্থায় নগরীর প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই একটি করে বার্ন প্লান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত জায়গা না পাওয়ায় তা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় সিটি কর্পোরেশন। তাই সংস্থার নিজস্ব সম্পত্তি মাতুয়াইলেই প্রকল্পটি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, বসবাসের অনুপযোগী শহরগুলোর মধ্যে রাজধানী ঢাকা অন্যতম। এ শহরকে বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ঢাকার দুই মেয়র বিভিন্ন ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন গত বছরকে ‘ক্লিন ঢাকা’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু বছর শেষে ফলাফল দেখা গেছে শূন্য। ফলে নিজের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে না পারায় এখন বিকল্প পথ হিসেবে এ প্রকল্পটিই বেঁচে নিচ্ছেন তিনি। ডিএসসিসি থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৫ সালে ডিএসসিসি মোট আবর্জনা অপসারণ করে ৬ লাখ ৪৩ হাজার ৯৮৪ টন। সে হিসাবে দৈনিক আবর্জনা অপসারণের গড় ১ হাজার ৮০০ টন। আর ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিএসসিসি মোট আবর্জনা অপসারণ করেছে ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৫২৩ টন। সেই হিসাবে দৈনিক আবর্জনা অপসারণের গড় ১ হাজার ৯০০ টনের কিছু বেশি। বিগত এক বছরে ডিএসসিসির আবর্জনা অপসারণ বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে ১০০ টনের কিছু বেশি।  নগরীকে পরিচ্ছন্ন রাখতে গত বছর ৫ হাজার ৭০০টি মিনি ডাস্টবিন স্থাপন করেছে ডিএসসিসি। কিন্তু তাতেও সফলতা নেই। নির্মাণের কিছুদিন যেতে না যেতেই অধিকাংশ বিন ভেঙে ও চুরি হয়ে যায়। এসব মিনি ডাস্টবিন নষ্ট হওয়ার পর পুনঃস্থাপন করা হচ্ছে না। এ কার্যক্রম থেকে সরে এসেছে ডিএসসিসি। এমএসএস/এমএমজেড/জেআইএম

Advertisement