মতামত

ট্রাম্প ট্রাম্প ট্রাম্প এবং বাকি পৃথিবী

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে ঘিরে ২০১৬ সাল জুড়ে পৃথিবী যে পরিমান ব্যস্ততা দেখিয়েছে তা শেষ হয়েছে ৪৫-তম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে। এখন পৃথিবী নতুন করে ব্যস্ত হয়ে উঠছে সত্যি সত্যিই প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প কী করেন তা দেখার জন্য। যে কারণে শপথ অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম বক্তৃতা নিয়ে চলছে সর্বত্রই চুলচেরা বিশ্লেষণ। বরাবরের মতোই ট্রাম্প-বিদ্বেষীরা তার এই বক্তৃতাকে কট্টর জাতীয়তাবাদী, জনগণের মন রাখা (পপুলিস্ট) এবং চরম রক্ষণশীল (কনজার্ভেটিস্ট) হিসেবে বর্ণনা করছেন কিন্তু একথা কেউ একবারও বলছেন না যে, একেবারে নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই ট্রাম্প এরকমটিই ছিলেন এবং প্রেসিডেন্ট হয়েও তিনি তার এই মৌলিক অবস্থান থেকে সরে আসেননি। ফলে বেশিরভাগ সমালোচকই আসলে নিজেদের কথারই পুনরাবৃত্তি করছেন মাত্র, সমালোচনার জন্য এই সমালোচনাকে যে ট্রাম্প মোটেও পাত্তা দিচ্ছেন না তা বোঝা যায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মিডিয়া সম্পর্কিত ভাষ্য থেকে, যেখানে তিনি মিডিয়াকে আপাদমস্তক ভণ্ড হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আমার ব্যক্তিগত ধারণা হলো, মিডিয়ার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই বৈরিতা শেষাবধি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মিডিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের এই বিরোধের মূল  কারণটি আসলে কি? তা উদ্ঘাটন করা যদিও আজকের লেখার বিষয় নয়, তবুও পাঠক তার ধারণা অন্ততঃ পাবেন আজকের লেখায়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প কেমন হবেন? সে প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে সামান্য ধারণাও কি পাওয়া যায় তার শপথ বক্তৃতা থেকে? সমালোচকরা মনে করছেন যে, এই শপথ বক্তৃতা থেকেই যদি তাকে একহাত না নেয়া যায় তাহলেতো আর মান থাকে না, তাই তারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তৃতার বিশেষ বিশেষ শব্দচয়নকে ধরে আক্রমণে নেমেছেন। কিন্তু নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা বলতে চাইছেন যে, একজন জাতীয়তাবাদী রক্ষণশীল দলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যে ধরনের কথা বলার কথা তিনি সেগুলোই বলেছেন, কিছুই বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলেননি। বিশেষ করে তার অর্থনৈতিক জাতীয়বাদ সম্পর্কিত যে বক্তব্য এবং তাতে “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতি নিয়ে সমালোচনা করার মতো কী বা আছে তা বোধগম্য নয় কারণ একটি দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যদি তার নিজের দেশকে প্রাধান্য না দেন তাহলে তিনি আর কাকেই বা প্রাধান্য দেবেন? তিনি স্পষ্টভাবেই সাদা-কালো-বাদামী নির্বিশেষে আমেরিকান নাগরিককে আহ্বান জানিয়েছেন তার পাশে দাঁড়ানোর জন্য, এই ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি বাস্তবায়নের জন্য, ফলে যারা তাকে বিভেদ সৃষ্টির দায়ে দোষী করছেন তাদের বক্তব্য আসলে ধোপে টেকে না। যারে দেখতে নারি তার চরণ বাঁকা- এই যদি হয় সমালোচনার নীতি তাহলে তা নিয়ে আলোচনা যতো কম করা যায় ততোই ভালো। শুধু সমালোচনার জন্যই সমালোচনা এরকমটি করার অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে যে, এসব সমালোচকরা আসলে হিলারি ক্লিনটনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন, তার পক্ষে কাছাখুলে নেমেছিলেন ক্যাম্পেইনে, কিন্তু নির্বাচনে ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ায় তাদের সে আশার গুড়ে বালি পড়েছে। ফলে তারা এখন তাদের পরাজিত ‘ইগো’কে তৃপ্ত করতে যা সমালোচনা-যোগ্য নয় সে গ্লানি হিলারি ক্লিনটনের চেয়েও তাদের যেনো তীব্র, কারণ হিলারি ক্লিনটনতো শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন এবং ট্রাম্পকে সহযোগিতার কথাও বলেছেন, কিন্তু পৃথিবীর সর্বত্র এই সমালোচকদল (পড়ুন হিলারি সমর্থকদল) আসলে হিলারির চেয়েও এই পরাজয়কে নিজেদের ব্যক্তিগত পরাজয় বলে মনে করছেন, যে জন্য কারণে এবং অকারণে ট্রাম্পকে কয়েক হাত নেওয়াকে তারা মনে করছেন ‘বেশ একটা প্রতিশোধ নেওয়া গেলো যাহোক’-  ধরনের কাজ। ফিরে আসি ট্রাম্পের বক্তৃতায়। তিনি যে নতুন জাতীয়তাবাদী অর্থনীতির ধারণা নিয়ে কাজ করতে চাইছেন, তার মূল সুরটি আসলে ‘গ্লোবালাইজেশন’-এর বিরোধিতা করা, এমনটিই মনে করছেন বিশেষজ্ঞগণ। বিশ্বায়ন পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনেছে ঠিকই কিন্তু বিশ্বের প্রান্তিক মানুষেরা এই বিশ্বায়ন- প্রক্রিয়া থেকে বিশেষ লাভবান হয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণ আছে কি? তথ্য প্রযুক্তিকে বাদ দিলে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া যে গরীবকে আরো গরীব করেছে তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত সত্য। সেদিক বিচারে ট্রাম্প যদি এর বিরোধিতা করে মার্কিন নাগরিকদের এই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে কি? হ্যাঁ, আমরা বরং সেই প্রশ্নটি তুলতে পারি যে, তিনি এই জাতীয়তাবাদী অর্থনীতি প্রণয়ন করতে গিয়ে, গ্লোবালাইজেশনকে মোকাবিলা করতে গিয়ে বিশ্বের বাকি দেশগুলিকে কি ধরনের বিপদে ফেলবেন? যদিও প্রশান্তমহাসাগরীয় বাণিজ্য সুবিধা সংবলিত যে চুক্তি আছে তা উদারীকরণের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যে উদ্যোগ তাতে বাংলাদেশের মতো তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলি যে বাণিজ্য সুবিধা পেতে যাচ্ছে তা ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি। সে বিচারে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি কিন্তু বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলির জন্য বড় ধরনের কোনো ক্ষতির কারণ হবে বলে বোধ হচ্ছে না। বরং চীনের মতো দৈত্য-অর্থনীতির দেশের ওপর যদি মার্কিন খড়গ সামান্য হলেও নেমে আসে তাহলে তাতে বাংলাদেশের মতো ছোট অর্থনীতির দেশের উপকার লাভের সম্ভাবনাই বেশি। অপরদিকে ইউএস এইড বা মার্কিন সাহায্য কমানোর ব্যাপারে ট্রাম্প উদ্যোগ নেবেন বলে অর্থনীতিবিদরা যে তথ্য আমাদের জানিয়েছেন তাতে আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলি সরাসরি আক্রান্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু এ প্রশ্নও কি সত্য নয় যে, অর্থ সাহায্যের নামে দেশে দেশে যে মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চলে এবং সেটা এই ইউএস-এইডের মাধ্যমেই, তার দৌরাত্ম্য যদি খানিকটা হলেও কমে তাহলে তা গণতন্ত্রকামী দেশগুলির জন্যতো উপকারীই হওয়ার কথা, নয়? যে কোনো সরকারই ক্ষমতায় এসে পূর্ববর্তী সরকারের সমালোচনা করবে এবং তাদের গৃহীত কিছু পদক্ষেপকে বাদ দেবে, দেশে দেশে এই প্রবণতা স্বীকৃত সত্য। বাংলাদেশের মতো দেশগুলিতেতো এই প্রবণতা প্রায় রোগের মতো, পেছনের সরকারের সবকিছু খারাপ, অতএব পরিত্যায্য। কিন্তু ট্রাম্প তার বক্তৃতায় যখন তার পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গৃহীত অর্থনীতির সমালোচনা করেন তখন তাকে কেন অস্বাভাবিক বলে ধরে নেন সমালোচকরা? সত্যিইতো মার্কিন অর্থনীতিতে যে ধস নেমেছে বিগত বছরগুলিতে তার দায় বারাক ওবামার নীতির ওপর খানিকটা হলেওতো বর্তায়। ওয়াল স্ট্রীট ধনবাদ বিশ্বকে ভয়ঙ্কর মন্দার ভেতর ঠেলে দিয়েছে, ব্যক্তিকে বিলিওনিয়ার বানাতে গিয়ে সমগ্রকে গরীব থেকে তস্য-গরীব করেছে, এই সত্য মেনে না নিয়ে আমাদের কোনো উপায় আছে কি? এখন ট্রাম্প তার সমালোচনা করে নতুন অর্থনীতির কথা বলছেন, যা স্বাভাবিক, এর আগে বুশ করেছেন, ওবামাও করেছেন ক্ষমতা গ্রহণের পরে। মজার ব্যাপার হলো ট্রাম্পের ব্যবসা-অর্জিত সম্পদ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে, তিনি কেন সর্বাধিক ধনী প্রেসিডেন্ট? একথা কেউই বলেন না যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক প্রেসিডেন্টই রয়েছেন যাদের ধন সম্পদ সাধারণ মার্কিন নাগরিকের তুলনায় উল্লেখযোগ্য ছিল না। এমনকি জর্জ ওয়াশিংটনের মতো আলোচিত প্রেসিডেন্টও তার সময়ে একজন মিলিওনিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আর ট্রাম্প সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট হয়েও যেনো সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হচ্ছেন, অথচ  রেগান যখন প্রেসিডেন্ট হন তখন তার বয়স ট্রাম্পের তুলনায় মাত্র এক বছর কম ছিল। আগেই বলেছি, সমালোচনা করতে চাইলে তুচ্ছকেও তালগাছ করা সম্ভব, আর দেশে-বিদেশে ট্রাম্পকে নিয়ে সেটিই চলছে। ট্রাম্পের বিদেশনীতি কেমন হবে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী যে নীতি নিয়ে দেশে দেশে বিক্ষোভ চলে, উদার চিন্তার মানুষেরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে ভূমিকা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত তাহলো তাদের এই কর্তৃত্বপরায়ণতা, যা ছোট-বড় সকল দেশের জন্য বিশাল এক বোঝার মতো চেপে আছে দীর্ঘকাল যাবত। এই ফাঁস থেকে মুক্ত হতে চায় না বিশ্বের এমন কোনো দেশ আছে বলে আমার জানা নেই। ক্ষমতায় আসার আগেই ট্রাম্পকে রাশিয়ার পক্ষের মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করে ওবামা প্রশাসন ভয়ঙ্কর এক ষড়যন্ত্রের ভেতর তাকে ইতোমধ্যেই ঠেলে দিয়েছে। যে ওবামার জন্য বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ একদিন রাজপথে নেমে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিল, কোনো কিছু করার আগেই তাকে নোবেল শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত করেছিল সেই ওবামার হাত দিয়েই একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা গ্রহণের আগেই তাকে একটি শিবিরে ফেলে দিয়ে মানুষকে এই বার্তা দিতেই চেয়েছে যে, বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য নয়, একজন প্রেসিডেন্ট চাইলেই চিরবৈরী সম্পর্কের অবসান ঘটাতে পারেন না। শান্তি ও সংঘাতের সূত্র বলে যে, সংঘাত না হলে বিশ্বের বাণিজ্য-সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটবে এবং যুদ্ধই যদি না হবে তাহলে মানুষ বুঝবে কী করে যে শান্তি কী করে প্রতিষ্ঠা হয়? আমার মূল প্রশ্নটিও সেখানে, রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো হলে ক্ষতিটা কার? এবং কোথায়? আমার ধারণা, এই প্রশ্নের উত্তর ওবামা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এখন ট্রাম্প এই স্পষ্ট হওয়া উত্তর এড়িয়ে পুতিনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার সমাধান করবেন কি করবেন না তা সময় বলে দেবে। কারণ ট্রাম্প একা চাইলেই সেটা পারবেন না, আমেরিকার এস্টাব্লিশমেন্টকে চাইতে হবে। ওবামা চাননি, তাই তার প্রশাসনও চায়নি, অথচ আমরা তাকে কালো প্রেসিডেন্ট হিসেবে শান্তির দূত বলে ভুল করেছিলাম। ট্রাম্পের কাছে মানুষের চাওয়ার কিছু নেই, এটা এক ধরনের স্বস্তির জায়গা, কারণ চাওয়ার সঙ্গে প্রাপ্তির যোগ না ঘটলে মানুষের আশাভঙ্গ হয়, যা হয়েছিল ওবামার ক্ষেত্রে। যেহেতু ট্রাম্পের কাছে মানুষের কোনো চাওয়া নেই সেহেতু তিনি যাই-ই দেবেন, তাই-ই বোনাস। আর বোনাস পেলে কার না ভালো লাগে, বলুন? তবে হ্যাঁ, ট্রাম্পের শপথ বক্তৃতায় কিন্তু একটি কথা তিনি স্পষ্ট করতে পেরেছেন অন্ততঃ আমার কাছে, তাহলো, তিনি বলেছেন যে, তার সরকারের আসল বসবাস ওই শাদা বাড়িতে হবে না, সরকার আসলে বাস করবে জনগণের ঘরে- দেখাই যাক, কথাটা কতোটা সত্য হয়। ঢাকা, ২৩ জানুয়ারি, সোমবার, ২০১৭লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।masuda.bhatti@gmail.comএইচআর/এমএস

Advertisement