দেশজুড়ে

রাজশাহীর অর্থনীতিতে বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ

রাজশাহীর অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এর মধ্যে গ্রামীণ নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। যদিও এ সূচকে এগিয়ে রয়েছেন শহরের নারীরাই। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে মতে, গত এক দশকে রাজশাহীর অর্থনৈতিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এর মধ্যে দশমিক ৪৪ শতাংশ গ্রামীণ এবং ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ শহরে নারী। কৃষি উৎপাদনে সরাসরি জড়িত রাজশাহীর বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ নারী। এছাড়াও ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, ব্যবসা, চাকরি এমনকি শিল্প কারখানায় পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করছেন এ অঞ্চলের নারীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাড়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে।রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত নিলয়-ওসমান মোটর ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ফ্রেব্রিকেশন বিভাগের কর্মী সাবরিনা খাতুন (২১)। কারখানার এ বিভাগে তার সঙ্গে কাজ করছেন আরো ছয় নারী কর্মী। রয়েছেন পুরষ সহকর্মীরাও। পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারি এসব কাজ করে যাচ্ছেন প্রশিক্ষিত নারীরা।কারখানায় কথা হয় সাবরিনা খাতুনের সঙ্গে। তিনি নগরীর উপকণ্ঠ নওহাটার ঘিপাড়া এলাকার নাসির উদ্দিনের মেয়ে। তার জীবন সংগ্রামের গল্পটা একটু অন্য রকম। তার ভাষায়, ‘ষোল পেরুনোর আগেই বিয়ে হয়ে যা তার। এরপর বছর না ঘুরতেই কোলে আসে ছেলে সন্তান।’ বিয়ের সময় বাবা যৌতুক হিসেবে দিয়েছিলেন নগদ ৭০ হাজার টাকা। বিয়ের পর যৌতুকের জন্য আরো চাপ আসে মাদকাসক্ত স্বামী আল-আমীন ও তার পরিবারের তরফ থেকে। কিন্তু দেয়ার সামর্থ্য ছিল না কৃষক বাবার। ফলে তাকে সহ্য করতে হয় অমানবিক নির্যাতন। ছেলের বয়স তখন দুই মাস, স্বামীর অত্যাচার সইতে না পেরে বাবার বাড়িতে এসে ওঠেন সাবরিনা। পরে আইনত ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাদের। এরপর থেকে শুরু হয় ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম। এলাকার ইউসেপ টেকনিক্যাল স্কুল থেকে মেশিনিস্টি হিসেবে কারিগরী প্রশিক্ষণ নেন। ছয় মাস মেয়াদী ১৯তম ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষ করেও কাজ পাচ্ছিলেন না তিনি। পরে সন্ধান পান এ কারখানার। চাকরিও মিলে যায়। সল্প মেয়াদি প্রশিক্ষণ পার করে এখন পুরোদমে কাজ করছেন তিনি। তিনি আরো জানান, বাবা-মা ছাড়াও তার আরো দুইটি বোন রয়েছে। সবার বড় তিনি। ভাই না থাকায় সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে বাধ্য হয়ে কাজে নেমেছেন এ নারী। তার আয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছে সংসার। তার ছোট বোন পড়ালেখা করছেন এলাকার একটি বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে। ছেলে সিয়ামের বয়স এখন দুই বছর। তাকে মানুষের মতো মানুষ করতে চান হার না মানা এ নারী। রাজশাহীতে এমন কাজের ক্ষেত্র না থাকায় প্রশিক্ষত নারীরা অন্য কাজে ঝুকছে বলেও জানান তিনি।গল্পটা আলাদা হলেও লড়াইটা একই ওই বিভাগের আরেক নারী কর্মী পলি খাতুনের (২১)। তিনি সিরাজগঞ্জের ঘোড়াচড়া এলাকার আবুল কাশেমের মেয়ে। চার বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। ছোট দুই ভাইও রয়েছে। কৃষক বাবার আয়ে সংসারের অভাব কাটছিল না। নয় বছর বয়সে রাজশাহীতে এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠেন পলি। সেখান থেকেই ইউসেপ স্কুলে ভর্তি হন। অষ্টম শ্রেণি পাস করে প্রশিক্ষণ নেন মেশিনিস্ট হিসেবে। কিন্তু কাজ ছিল না। ফলে বাধ্য হয়ে যোগ দেন রাজশাহী বিসিকের একটি প্যাকেজিং কারখানায়। ছয় মাস কাজ করার পর চলে আসেন নিলয়-ওসমান মোটর ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে। পলি খাতুন আরও বলেন, তার বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। তিনি এখনে কর্মরত। আর ছোট ভাই কাজ করেছেন ঢাকার একটি পোশাক কারখানায়। তাদের দুইজনের আয়ে সংসার চলছে। ঘরে অসুস্থ মায়ের চিকিৎসাও চলছে। এছাড়া ছোট ভাই আলাল শেখকে (১২) নিয়ে এসেছেন গ্রাম থেকে। সে এখন ইউসেপ স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। তার পড়ালেখার খরচও দেন। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই পরিবারের হাল ধরে রাখতে চান অদম্য এ নারী। কারখানাটিকে কর্মরত অন্য নারী কর্মীরা জানান, উচ্চ শব্দের মধ্যে তারা সব সময় কাজ করেন। স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে তারা কানে এয়ার প্লাগ পরেন। তাদের মতো সব বিভাগের কর্মীরা এটা পরেন। এছাড়া মাথায় হেলমেট তো থাকছেই। ছোট খাটো কাটা-ছেঁড়ায় কারখানার নিজস্ব চিকিৎসকই স্বাস্থ্যসেবা দেন। এছাড়া কারখানায় পুরুষ সহকর্মীরা বেশ ইতিবাচক বলে জানান তারা।কারখানাটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহমুদুন্নবী জুয়েল বলেন, বর্তমানে কারখানায় ১৭২ জন দক্ষ কর্মী কাজ করছেন। এর মধ্যে ৩০ জন নারী কর্মী। পুরুষ কর্মীদের পাশাপাশি ভারি কাজও করছেন নারীরা। পুরোদমে উৎপাদনে থাকা কারখানায় এখন প্রতিঘণ্টায় একটি করে ‘নিতা টেম্পু’ তৈরি হচ্ছে। আর প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে ১৬টি। এ অঞ্চলে একমাত্র তারা মিগ ওয়েল্ডিং করে গাড়ি তৈরি করছেন। এছাড়া কর্মীদের নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।নারী অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা রাজশাহীর বেসরকারি অ্যাসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট (এসিডি)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক সালিমা সারওয়ার বলেন, এ অঞ্চলের গ্রামীণ ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্প এখনো নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপক। ব্যবসা-বাণিজ্যেও জড়িয়ে পড়ছেন নারীরা। সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এ অঞ্চলের নারীকে এগিয়ে নিয়েছে। এছাড়া কৃষিতে তো নারীদের সরাসরি অংশগ্রহণ রয়েছেই। আর এসব কারণে এ অঞ্চলের নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নও অনেক বেড়েছে। তবে এখনো নারীদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় কিছু সমস্যা রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী মহিলা পরিষদের সভানেত্রী কল্পনা রায়। তার ভাষায়, এখনো গ্রামাঞ্চলে কুসংস্কার এবং সামাজিক বাধা প্রকট। ফলে অর্থনীতিতে এখন নারীদের যে অবদান তা আরো কয়েকগুণ বেশি হতো। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও অনানুষ্ঠানিক খাতে মজুরি বৈষম্য এখনও প্রকট। গ্রামীণ নারী শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় প্রাতিষ্ঠনিক ব্যবস্থা এবং কৃষি তথ্য পৌঁছে দেয়ার বিশেষ উদ্যোগ নেয়ারও তাগিদ দিয়েছেন এ নারী অধিকার কর্মী।এদিকে, ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী, ২০০১ও ২০০৩ সালে ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ হারে রাজশাহীর অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ ১৭ হাজার ৬৭জন। ২০১৩ সালে ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ হারে তা গিয়ে দাঁড়ায় ৪৯ হাজার ৯৬৯ জনে। এক দশকে ৩২ হাজার ৯০২ জন নারী জড়িয়েছেন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। সমীক্ষা বলছে, রাজশাহীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পুরুষের অংশগ্রহণের হার কমেছে ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। তবে বেড়েছে পুরুষ কর্মীর সংখ্যা। ২০০১ ও ২০০৩  সালে রাজশাহীতে নিযুক্ত ছিলেন এক লাখ ৭৭ হাজার ৭৬৬জন পুরুষ। যা মোট অংশগ্রহণের ৯১ দশমিক ২৪ শতাংশ। ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৪৬ জন বেড়ে ২০১৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ১১২ জন। যা মোট হিসেবের ৮৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।এ অঞ্চলের সামগ্রিক অর্থনীতিতে গ্রামীণ জনগণের অংশগ্রহণ বেড়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ নারী। ২০০১ ও ২০০৩ সালের হিসেবে, রাজশাহীর শ্রমবাজারে ছিলেন মোট ২ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৮জন গ্রামীণ শ্রমজীবী। এর মধ্যে ৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ হারে নিযুক্ত ছিল ৮ হাজার ২৮৬ জন নারী। এর মধ্যে ৪ হাজার ৬৯০ জন স্থায়ী এবং ২৭৯ জন অস্থায়ী। এক দশকে কর্মক্ষেত্রে নারী কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে দশমিক ৪৪ শতাংশ। ২০১৩ সালে রাজশাহীর শ্রমবাজারে ছিল ২ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৮জন। এমধ্যে ২৪ হাজার ৯১২জন নারী। নারী কর্মীদের ১৩ হাজার ৬৫৫ জনই স্থায়ী। বাঁকি ১৪ জন অস্থায়ী।তবে গ্রামীণ নারীদের চেয়ে বেশি এগিয়েছেন শহরে নারীরা। শিক্ষা-দিক্ষা ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা এগিয়ে নিয়েছে শহরে নারীদের। ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ হারে বর্তমানে কর্মরত শহরে নারীর সংখ্যাং ২৫ হাজার ৫৭ জন। এক দশক আগেও এ সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৭১৮জন। যা ছিলো মোট শ্রমবাজারের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। এক দশকে তা বেড়েছে ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। বর্তমানে শহরে কর্মরত রয়েছেন এক লাখ ৭৪ হাজার ৫০৬ জন পুরুষ। ২০০১ ও ০০৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ৯৯ হাজার ৪১৩জন। বর্তমানে ১৮ হাজার ৩৯৮ জন স্থায়ী এবং ১৫০ জন অস্থায়ী নারী কর্মী কাজ করছেন শহরাঞ্চলে।গত দুটি অর্থনৈতিক শুমারি মতে, বছরে রাজশাহীতে ৬ শতাংশ অর্থনৈতিক ইউনিট এবং ৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ মোট অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বেড়েছে। ২০০১ ও ২০০৩ সালে রাজশাহীতে অর্থনৈতিক ইউনিট ছিল ৭৯ হাজার ৪০৫টি। ২০১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৩ হাজার  ৮৬৫। অন্যদিকে, ২০০১ ও ২০০৩ সালে রাজশাহীতে মোট কর্মজীবী ছিলেন এক লাখ ৯৪ হাজার ৮৩৩জন। ২০১৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৮১ জনে। শতকতা হিসেবে, অর্থনৈতিক ইউনিট ও মোট কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা যথাক্রমে গ্রামাঞ্চলে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ ও ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং ৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ ও ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ।ফেরদৌস সিদ্দিকী/এআরএ/এমএস

Advertisement